
কাভরা অঞ্চলের মোসা বাঁশের ঝাড়। ছবি নেপালি টাইমসের মাধ্যমে পাওয়া শৈলেশ আরসির ছবি। অনুমতিক্রমে প্রকাশিত।
এই রচনাটির মুল লেখক রিঙ্কি শ্রিশ রানা। লেখাটি নেপালি টাইমসে প্রকাশিত হয়েছে আর এর এক সম্পাদিত সংস্করণ কন্টেন শেয়ারিং চুক্তি অনুসারে পুনরায় গ্লোবাল ভয়েসেস অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছে।
নেপালির বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতিতে বাঁশের ব্যবহার বহুবিধ। জন্ম থেকে মৃত্যু ও সকল প্রথার মাঝে বাঁশের ব্যবহার রয়েছে। এই বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ গৃহ নির্মাণ থেকে শুরু করে বাদ্যযন্ত্র নির্মাণ, কোন কিছু বহনকরা থেকে লেখার জন্য এবং এমনকি খাবার হিসেবেও ব্যবহার হয়।
এখন চিতওন ন্যাশনাল পার্কের কাছে গ্রাম রক্ষার জন্য বাঁশঝাড় ব্যবহার হচ্ছে। এটি দক্ষিণ নেপালের এক এলাকা যেটা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রায়শ বন্যা প্রবণ এক এলাকায় পরিণত হয় ।
এই অঞ্চল ছোট ছোট ঝিরি (অগভীর পাহাড়ি ছোট আকারের নদী বা অগভীর জলপ্রবাহ) রয়েছে যেগুলো শীতকালে শুকিয়ে যায়। আর বর্ষা মৌসুমে সবগুলো প্রমত্ত হয়ে ওঠে। এই বন্যা ও ভূমিধ্বসের সাথে লড়াই এর জন্য মাডি গ্রামের নাগরিকেরা ঝিরির ধারে বাঁশঝাড় রোপণ করছে যা বন্যা প্রতিরোধ এবং ভূমিক্ষয় রোধ করে।
৫৮ বছর বয়স্ক শান্তি চাপাই বলেন, “আর যখনই বর্ষা শুরু হয় আমরা ভয়ের রাতে দুচোখের পাতা এক করতে পারি না। যিনি পাতারে খোলা পাহাড়ি নদীর ধারে বাস করেন, যেটা গত বছর বন্যায় সব ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।”

গুগল আর্থের ছবিতে বিগত ১৫ বছরে পাতারে খোলায় প্লাবনভূমির সবুজ এলাকা দেখাচ্ছে। ছবি এবিএআর আই এর সৌজন্যে নেপালি টাইমসের মাধ্যমে পাওয়া।
সম্প্রতি পাতারে খোলায় গিয়ে দেখা গেল এক ছোট ঝিরি, যা দেখে কল্পনা করা খুবই কঠিন যে এই সামান্য ঝিরি বর্ষাকালে এক প্রচণ্ড প্রমত্ত নদীতে পরিণত হয়। তখন এটি তার দুকূল ভাসিয়ে নিয়ে যায় এবং স্থানীয় চাষের জমি ও বসতির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।
বাঁশকে নিয়মিত ভাবে বাগানে বেড়া দেওয়া ও আসবাব বানানোর কাজে ব্যবহার করা হয়, যা এক গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল। প্রথমে কৃষকেরা বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বাঁশের ব্যবহারের বিপক্ষে ছিল। তারা ভেবেছিল বাঁশ হচ্ছে এমন এক খারাপ প্রজাতির উদ্ভিদ যা মাটি থেকে পানি শুষে নেবে।
কিন্তু বিগত ১৫ বছরে এবিএআররি এর (এডোব এন্ড বাম্বো রিসার্চ ইনিস্টিটিউট) এর স্থাপত্যবিদেরা ক্ষয়প্রাপ্ত জমি পুনরুদ্ধার করা ও বন্যা প্রতিরোধের এক মাধ্যম হিসেবে বাম্বোসা ব্লিয়েমেনা ও বাম্বোসো বালকাও নামের কাঁটাওয়ালা বাঁশ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। এই এলাকা এখন ঘন বাঁশের ঝাড়ে পরিণত হয়েছে যা পাতারে খোলার বন্যায় ভেসে যাওয়া এলাকাকে সবুজ এলাকায় পরিণত করেছে।

মাডিতে কাঁটাযুক্ত প্রজাতির বাঁশ রোপন। ছবি নেপালি টাইমসের মাধ্যমে পাওয়া, যা তুলেছে পিঙ্কি শ্রিশ রানা। অনুমতিক্রমে প্রকাশিত।
গতবছর বর্ষা (জুন থেকে অক্টোবর ২০২৪) মৌসুমে বন্যায় পড়া পলি বাঁশঝাড়ের নীচে জমে আছে, এটাই প্রমাণ যে বাঁশ রোপনের ফলে তীরগুলো ক্ষয় হচ্ছে না ও বন্যার পানির তীব্রতা থেকে এই উদ্ভিদ গ্রামগুলোকে রক্ষা করছে।
মাডির গ্রামবাসীরা এখন বিশ্বাস করছে যে এটা জৈব প্রযুক্তি যা বন্যা নিয়ন্ত্রণে এক কার্যকরী সমাধান। বাঁশ খুব দ্রুত বেড়ে ওঠে ও নদীর ক্ষয়ে যাওয়া তীরকে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য এক আদর্শ উদ্ভিদ। নেপালে ৫০ প্রজাতির বাঁশ রয়েছে যেগুলো নেপালের বৃহত্তর পূর্ব সমতল এলাকা ও পাহাড়ের পাদদেশে পাওয়া যায়। তবে বাঁশের কিছু কিছু প্রজাতি ৪০০০ মিটার উঁচু এলাকাতেও জন্মে।
আমাদের নেপালি সংস্কৃতিতে অনেকে বাঁশকে ভুল বুঝে, কারণ মৃতদেহ পোড়ানোর কাজে বাঁশের ব্যবহার হয়। বলেছেন এবিএআরআই-এর নিরপাল অধিকারী। এবিএআরআই, যারা বাঁশএর ঝাড় তৈরি করে ও নেপালে মাটি দিয়ে স্থাপনা তৈরি করে, “স্থানীয়দের এর সুবিধার বিষয়টি বোঝাতে তাঁদের বেশ খানিকটা সময় লেগেছিলো”।
নেপালে সবসময় বর্ষার অপর নাম বিপর্যয়। কিন্তু জলবায়ুর বিপর্যয়ের কারণে চরম আবহাওয়া ভূমিধবস ও বন্যা পরিস্থিতিকে আরো খারাপে পরিণত করেছে। সেই সাথে যুক্ত হয়েছে বাজে ভাবে রাস্তার নির্মাণে, সংবেদনশীল জলাশয় এর অনিয়মিত অনুসন্ধান ও প্লাবনভুমি দখল করে নেওয়া, যা বন্যার ঝুঁকি আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

গুচ্ছ বা সজারু মত বাঁশ বোপনের এক কাঠামো, যা বন্যা হয় এমন এলাকায় বন্যা প্রতিরোধের ব্যবস্থা করে। ছবি নেপালি টাইমসের মাধ্যমে পাওয়া পিঙ্কি শ্রিশ রানার। অনুমতিক্রমে প্রকাশিত।
কিন্তু এখানে মাডি গ্রামে, গ্রামবাসীরা নিজ চোখে দেখেছে বন্যা প্রতিরোধে সরাসরি বাঁশ ব্যবহারের সুবিধা।
কৃষক ফদেন্দ্র ভট্টরাই বলেন :
যদিও নেপালে বর্ষায় ভারী বৃষ্টিপাত হয়, কিন্তু এ বছর নেপালে বন্যার প্রকোপ তুলনামূলক ভাবে কম ছিল। বাঁশ, বন্যায় পানি প্রবাহের ক্ষেত্রে এক বাধা হয়ে ছিল আর বন্যায় আমাদের শস্যকে নষ্ট হতে দেয়নি।
এই প্রচেষ্টা ও পরিক্ষিত বাঁশের ঝাড় সারা নেপালে প্রতিস্থাপন করা যেতে পারে ও এটা সারা নেপালে মূল্যবান হতে পারে। আর পশ্চিম নেপালের সমতল এলাকা কাঞ্চনপুরের কৃষকেরা বাঁশ গাছ, নেপিয়ার ও হাতি ঘাস (এলিফেন্ট গ্রাস) এমন এক নদীর তীরে রোপণ করছে যে নদীতে ২০১৮ সালে এক ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল।
নেপালের মধ্যাঞ্চলে ২০২৪ সালে যে বন্যা হয় তাতে ২২৪ জন নিহত হয়েছিল। কাভরে অঞ্চলের রসি ভ্যালি উপত্যকা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল আর পুরো হিমালয়ের পাদদেশের বসতি ভেসে গিয়েছিলো। তবে চারপাশে বাঁশের ঝাড় ছিল এমন এক এলাকায় তেমন কোন ক্ষতি হয়নি।
কাভরের ধনেশ্বর বাইকিওয়া সম্প্রদায়ের বনায়ন হচ্ছে ২০০৭ সালে সরকারের গ্রহণ করা এক প্রাথমিক প্রকল্প যে প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল মোসা বাঁশ নিয়ে পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা করা। এরপর ১৭ বছর পার হয়ে গেছে, আর দেশটির বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়-এর বন গবেষণা ও প্রশিক্ষণ বিভাগ এই প্রকল্পের কথা একেবারেই ভুলে গেছে।
সম্প্রদায়ের বন রক্ষক বদ্রি অধিকারি বলেন, যদিও বিশেষ করে এই জায়গা নিয়ে কোন গবেষণা করা হয়নি, তবে এটা ঠিক যে এই বাঁশের ঝাড় যা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত সেগুলো গ্রামগুলোকে রক্ষা করেছে, বাঁশের বিস্তৃত ও বিজড়িত শেকড় মাটিকে দৃঢ়ভাবে আটকে রেখে, ঢালের স্থায়িত্বকে রক্ষা করছে।
এই এলাকাকে হয়তো উপেক্ষা করা হয়েছে কিন্তু এর ইতিবাচক ফলকে উপেক্ষা করা যায় না। ভূমিক্ষয় ও বন্যা প্রতিরোধে লুম্বিনি প্রদেশের ১২ টি জেলায় বাঁশঝাড় স্থাপনের এক প্রচারণা গ্রহণ করা হয়েছে।
বাঁশ যে বন্যা থেকে এলাকাকে রক্ষা করতে পারে এটি নতুন ভাবে আবিস্কার করার বাইরেও বাঁশের অন্য অনেক ব্যবহার আছে। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে বিশ্বাস করা হয় যে বাঁশ ভূমিধ্বস রোধ করতে পারে আর যখন তারা এর সুবিধা দেখতে পেয়েছে তখন গ্রামবাসীদের আবার নষ্ট হয়ে যাওয়া বাঁশঝাড় নতুন করে গজিয়ে তোলার বিষয়টি অস্বাভাবিক কিছু নয়। বাদ্রি অধিকারি বলেন:
গরমকালে বাঁশগাছ ঊর্ধ্বমুখী হয় ও এর উচ্চতা বাড়তে থাকে অন্যদিকে শীতকালে এর শেকড় মাটির গভীরে প্রবেশ করতে থাকে। তারমানে শীতকাল হচ্ছে আগাম বর্ষার ক্ষতি প্রতিরোধের সঠিক সময়।