পশ্চিম আফ্রিকায় ভালোবাসা দিবসে উপহারের গোপন মূল্য

হৃদয় আকৃতির তৈরি করা চকলেট ধরে থাকা এক ব্যক্তি। ছবি আরডিএন স্টক প্রজেক্ট-এর যা পিক্সেল এর থেকে নেওয়া (ব্যবহার-এর ক্ষেত্রে কোন বিধি নিষেধ নেই)।

বেজাউইট মেকোননেন এর লেখা

চকলেট ছাড়া বিশ্ব কল্পনা করাই অসম্ভব। বিশেষ করে ভ্যালেন্টাইন ডে বা ভালোবাসা দিবসে, সেদিন স্থানীয় বিপনী বিতানে এর সুন্দর করে সাজানো বাক্স থাকবে, এর মধ্যে অনেক চকলেটের বাক্সে লেখা আছে এগুলো পশ্চিম আফ্রিকার পণ্য। তবে পশ্চিম আফ্রিকায় জলবায়ু পরিবর্তন, বন উজাড় ও সমুদ্র সীমার উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে এই শিল্প দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে-এই বিষয়টি বিবেচনা করে কীভাবে এই ভালবাসা দিবস নামের ছুটির দিনের বাণিজ্যকিকরণ ঘটছে-যেদিন সারা বিশ্বে চকলেট, গোলাপ ও রোমান্টিক সব জিনিস বিক্রি হয়- সেই দিবস কতটা বিবর্তিত হয়েছে।

তবে এই অতি পরিচিত ও আলাদা বাদামী মিষ্টি স্বাদের খাবার চকলেট এর প্রদর্শন যা ভালবাসা দিবস-এর এক অনিবার্য উপহার সেটা হয়তো সব সময় আর এর অংশ আর থাকবে না। এটা ভাবতে খুবই ভয়ংকর শোনাতে পারে যে আগামী ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে পৃথিবীতে চকলেট খুব দামী এক বিলাসী পণ্যে পরিণত হবে –অথবা এমনও হতে পারে এই পণ্য পৃথিবী থেকে একেবারে উধাও হয়ে যেতে পারে।

কোকো উৎপাদন

চকলেট তৈরির প্রধান উপাদান কোকো বীজ। এই বীজ জন্মাতে উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ার প্রয়োজন হয়, একই সাথে এই গাছের বেড়ে ওঠার জন্য প্রচুর বৃষ্টি ও ছায়া দুটোরই প্রয়োজন হয়। মিলকা ও ক্যাডবেরির মতো চকলেট ব্রান্ড কোম্পানি এক সতর্ক ঘন্টা বাজিয়ে চলেছে, আর সেটা হলো এই যে আগামী ৩০ বছরের মধ্যে বিশ্বের ৬০ শতাংশ কোকো উৎপাদনকারী অঞ্চল যেমন আইভরি কোস্ট ও ঘানার ভূমি কোকো চাষের অনুপযুক্ত হয়ে পড়বে।

বিশ্বে কোকো উৎপাদন ও রপ্তানীতে শীর্ষে রয়েছে আইভরি কোস্ট। ২০১৯ সালে দেশটির কোকো ও কোকোজাত পণ্য রফতানীর পরিমাণ ছিল প্রায় ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

পশ্চিম আফ্রিকার প্রায় ২০ লক্ষ চাষী এই কোকোর উপর নির্ভরশীল। তবে বিগত দশকে ক্রান্তিয় আর্দ্র বনাঞ্চলে এ কোকো চাষ এক গভীর সমস্যায় পড়েছে।

কোকো চাষের জন্য অনেক দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়। বছরে একটা পূর্ণ বয়স্ক কোকো গাছ থেকে মাত্র ২০০ গ্রাম চকলেট পাওয়া পায়। তাঁর মানে প্রতিটি কোকো গাছ থেকে বছরে দুটি চকলেট বার তৈরির মত কোকো পাওয়া যায়। গাছ যত বুড়ো হয় তত তাঁর ফলন কমে আসে। আর বিশ্বের বেশীর ভাগ কোকো চাষের জমিতে যে সব কোকো গাছ রয়েছে সেগুলো তাঁদের সেরা সময় পার করে এসেছে, অন্যদিকে সারা বিশ্বে কোকোর চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। তবে চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বাড়ছে না। ভ্যালেন্টাইন দিবসে যে সপ্তাহে পালিত হয় সেই সপ্তাহে কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকেরা প্রায় ২৬ মিলিয়ন কিলো চকলেট খায়। বিশ্বের সবচেয়ে বড় কোকো আমদানীকারক মহাদেশ ইউরোপ ২০২৩ সালে ১.৬ বিলিয়ান কিলোগ্রাম কোকো বীজ আমদানি করে, যার সবচেয়ে বড় অংশ আসে আইভরি কোস্ট থেকে, এর পরে রয়েছে ঘানা, নাইজেরিয়া ও ক্যামেরুন ।

কোকোর এই চাহিদা পূরণ করার জন্য একই জমিকে বার বার ব্যবহার করার বদলে কোকো চাষিরা নতুন কোকো গাছ লাগানোর জন্য ক্রান্তীয় বন উজাড় করে ফেলছে। এই চাষ পদ্ধতি পশ্চিম আফ্রিকায় বন উজাড়ের অন্যতম কারণ বিশেষ করে আইভরি কোস্টে। বিশেষজ্ঞদের মতে দেশটিতে অবৈধ ভাবে ৭০ শতাংশ বন উজাড়ের কারণ হচ্ছে এই কোকো চাষ।

ট্রাসে, যারা পরিবেশের প্রতি নজর রাখে, সেই সংস্থার মতে গত দুই দশকে আইভরি কোস্ট তার ক্রান্তীয় আর্দ্র বনাঞ্চলের ৪৫ শতাংশ হারিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করলে দেখা যাবে আইভরি কোস্ট বছরে প্রায় নিউ ইয়র্ক শহরের সমপরিমাণ বনাঞ্চল হারাচ্ছে।

বিগত ৬০ বছরে আইভরি কোস্ট ও গঘানা যে পরিমাণ বন হারিয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন এর থেকে নেওয়া স্ক্রিনশট। ফেয়ার ইউজ।

আইভরি কোস্ট নামকরণের পেছনে র‍য়েছে হাতি, সেখানে এক সময় অজস্র হাতির বিচরণের কারণে সহজে হাজার হাজার হাতির দাত পাওয়া যেত। এক সময় হাজার হাজার হাতির বিচরণে মুখরিত দেশটিতে বন উজাড়ের ফলে বসবাসের পরিবেশ নষ্ট হয় যাওয়ায় সেখানে এখন মাত্র কয়েকশ হাতি টিকে আছে।  

এই পরিবেশগত জটিলতাকে আরো জটিল করেছে এর সাথে যুক্ত আর্থ সামাজিক বাস্তবতা যেমন কোকো চাষে শিশু শ্রম-এর ব্যবহার ও প্রচণ্ড আয় বৈষম্য । পশ্চিম আফ্রিকার বেশির ভাগ কোকো চাষের এলাকায় প্রতিদিন যেখানে পুরুষ শ্রমিকদের গড় আয় সামান্য এক ডলারের কম, সেখানে মেয়েদের আয় ৩৩ সেন্ট কারণ কোকোর দাম সাম্প্রতিক সময়ে একেবারে কমে গেছে। যার ফলে কোকো চাষিরা এতটাই গরীব হয়ে গেছে যে তারা আর চাষের জমির মান উন্নত করতে পারছে না, যে সমস্ত দেশে কোকো চাষ হয় সেখানে শিশু শ্রম এক অনিবার্য বিষয়। এখানে পরিবারগুলো প্রায়শ তাদের সন্তানদের শ্রমের নির্ভর করে শ্রমের মজুরি অনেক বেশী হওয়ার কারণে। ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগোর এনওআরসি এর করা ২০২১ এর এক রিপোর্ট তুলে ধরেছে যে ঘানা ও আইভরি কোস্টের এই কোকো শিল্পের ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে প্রায় ১৬ লাখ শিশু নিযুক্ত রয়েছে-যাদের কাজের মধ্যে রয়েছে ভারী জিনিস বহন করা, গাছ থেকে কোকো ফল নামানোর জন্য গাছে চড়া, কোকো ফল পাড়ার জন্য ধারালো হাতিয়ার ব্যবহার করা।

এটা একটা জটিল বৈশ্বিক ভ্যালু চেইন যা অস্থিরতার ও বাড়তে থাকা জলবায়ুর নাজুক অবস্থার বিনিময়ে পাওয়া। আইভরি কোস্টে এই সমস্যার গভীরতা অনুসন্ধান করার জন্য গ্লোবাল ভয়েসেস জ্যা প্ল আকার সাথে বসে আলাপচারিতা করে। আইভরি কোস্টের ইউএনডিপির এনভায়ারমেন্ট, সাসটেইনবেল এন্ড ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্টের দলের সে প্রধান।

আকা নিজে স্বয়ং কোকো চাষের কঠিন বাস্তবতা কেমন তা জানেন। খরা ও পরিবেশগত চাপের কারণে অন্য অনেকের মতো তাঁর পিতা স্বয়ং কোক চাষের জমি হারিয়েছেন। খরার কারণে এই সম্প্রদায় যে স্মৃতিচারণ তা এক গভীর ভাবনার বর্ণনা । তিনি বললেন :

চাষীরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম একই জমিতে কোকো চাষ করে গেছে আর বুড়ো হয়ে যাওয়া কোকো গাছ কেটে ফেলতে তাঁদের ভীষণ কষ্ট লাগে। তারা পরবর্তী বছর ভালো ফসলের আশায় থাকে।

পরিহাসের বিষয় হচ্ছে বিশ্বে যখন কোকর দাম তিনগুণ বেড়েছে, সেখানে স্থানীয় ভাবে কোকো উৎপাদন কমে গেছে।

ভবিষ্যতে এক আশা আছে

সরকারি ও বেসরকারি খাতের সাথে ইউনাইটেড নেশন ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম-এর মাধ্যমে অংশীদারিত্বের এক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে যারা কোকো চাষিদের আশাকে আবার জাগিয়ে তোলার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। যেমন আইভরি কোস্ট ও ঘানায় বন উজাড় করার বিরুদ্ধে সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা ও জৈববৈচিত্রকে আবার তুল ধরা, এক সুন্দর জীব বৈচিত্র নিশ্চিত করেছে আর জঙ্গল বৈচিত্র্য করা কেন দরকার নেই সেটা তুলে ধরছে স্কালা প্রোগ্রামের মাধ্যমে ইউএনডিপি এক গ্রহণযোগ্য জঙ্গলকৃষির ল্যান্ডস্কেপ বা অবয়বে মনোযোগ প্রদান করেছে।

আকা এই বিশয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে যে যখন এই সকল পদক্ষেপ সম্ভাবনা ময়, তবে আরও অনেক কিছু করার আছে। তিনি ব্যাখ্যা করেন :

আমাদের সহযোগিতার জন্য যন্ত্রপাতি প্রয়োজন যাতে তারা রপ্তানির আগে কোকো বীজকে চূর্ণ করতে পারে ও ভাজতে পারে।

আইভরি কোস্ট বিশ্বের প্রায় ৬০ শতাংশ কোকো রপ্তানি করে এই বিষয়টিকে মাথায় রেখে প্রশ্ন করা যায় কেন দেশটি বিশ্ব চকলেটের বাজারের এক অন্যতম রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারেনি? আকা ব্যাখ্যা করেছেন:

চকলোট তৈরির ক্ষেত্রে আইভরি কোস্টের অনেক সীমাবদ্ধতা র‍য়েছে। বড় বড় ব্রান্ড গুলো চকলেটের বাজার দখল করে রেখেছে । যার ফলে নতুন কোন প্রতিষ্ঠানের পক্ষে বাজারে প্রবেশ করা কঠিন।

অন্য অনেক শিল্প যেমন বাদামের মাখন উৎপাদন প্রক্রিয়া তেমনি কোকো উৎপাদনে দেশটিতে বিশাল পরিমাণে কোক প্রক্রিয়াজাত করতে হবে যা দেশটির পক্ষে এখনো অসম্ভব- তবে এর প্রাথমিক প্রক্রিয়া যেমন কোকো বীজ চূর্ণ করা ও ভাজার পদ্ধতি তুলনামুলক ভাবে সহজ। কোকো বীজ সংগ্রহ করা থেকে চকলেট পর্যন্ত এর যে যাত্রা আকা সেটি তুলে ধরেছে। :

বহুজাতিক কোম্পানিগুলো আইভরি কোস্ট থেকে অপরিশোধিত কোকো কেনে। এরপর সেগুলোকে প্রক্রিয়াজাত করার জন্য ইউরোপ বা আমেরিকায় পাঠানো হয় ( যেমন কোকবীজ চূর্ণ করা ও ভাজা) এরপর সেগুলো প্রধান চকলেট কোম্পানি যেমন ফেরেরো লিন্ডিট ও নেসলের কাছে বিক্রি করা হয় । এই সকল কোম্পানি বাজারে তাদের যে নিয়ন্ত্রণ আছে সেটা ছাড়তে নারাজ, যা স্থানীয় চকলেট শিল্প গড়ে তোলার পথে বিশেষ ভাবে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে।

তিনি দৃঢ়ভাবে বলেন, এটার অবশ্যই পরিবর্তন দরকার।

যদি ৫০ শৎতাংশ কোকো স্থানীয় ভাবে পক্রিয়াজাত হত, তাহলে হাজার হাজার চাকুরির সুযোগ তৈরি হত, চাষীদের আয় বেড়ে যেতো ,আর দারিদ্রতা কমে যেত।

যখন আইভরি কোস্ট তার কোকো বীজ প্রক্রিয়াজাত কর দক্ষতা বাড়াচ্ছে, সেই প্রেক্ষাপটে হয়তো খুব দ্রুতই দেখা যাবে যে চকলেট এর গায়ে লেখা থাকবে আইভরি কোস্টের-এর তৈরি, খুব শীঘ্রই কি? তিনি হাসলেন ও উল্লেখ করলেন :

আগামী পাঁচ থেকে দশ বছরে সেটা সম্ভব, আফ্রিকা এত দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে যার ফলে এখনকার চকলেট পাওয়া যাবে না এমনটা হওয়ার সম্ভাবনা কম! আর এর প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে স্থানীয় পর্যায়ে কোকো বীজ এর প্রক্রিয়াজাতকরণ আর এমনটা সম্ভব যে এটা রপ্তানি যোগ্য মানের হবে, স্থানীয় ভাবে উৎপাদিত চকলেট। ইতোমধ্যে আমাদের এখানে যারা চকলেট বানায় তাঁদের আনাগোনা শুরু হয়েছে, তার মানে আগামীতে আফ্রিকার চকলেট বাজারে আসছে।

আলোচনার এটাই ছিল সবচেয়ে উত্তেজক অংশ-এমন এক ভবিষ্যৎ কল্পনা করুন, যেখানে পশ্চিম আফ্রিকার চকলেট বিশ্ব বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে, কিন্তু এটাও অর্জন করার জন্য অর্থনৈতিক নীতিতে এক গভীর পরিবর্তন দরকার ও কোকো ভ্যালু চেইনে আন্তর্জাতিক প্রভাব কমানো দরকার। .

যদিও এর ভবিষ্যৎ অন্ধকারচ্ছন্ন বলেই মনে হয় তবে এর চিন্তাগত পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এক অবিশ্বাস্য সম্ভাবনা রয়েছে। সঠিক নীতি ও বিনিয়োগের পশ্চিম আফ্রিকায় সম্ভাবনা রয়েছে গ্রহণযোগ্য, পরিবেশ বান্ধব- ও অর্থনৈতিক ভাবে নিজস্ব এক শিল্প হিসেবে এই শিল্পের গড়ে ওঠার। যেমনটা আকা উল্লেখ করেন, আইভরি কোস্ট ও এই অঞ্চলের অন্য অনেক কোকো চাষের এলাকার ভবিষ্যত নির্ভর করছে আগামী বছরের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও বৈশ্বিক বিনিয়োগের উপর।

বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় গল্পগুলো

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .