২০২৫ সালের মহা কুম্ভ মেলা (সাধুদের মিলন উৎসব) হচ্ছ ভারতের উত্তর প্রদেশের প্রয়াগরাজে ১৪৪ বছরে একবার অনুষ্ঠিত হওয়া ধর্মসভা, সেটা বিশাল আকৃতি ও সুযোগের জন্য সারা বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। তবে সাধু ও ভক্তরা যে রুদ্রাক্ষ (শুকনো বীজ) সামগ্রীর অধিকারী সেগুলোও বিশেষ মনোযোগ প্রদর্শন করেছে, আর হিন্দু ধর্মে সেগুলোর এক বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।
এ বছর রুদ্রাক্ষ এই উৎসবের আলোচনার কেন্দ্রে ছিল। রুদ্রাক্ষ বাবা নামের এক সাধু এবার ১১,০০০ রুদ্রাক্ষের মালা পরেছিলেন,যার ওজন ছিল ৩০ কিলোগ্রামের বেশী। হিন্দু দেবতা শিবের প্রতিনিধিত্ব করে সেই বারো জ্যোতির্লিঙ্গ সাত কোটি রুদ্রাক্ষ পুঁতি দিয়ে বানানো, আর সবিশেষে তুলে ধরা হল অন্যগুলোর মতই গুরুত্বপূর্ন ২১ বছর বয়সী রুদ্রাক্ষের মালা বিক্রি করা মোনালিসা ভোসলের কথা। এই মেলার সময় ডিজিটাল জগতে তিনি বিখ্যাত হয়ে যান রুদ্রাক্ষ নিয়ে হৃদয় হরণ করা ভিডিওর জন্য।

গৌরিশঙ্কর ফল। এক আলাদা ধরণের রুদ্রাক্ষ বীজ যেটাতে প্রাকৃতিক ভাবে দুটি বীজ একসাথে জোড়া লাগা আছে। ধর্ম মতে এই জোড়া লাগে ফলের বড় অংশটি হচ্ছেন দেবতা শিব আর ছোট অংশটি হচ্ছে তাঁর স্ত্রী পার্বতী। ফলের এই একসাথে জোড়া লেগে থাকা এক স্বর্গীয় মিলনের প্রতীক। বিশ্বাস করা হয় যে যিনি এই রুদ্রাক্ষ বীজ পড়বেন তাঁর ভবিষ্যত উজ্বল হবে । ছবি নিক্কি থাপার। অনুমতিক্রমে প্রকাশিত।
তাহলে, রুদ্রাক্ষ কেন হিন্দু ধর্মে এত পবিত্র আর কোথা থেকে আসে এই রুদ্রাক্ষ ? ধর্মে আছে রুদ্রাক্ষ বীজের জন্ম হয়েছে দেবতা শিবের অশ্রু থেকে, যিনি হিন্দু ধর্মের অন্যতম প্রধান দেবতা। এলেওকার্পাস গানিটুরাস নামের এক গাছের বীজ হচ্ছে রুদ্রাক্ষ, হিমালয় বিশেষ করে নেপালের হিমালয় এলাকার পাদদেশে এই গাছ প্রচুর পরিমাণে জন্মায়। এই রুদ্রাক্ষ বীজ হিন্দু ও বৌদ্ধরা সাধারণত তাঁদের প্রার্থনার সময় ব্যবহার করে, আর নেপালের রুদ্রাক্ষ বীজের মালার চাহিদা প্রচুর।
নেপালি অর্থবর্ষ ২০৮১ -২০৮২ পঞ্জিকার প্রথম পাঁচ মাসের হিসেবে (গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ২০২৪ জুলাই এর মাঝামাঝি থেকে ২০২৫ এর ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি) ৬৮৪,৯০৯ কেজি রুদ্রাক্ষ বীজ রপ্তানি করা হয়েছে, যার দাম প্রায় ৩৯,১৪৬, ০০ রূপি ( ২৮০, ১৯২ ডলার)। এর মধ্যে ২০৮,৯৬৬ কেজি চীনে ও ৪৭৫,৭৭৬ কেজি রুদ্রাক্ষ ভারতে রপ্তানি করা হয়েছে।
নেপালি ফটোগ্রাফার, গল্প কথক ও ‘আসক মি এবাউট নেপালের (নেপাল নিয়ে আমাকে প্রশ্ন করুন) ’ প্রতিষ্ঠাতা নিক্কি থাপা। তিনি রুদ্রাক্ষ বীজ সংগ্রহ ও এর বিপণন প্রক্রিয়া নথিবদ্ধ করার জন্য পূর্ব নেপালে ভ্রমণ করেছে।
পূর্ব নেপালের ভোজপুর এলাকার দিঙ্গলায় এক বাড়ির চারপাশে রুদ্রাক্ষ গাছের জঙ্গল। দিঙ্গলার প্রায় সব গ্রামবাসী এলাকার প্রচলিত ফসল ফলানো বাদ দিয়ে রুদ্রাক্ষ গাছের চাষ শুরু করেছে।
রুদ্রাক্ষ ফল পাড়তে হলে ডালকে একটা লম্বা লাঠি দিয়ে টেনে আনতে হয়। পূর্ব নেপালের ভোজপুর অঞ্চলের রামচে-এর এক ২৬ বছর বয়স্ক রুদ্রাক্ষ গাছ। নীচে এর ছবি তুলে ধরা হয়েছে। সেটার মালিক গোবিন্দ কোতয়াল।
ফল বা বীজ যাতে চ্যাপ্টা হয় সেজন্য গাছের মালিকেরা এতে ক্লাম বা স্ক্রু লাগিয়ে দেয়। চ্যাপ্টা আকারের রুদ্রাক্ষের চীনে বেশ চাহিদা রয়েছে. অন্যদিকে ভারতীয় ক্রেতারা ফলের আকার বদলে দেওয়া বীজ কিনতে চায় না, অথবা যে সমস্ত গাছ ওষুধ দেওয়া হয় সেগুলো নিতে চায় না। কারণ হিন্দুদের কাছে, রুদ্রাক্ষ হচ্ছে এক ধর্মীয় উপাদান।
রুদ্রাক্ষ বীজ সংগ্রহের জন্য চাষিরা এক কাঠের ব্লক বা কুকুরি বা ধারালো চাকু ব্যবহার করে। তারা খোলস চাকু দিয়ে খোলে, তারপর এর বীজ একটা চিরুনি দিয়ে ব্রাশ করে। এরপর এই বীজ বা পুঁথি তীব্র ভাবে পড়তে থাকা পানির ধারার নীচে পরিস্কার করা হয় এবং সবশেষে শুকানোর পর সেটাকে সুন্দর মসলিন কাপড় দিয়ে মুড়ে রাখা হয়।
নীচের ছবিতে বিক্রেতারা এক ছিদ্রযুক্ত পাত্র ব্যবহার করছে যাতে ২০ মিলিমিটারের কম বীজগুলোকে আলাদা করা যায়। চীনা ক্রেতারা বড় আকারের বীজ পছন্দ করে, ছোট আকারের বীজ ভারতের বাজারের জন্য আলাদা করা হবে, অথবা রুদ্রাক্ষ দিয়ে বানানো বিভিন্ন ধরণের পণ্য যেমন মালা, ব্যাগ, ফুলদানি ও চেয়ারের কভার সহ অন্য পণ্য তৈরির জন্য আলাদা করা হবে।
নীচের ছবিতে পূর্ব নেপালের খন্ডবাড়ির শঙ্খসভার এক কর্মী এক ১৪ মুখি রুদ্রাক্ষ ভার্নিয়ার স্কেল দিয়ে মেপে দেখছে। সে সমস্ত রুদ্রাক্ষে এক দুই বা ২১ টি মুখি থাকে সেগুলোকে খুব দুর্লভ মুখি বিবেচনা করা হয় আর সে কারণে সেগুলো মুল্যবান। চার, পাঁচ, ছয় ও সাত মুখি বীজ খুব সাধারণ। একটি গাছে বিভিন্ন ধরনের বীজ পাওয়া, একটি বীজে প্রায় ২৩ রকমের ভিন্ন ভিন্ন মুখি থাকতে পারে।