
ক্যানভা প্রো’র মাধ্যমে তৈরি ছবিটি আরজু গেবুলায়েভার
তুরস্কের সিভাসের একটি পুরুষ ফুটবল দলের সদস্যরা খেলার শুরুতে একটি ব্যানারে “দোগাল ওলান নরমাল দোগাম” (‘স্বাভাবিক জন্মই তো স্বাভাবিক’) লিখে সিজারিয়ান সেকশনের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দেওয়া “স্বাভাবিক” নয় বা যোনিপথে সন্তান জন্ম দেওয়ার চেয়ে নিন্মতর ইঙ্গিত করে ব্যাপক জনপ্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করায় দেশটিতে একটি প্রশ্ন উঠেছে: তাহলে “কী স্বাভাবিক?”
তারপর থেকে সামাজিক গণমাধ্যমে বিরোধী রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও নারী অধিকার কর্মীসহ অসংখ্য নারী পাল্টা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। ইস্তাম্বুলের মেয়র একরেম ইমামোগলুকে ১৯ মার্চ গ্রেপ্তারের পর দেশটিতে চলমান বিক্ষোভ শুরুর পর এই আলোচনা শুরু হয়েছে।
ব্যানার
সিভাস্পোর ও ফেনারবাহের মধ্যে ১৩ এপ্রিল খেলার আগে যোনিপথে জন্মদানের প্রচারণার জন্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যাপক সমালোচিত এই ব্যানারটি প্রকাশিত হয়।
বিবিসি তুর্কি’র প্রতিবেদন অনুসারে, তুর্কি ফুটবল দলগুলির ক্ষেত্রে জনসেবা ঘোষণার ব্যানার নিয়ে মাঠে নামা একটি দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য। সরকারি প্রতিষ্ঠান বা অলাভজনক সংস্থার মূল্যায়নের জন্যে দলগুলিতে জমা দেওয়া হোক বা না হোক, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নির্ভর করে তুর্কি ফুটবল ফেডারেশনের উপর।
ব্যানারটি নারী অধিকার গোষ্ঠী, সাংবাদিক বা রাজনীতিবিদদের নজর এড়ায়নি এবং সর্বত্র তীব্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে:
Tamam, siz “normal” doğum yaparsınız o zaman. pic.twitter.com/jXw0do8Mpu
— Kadın Cinayetlerini Durduracağız Platformu (yeni) (@kcdplatformu) April 13, 2025
ঠিক আছে ভাই, তাহলে তো আপনার ‘স্বাভাবিক’ জন্মই হয়েছে।
আমরা নারীহত্যা থামাবো মঞ্চের প্রতিনিধি এসিন ইজেল উইসাল বীরগুন সংবাদপত্রকে বলেন, “এই পরিস্থিতি সরকারের নীতিমালা প্রকাশ করে। মা ও শিশুর স্বাস্থ্য এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। জন্ম কেমন হবে তা বলার অধিকার কারো নেই।”
সামাজিক গণমাধ্যমে প্রচারিত একটি চিত্রে একটি ব্যানারের অঙ্কনে ফুটবল খেলোয়াড়দের শিক্ষার্থীদের কারাগারে আটকে রাখার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ না করে পরিবর্তে নিজেদের কাজের দিকে মনোযোগ দিতে বলা হয়েছে।
“Normal doğum diye bir şey yoktur!” pic.twitter.com/J6KUpPI0Ou
— Wannart (@wannartcom) April 14, 2025
স্বাভাবিক জন্ম বলতে কিছু নেই। যোনিপথে বা সিজারিয়ানে জন্ম হয়, যা আপনার কোনো ব্যাপার নয়। ৮৩ জন শিক্ষার্থী এখনো কারাগারে আছে।
প্রধান বিরোধীদল রিপাবলিকান পিপলস পার্টির (সিএইচপি) নেতা ওজগুর ওজেল ১৫ এপ্রিল তার দলের সংসদীয় দলের সভায় বলেন: “একজন নারীর উপর নির্ভর করে যে তিনি কতো সন্তান জন্ম দেবেন, কীভাবে তাদের জন্বেম দেবেন, কীভাবে তাদের লালন-পালন করবেন, কীভাবে পোশাক পরবেন, কী খাবেন, কী পান করবেন, কতোটা হাসবেন। আমাদের কারো এবিষয়ে বলার কিছু নেই। নারীদের প্রতি কথা বলা ও সিদ্ধান্ত নেওয়া বন্ধ করুন। এই বিষয়গুলি মানুষকে পুরুষ হতে লজ্জা দেয়।”
ডিইএম পার্টি গ্রুপের সহ-সভাপতি গুলিস্তান কিলিক কোসিগিত ব্যানারের ব্যবহারকে “শরীরের রাজনীতি” বলে অভিহিত করেছেন কারণ এটি “স্বাভাবিক জন্মই তো স্বাভাবিক বা সঠিক, ও সিজারিয়ান জন্ম ভুল, এবং এটি করে নারীদের চাপে ফেলা”র মতো কিছু।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী কামাল মেমিসোগলু ১৪ এপ্রিল ব্যানারটির পক্ষে বলেন। ব্যানার সম্পর্কে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “বন্ধুরা, পুরুষরাই কেবল ফুটবল খেলে না।” মন্ত্রী একটি টুইটে “স্বাভাবিক জন্ম” প্রচারের একটি ভিডিও ভাগাভাগিও করেছেন।
এদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে তারা “নারীদের জন্যে কোনো নির্দিষ্ট জন্মদান পদ্ধতি নির্দেশ করে না বা চাপিয়ে দেয় না; এটি বৈজ্ঞানিক তথ্যের উপর ভিত্তি করে স্বাভাবিক জন্মের সুবিধা সম্পর্কে সামাজিক সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে গবেষণা পরিচালনা করে।” মন্ত্রণালয়ের ভাগাভাগি করা তথ্য অনুসারে, তুরস্কে ৬১ শতাংশ জন্ম সিজারিয়ান সেকশনের মাধ্যমে করা হয়।
হাল্ক টিভির একটি সংবাদ অনুষ্ঠানের উপস্থাপক সাংবাদিক এসি উনার সংবাদ আওয়ারে ক্লিপটি সম্প্রচার করে বলেন, “নবজাতক কেলেঙ্কারিতে দেশটি কাঁপানোর পর একজন নারী কীভাবে জন্ম দেন তার চেয়ে বরং (স্বাস্থ্যমন্ত্রীর) শিশুর জন্মের পরে তার কী হয় তা নিয়ে বেশি চিন্তিত হওয়া উচিত। সকল জন্মই স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক বিষয় হলো এতে পুরুষদের হস্তক্ষেপ।”
অভিনেত্রী ওজগে ওজপিরিঞ্চিও ব্যানারটির প্রতিক্রিয়া জানিয়ে তার ইনস্টাগ্রাম গল্পে নিচের লেখাটি পোস্ট করেছেন: “যা স্বাভাবিক হওয়া উচিত তা হলো আপনার শিশু নবজাতক যেনো গ্যাংয়ের হাতে না পড়ে। যা স্বাভাবিক হওয়া উচিত তা হলো আপনার প্রাপ্তবয়স্ক শিশু যেনো তাদের সাংবিধানিক অধিকার চর্চার সময় গ্রেপ্তার না হয়। যা স্বাভাবিক হওয়া উচিত তা হলো আপনার শিশু তাদের শিক্ষকদের ছাঁটাইয়ের প্রতিবাদে স্কুলের উঠোনে নিজেদের খুঁজে না পায়। যা স্বাভাবিক হওয়া উচিত তা হলো বর্তমান স্থিতাবস্থা পরিবর্তন না করা।” অভিনেত্রী “প্রকল্প স্কুল“-এ শিক্ষকদের ছাঁটাই ও পুনর্নির্ধারণের বিরুদ্ধে উচ্চবিদ্যালয়ে চলমান বিক্ষোভের পাশাপাশি “নবজাতক কেলেঙ্কারি“র দিকে ইঙ্গিত করেছেন, যা ২০২৪ সালের অক্টোবরে সারা দেশকে আলোড়িত করে। নবজাতকদের যত্ন থেকে লাভবান হওয়া একদল চিকিৎসা কর্মীকে ঘিরে আবর্তিত এই কেলেঙ্কারিতে তারা নবজাতকদের তাদের ইচ্ছাকৃত চিকিৎসাগত অবহেলার শিকারে পরিণত করেছিল।
এখন পর্যন্ত ফুটবল দলের শুধু একজন সদস্য আলবেনীয় খেলোয়াড় রেই মানাজ ক্ষমা চেয়েছেন। মানাজ তার ইনস্টাগ্রাম প্রোফাইলে লিখেছেন, “আমার পক্ষ থেকে আমি সকল নারীদের কাছে ক্ষমা চাইছি; আপনার শরীরের সিদ্ধান্ত আপনার।” ফুটবল খেলোয়াড় আরো লিখেছেন ফুটবল মাঠে তিনি ব্যানারটি ধরে রাখার সময় তুর্কি ভাষায় কী লেখা ছিল তা জানতেন।
সামাজিক গণমাধ্যম মঞ্চে মাহিরগ্রা নামে পরিচিত একজন গ্রাফিক ডিজাইনার মাহির আক্কয়ুন একটি ইনস্টাগ্রাম পোস্টে বিতর্কের সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন: “যা স্বাভাবিক নয়” শিরোনামে বর্তমান রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশের কথা উল্লেখ করে দেশের সাম্প্রতিক ও অতীতের অনেক সমস্যার তালিকা তৈরি করেছেন যাতে নারীহত্যা, জীবনযাত্রার ব্যয় সংকট, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ ও শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার, পুলিশি সহিংসতা ও বর্বরতা, প্রতিটি দুর্যোগ বা ট্র্যাজেডির পরে শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে জবাবদিহিতার অভাবসহ আরো অনেক কিছু রয়েছে।
ক্রমহ্রাসমান জন্মহার
জন্মের প্রতি ক্ষমতাসীন সরকারের আচ্ছন্নতা তুরস্কে নতুন নয়। বর্তমান রাষ্ট্রপতি দীর্ঘদিন ধরে পরিবারগুলিকে কমপক্ষে তিনটি সন্তান ধারণের জন্যে উৎসাহিত করে আসছেন। ২০২৫ সালকে পরিবারের বছর ঘোষণা করে তিন সন্তানের বিদ্যমান মন্ত্রে পরিবারগুলিকে উৎসাহিত করতে ক্ষমতাসীন সরকার আর্থিক প্রণোদনা চালুর চেষ্টা করে, যা ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জন্মের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। এই প্রণোদনাগুলি শিশুর পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত পাওয়া গেলেও পরিবারগুলিকে পরবর্তী পর্যায়ে সহায়তার কোনো প্রণোদনার কথা উল্লেখ নেই।
দেশের ক্রমহ্রাসমান জন্মহার প্রথম নিবন্ধিত ও ঘোষণা করা হয়েয় ২০২৩ সালে যা রেকর্ড-সর্বনিম্ন (২০০১ সালে ২.৩৮ এর তুলনায়) ১.৫১ জন্মের নির্দেশ করে। এটি ২.১ এর তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম হার, যা অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থার (ওইসিড) তথ্য অনুসারে, জনসংখ্যা হ্রাস না করে ভারসাম্য বজায় রাখার একটি সীমা হিসেবে বিবেচিত।
মে ২০২৪ সালে পরিবার ও সমাজসেবা মন্ত্রণালয় সর্বনিম্ন জন্মহার ও সর্বোচ্চ বিবাহবিচ্ছেদের অনুপাতসহ শহরগুলিতে গবেষণা শুরু করে। অক্টোবর ২০২৪ সালে কর্তৃপক্ষ দেশের ক্রমহ্রাসমান জন্মহার মোকাবেলায় “স্বাভাবিক তা জন্মই তো স্বাভাবিক ” প্রচারণা শুরু হয়। প্রচারণার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মেমিসোগলু সি-সেকশন বৃদ্ধি ও প্রাকৃতিক জন্ম হ্রাসের কথা বলেন। ডিসেম্বর ২০২৪-এ রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে জনসংখ্যা নীতি সংক্রান্ত উচ্চ পরিষদ গঠন করা হয়।
তবে রাজনৈতিক কর্মীদের মতে নতুন প্রতিষ্ঠান স্থাপন বা নতুন প্রচারণা তৈরির পরিবর্তে দেশের চিকিৎসা পরিষেবায় বিদ্যমান ফাঁক ও ঘাটতিগুলি দূর করা উচিত। তুর্কি চিকিৎসা সমিতির নারী ঔষধ ও নারী স্বাস্থ্য শাখার নির্বাহী সদস্য ডাঃ ডেরিয়া বুলগুরের মতে, দেশের বর্তমান চিকিৎসা ব্যবস্থা একজন মায়ের সুস্থ যোনিপথে জন্মদানের জন্যে দরকারী সকল প্রয়োজনীয়তা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। তুরস্কের একটি সংবাদমাধ্যম এভরেন্সেলের সাথে একটি সাক্ষাৎকারে বুলগুর বিদ্যমান ফাঁকগুলি তুলে ধরেন, যার মধ্যে অপর্যাপ্ত চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা, এইচপিভি টিকাদানের অভাব ও নারীদের স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দেয় এমন কয়েকটি নীতি রয়েছে।
“সবচেয়ে বেশি সি-সেকশনের দেশগুলির মধ্যে তুরস্কের অন্তর্ভূক্তির সম্পূর্ণ কারণ হলো বিনামূল্যে প্রাকৃতিক জন্মদানের ব্যবস্থার অপ্রতুলতা, [চিকিৎসা] ব্যবস্থা থেকে ধাত্রীদের বিতাড়িত করা এবং সিজারিয়ান প্রসবের সময় বেসরকারি হাসপাতালগুলির বেশি আয়,” তুর্কি সংবাদপত্র বীরগুনের জন্যে একটি মতামত প্রবন্ধে লেখিকা জেইনেপ আলতিওক লিখেছেন।
ব্যানারটি ঘিরে আলোচনা এবং মা ও তার চিকিৎসক কেবল এই দু’ব্যক্তির উদ্বেগ ও সিদ্ধান্তের সাথে ১১ জন পুরুষ ক্রীড়াবিদকে এমন কী একটি সম্পর্ক রয়েছে যা একটি ব্যক্তিগত ও চিকিৎসাগত সিদ্ধান্তকে দেশব্যাপী বিতর্কে পরিণত করে চলেছে।