ভূমিকম্পের পরে অস্ত্র বিরতির ঘোষণা সত্বেও মিয়ানমারের সামরিক জান্তার আকাশ থেকে বোমা বর্ষণ

Myanmar earthquake

ভূমিকম্প পরবর্তী পর্যায়ে উদ্ধার অভিযান প্রচেষ্টা চলমান সত্বেও সামরিক জান্তা মিয়ানমারের সাগাইং ও মান্দালয়ে শহরে বোমা বর্ষণ করেছে। ছবি ন্যাশনাল ইউনিটি গর্ভমেন্ট মিয়ানমার এর ফেসবুক পাতা থেকে নেওয়া।

মানবাধিকার সংস্থা, প্রচার মাধ্যম ও জাতিসংঘ অভিযোগ করেছে যে ২ এপ্রিল ২০২৫ করা নিজের শান্তি চুক্তি মিয়ানমারের সামরিক জান্তা নিজেই ভঙ্গ করেছে, বিশেষ করে যখন তারা গণতন্ত্র পন্থীদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ক্রমাগত বোমা বর্ষণ করে যাচ্ছে।

২৮ মার্চ ২০২৫ তারিখে মিয়ানমারে ৭.৭ মাত্রার এক ভূমিকম্প আঘাত হানে যা মান্দালয়,সাগাইং, মাগওয়ে, শান স্টেটস, নয়াপিদাও ও বাগোতে আঘাত হানে। ৩ এপ্রিল ২০২৫ পর্যন্ত এই ভূমিকম্পে মিয়ানমারে মৃতের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৩০৮৫ জন ও আহত হয় ৪৭১৫ জন ও ৩৪১ জন তখন পর্যন্ত নিখোঁজ ছিল। এদিকে স্বাধীন প্রচার মাধ্যম ডিভিবি সংবাদ প্রদান করেছে যে তাদের নিজস্ব পর্যবেক্ষণে মৃতের সংখ্যা ৩৮৬৬। মৃতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে যেহেতু জান্তা সরকারের প্রদান করা তথ্য নিষেধাজ্ঞার ফলে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ দুর্গম অঞ্চলে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা নিরূপণ করতে অক্ষম।

২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সামরিক বাহিনী মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল করে ও এই শাসনকে প্রতিহত করতে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে গণতন্ত্রপন্থী জোট দ্য ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্মেন্ট ।

ভূমিকম্পে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ সত্ত্বেও জান্তা সরকার কেবল ২ এপ্রিল মানবিক অস্ত্র-বিরতি ঘোষণা প্রদান করে, ন্যাশনাল ইউনিটি গর্ভমেন্ট বা এনইউজি এর ন্যাশনাল ইউনিটি কাউন্সিল সংবাদ প্রদান করেছে যে ভূমিকম্পের পরে পাঁচদিনে ১১টি জায়গায় ৩২ বার বিমান হামলা চালিয়েছেন যে ঘটনায় ৫০ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত ও ৪৯ জন আহত হয়েছেন।

অস্ত্র-বিরতির ঘোষণা প্রদান করা সত্বেও জান্তা গ্রামবাসীদের উপর হামলা চালানো বন্ধ করেনি, তারা সেই সমস্ত গ্রামে বিমান হামলা চালিয়েছে যে সমস্ত গ্রাম এনইউজি বা নাগ-এর শক্তিশালী ঘাঁটি হিসেবে চিহ্নিত। যে সমস্ত সম্প্রদায় এই ভূমিকম্প বিপর্যয়ে পীড়িত তাঁদের প্রতি হামলার নিন্দা জানিয়েছে নাগ।

মিয়ানমারের নির্মম সামরিক শাসক সারা মিয়ানমার জুড়ে নিয়মতান্ত্রিক ভাবে ও ব্যাপক আকারে মানবাধিকার লংঘন করেই চলেছে। এর মধ্যে রয়েছে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এর মত ঘটনা। ভূমিকম্পের মত এই মানবিক সংকট চলা সত্বেও সামরিক জান্তা সাধারণ নাগরিকদের বিরুদ্ধে বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে।

২৮ মার্চ ২০২৫ এর ভূমিকম্পের পর মিয়ানমারের সামরিক জান্তা এক সপ্তাহের মধ্যে ৬৩ বার বিমান ও ক্ষেপনাস্ত্র হামলা চালিয়েছে, যার ফলে 6৮ জন সাধারণ নাগরিকের মৃত্যু ঘটেছে। এর মধ্যে একজন শিশু ও ১৫ জন মহিলা রয়েছে। যে এলাকাটি এই হামলার আঘাতে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ সেটা হলো সাগাইং (১৩ বার হামলা চালানো হয়েছে।) ও এরপরে রয়েছে মান্দালয় (যেখানে ৮ বার হামলা চালানো হয়েছে)।

প্রচার মাধ্যম সংবাদ প্রদান করেছে ২ এপ্রিল মিয়ানমার সামরিক বাহিনী সাগাইং এ ১১ বার বিমান হামলা চালিয়েছে, মান্দালয়ের বেশ কয়েকটি গ্রামকে লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছে। কাচিনের বেশ কয়েকটি সম্প্রদায়ের উপর ড্রোন ও ক্ষেপনাস্ত্র হামলা চালানো হয়েছে এবং বাগানের বিশ্ব সংস্কৃতির ঐতিহ্যপূর্ণ এলাকার কাছে কিছু বাসা জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার অফিস বলছে যে সাময়িক অস্ত্র বিরতি ঘোষণার পরেও জান্তার সেনাবাহিনী ১৪ বার হামলা চালানোর জন্য দায়ী।

শুক্রবারে জাতিস্ংঘ জানিয়েছে যে গত সপ্তাহে দেশটিতে সংঘঠিত এই বিপর্যয়কর ভূমিকম্পের পরও মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী দেশে ডজনখানেকের বেশী বিমানহামলা চালিয়েছে, আর অস্থায়ী শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করার পর অন্তত ১৪ বার হামলা চালানো হয়েছে।

অন্য আরেক সংবাদে জানা যায় প্রতিরোধ বাহিনী যে সমস্ত এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে সে সমস্ত এলাকায় ত্রাণ সামগ্রী ও জীবন বাঁচানোর সামগ্রী ও সাহায্য সামগ্রী পৌঁছাতে সামরিক বাহিনী বাধা দিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

মানবাধিকার সংস্থা ও প্রচার মাধ্যম দেখছে য যে সামরিক বাহিনী অনুসন্ধান ও উদ্ধার অভিযানে নিজেদের নিয়োজিত করার বদলে বিমান হামলা কার্যক্রমের প্রতি মনোযোগ প্রদান করেছে। মিয়ানমারের এক নির্বাসিত সংবাদ মাধ্যম দি ইররাওয়াদ্দি তার এক সম্পাদকীয়তে লিখেছে:

মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর হেলিকপ্টারগুলো কোথায়? সেগুলোকে তো অনুসন্ধান ও উদ্ধার অভিযানে অংশ নিতে দেখা যাচ্ছে না। দেখে মনে হচ্ছে এগুলো সন্দেহভাজন প্রতিরোধ যোদ্ধাদের এলাকায় বোমা বর্ষণে ব্যস্ত।

দেশ জুড়ে যে বিমান হামলা চালানো হচ্ছে, জান্তার সে সকল বিমান হামলা অবশ্যই বন্ধ করা উচিত। রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক কাউন্সিল (এসএসি) এর জেনারেলরা হল হামলাকারী আর তাদের অবশ্যই এই হামলা ও নৃশংসতা বন্ধ করতে হবে।

ইররাওয়ার্দ্দি-এর এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর কাওয়া জাও মোয়ে অভিযোগ করেছেন যে জান্তার ধীর গতি ও অকার্যকর ভাবে সাড়া দেওয়ার কারণে ভুমিকম্পে মৃতের সংখ্যা বেড়ে গেছে।

ভূমিকম্পে প্রাণ হারানোর বেশীর ভাগে সাথে সাথে মৃত্যু বরণ করেনি; এদের বেশীর ভাগের এই ঘটনায় মৃত্যু হওয়ার কারণ ভূমিকম্পের ঘণ্টা খানেকের মধ্যে অথবা এমনকি কয়েকদিন পরেও এদের উদ্ধার করা হয়নি । জেনারেলদের এমন কি সাধারণ ধারণা ও যৌক্তিক চিন্তাও নেই- আসুন সঠিক প্রক্রিয়া প্রয়োগ করি- আসুন ধ্বংসস্তূপ সরানোর চেয়ে সবার আগে জীবন বাঁচাই।

জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থার হাই কমিশনার ভলকার টুর্ক জান্তার কাছে পুনরায় আবেদন জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থা ও উদ্ধারকারী দলকে যেন নিঃশর্তে প্রবেশ করতে দেয়।

স্থানীয় পর্যায় থেকে জানা যায় যে ভূমিকম্প আঘাত হানা এলাকায় এক অমানবীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, বিশেষ করে সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত এলাকার বাইরে যে সমস্ত এলাকা রয়েছে সেখানে ত্রাণ প্রচেষ্টার অভাব রয়েছে সেই সাথে রয়েছে পরিষ্কার পানি, খাবার ও চিকিৎসা সেবার অভাব রয়েছে। ইতোমধ্যে বেসামরিক বা সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে আরো বেড়ে গেছে যারা সামরিক অভ্যুত্থানের পর চার বছর ধরে সামরিক শাসনের অত্যাচারের মধ্যে বাস করছে।

জান্তা সরকারের আরোপিত ইন্টারনেট ও সংবাদ নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে নিন্দা জানিয়ে ১২০ টি গ্রুপ সেগুলো তুলে নেওয়ার জন্য এক দরখাস্তে স্বাক্ষর করেছে।

ভূমিকম্পের সময় জনগণ যাতে তথ্যের উপর অধিকার না পায় সেজন্য ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া ও সেগুলোর উপর নাগরিকদের অধিকার সীমাবদ্ধ করে দেওয়ার পুরো দায়ভার সামরিক পরিষদের উপর বর্তায়। তাঁদের কর্মকাণ্ড কেবল জটিল তথ্যে প্রবাহের বিঘ্ন ঘটায়নি, সময়োচিত উদ্ধার অভিযান বিঘ্ন ঘটিয়ে যে সমস্ত মৃত্যু ঠেকানো যেতো সেগুলোকে ঠেকায়নি! জীবনকে এই ভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া ও ব্যাপক যন্ত্রণার মধ্যে ফেলে রাখা যা ইচ্ছাকৃত, সেটা নিয়ন্ত্রণের কারণে এই ঘটনার জন্য একমাত্র দায়ী সামরিক পরিষদ।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .