
“ভারতের খাসিয়া সম্প্রদায়ের ভাষায় মনোলিথকে (প্রাকৃতিক ভাবে তৈরি বড় আকারের পাথর বা স্তম্ভ) “মাওবেইয়ান্না” বলে ডাকা হয়। এই সকল স্মারক স্তম্ভ তৈরি করা হয়েছিল পূরর্বপুরুষদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে। ছবি অর্পিতা দাস চৌধুরীর। অনুমতিক্রমে প্রকাশ করা হয়েছে।
ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের এক আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল মেঘালয়, যেখানে মূলত তিন ধরনের আদিবাসীর বাস, এরা হচ্ছে খাসিয়া, জৈন্তিয়া, এবং গারো। এখানকার পূর্ব ও পশ্চিম খাসিয়া পাহাড়ে খাসিয়া, জৈন্তিয়া পাহাড়ে জৈন্তিয়া ও গারো পাহাড়ে গারোদের বাস। মেঘালয়ের এই সকল আদিবাসীদের এক আলাদা মাতৃতান্ত্রিক সমাজ রয়েছে যেখানে বংশধারাকে মাতৃতন্ত্র বা মায়ের আত্মীয়দের বা মাতৃকুলের সাথে যুক্ত করে চিহ্নিত করা হয়।
মেঘালয়ের পশ্চিম জৈন্তিয়া পাহাড়ে জৈন্তিয়া বা পানারদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে যারা খাসিয়া সম্প্রদায়ের একটি শাখা, যদিও জৈন্তিয়া আদিবাসী খাসিয়া সম্প্রদায়ের একটি অংশ তবে তারা পানার নামে এক আলাদা ভাষায় কথা বলে।
খাসিয়ারা মেঘালয়ের সবচেয়ে বড় আদিবাসী জনগোষ্ঠী, এর পরে রয়েছে গারো ও জৈন্তিয়ারা। খাসিয়া ও জৈন্তিয়া সম্প্রদায় হাইন্নেইয়ে ত্রেপ আদিবাসী গোত্রের এক অংশ খাসিয়া ভাষায় যার মানে হচ্ছে “সাতটি কুটির”।
জৈন্তিয়া আদিবাসী সম্প্রদায় “পানর” “ওয়ার” ও “ভোই” নামের আলাদা গোত্র নিয়ে গঠিত, যাদের সম্মিলিত ভাবে জৈন্তিয়া বলে ডাকা হয়। খাসিয়া আদিবাসীদের সাথে কিছু সাংস্কৃতিক মিল থাকা সত্বেও জৈন্তিয়াদের সুস্পষ্ট ভাবে কিছু ভিন্ন ঐতিহ্য ও প্রথা রয়েছে এবং তারা বংশগত ভাবে মাতৃতন্ত্রকে অনুসরণ করে।
৫০০ অব্দে জৈন্তাপুর এর নাগরিকেরা ছিল জৈন্তিয়া সাম্রাজ্যর অংশ যা বর্তমান বাংলাদেশের সিলেট জেলার সমতল অংশ থেকে ভারতের মেঘালয়ের পাহাড়ি অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল-যা প্রাচীন সমতল সিলেট এবনং পাহাড়ে সুতনগা সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। হিন্দু সাহিত্য অনুসারে এই রাজ্যের শাসক ছিল নারীরা, আর এখানে জৈন্তা দেবী নামে এক দেবীর এক বিখ্যাত মন্দির ছিল, প্রাচীন ভারতীয় মহাকাব্য মহাভারতে যার উল্লেখ রয়েছে।

প্রায় ১৫০০ খিস্টাব্দে মেগালেথিক স্তম্ভগুলো গড়ে তোলা হয়। স্থানীয় পেনার ভাষায় যাকে বলা হয় “ইউ মাওথাও দূর ব্রিয়ে” । ছবি অর্পিতা দাস চৌধুরীর তোলা। অনুমতিক্রমে প্রকাশিত।
নারতিয়ানং গ্রাম, যার অবস্থান পশ্চিম জৈন্তিয়া পাহাড়ের শান্ত কোলে, এর আবহাওয়া শীতল। লো মুলাং এলাকার জৈন্তাপুর রাজ্যের রাজারা একসময় একে গ্রীস্মকালীন রাজধানী হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। এখানকার রাজাদের সিংহাসনের সম্মানে ১৫০০ খ্রিস্টাব্দ এই অঞ্চলে অজস্র মনোলিথ স্তম্ভ গড়ে তোলা হয়, যা জৈন্তিয়া রাজাদের প্রতীক।
এখন, স্থানীয় খাসিয়া রমণী ও পুরুষেরা নিয়মিত নারাতিয়াং মাওবিয়াইয়ান্নে এর যত্ন নিতে ও বিনোদনের জন্য এখানে আসে।

পুরো নারতিয়ানং এ মেগালেথিক এই সকল স্তম্ভ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ল মুলাং হচ্ছে এই অঞ্চলের এ ধরণের এ সবচেয়ে বড় এলাকা। ছবি অর্পিতা দাস চৌধুরীর। অনুমতিক্রমে প্রকাশ করা হয়েছে।
১৯ শতকের শুরুতে যখন ভারতে ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসন শুরু হয় এবনং খাসিয়া সম্প্রদায়ের নাগরিকেরা যখন খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করা শুরু হয় তাঁর পুর্ব পর্যন্ত জৈন্তিয়া সম্প্রদায় বেশীর ভাগ নাগরিক হিন্দু ধর্মের অনুসারী ছিল। তাঁরা এমন এক ভিন্ন ধর্ম অনুসরণ করত যার নাম নিয়ামত্ররে, হিন্দু ধর্মের সাথে যার অনেক মিল ছিল।
মেঘালয়ের ইতিহাসবিদদের মতে জৈন্তিয়া গোত্র থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া সদস্যদের নৈমাত্রে প্রথা অনুসারে এক সারিতে দাহ করা হয় ও তাঁদের ছাইগুলোকে খাড়াভাবে দাঁড়িয়ে থাকা পাথরের নীচে রাখা হয় যা একটা মাত্র পাথরের টুকরো দিয়ে বানানো হয়। এই সকল বিশাল পাথরের স্তম্ভ এখন পর্যন্ত সংরক্ষিত রয়েছে। এগুলো নারতিয়াং এর মনোলিথ নামে পরিচিত, যা এখন এই এলাকার এক সংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক অঞ্চল ।

ল মুলং এর দুই গ্রামের গ্রামবাসী ও নারতিয়াং এলাকার পুরো অঞ্চল নিয়মিত ভাবে এই মনোলিথিক বাগান পরিষ্কার করে ও এর নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ও তারা এই এলাকায় অনৈতিক বা আইন বহির্ভূত কাজ প্রতিরোধ করে।ছবি অর্পিতা দাস চৌধুরীর। অনুমতিক্রমে প্রকাশ করা হয়েছে।
খাসি জৈন্তাইয়া পাহাড় অজস্র মেগালিথিক পাথরস্তম্ভের আবাসভূমি। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই সকল পাথার পাওয়া যায় এখনকার জোয়াই, চেরাপুঞ্জি, লাইলুনঙ্গকোট ও মাফলং গ্রামে।
তবে মেঘালয়ের সবচেয়ে লম্বা মনোলিথিক পাথর নিয়ে দাড়িয়ে আছে নারতিয়ানং মনোলিথ গার্ডেন এবং এটি এ অঞ্চলের সবচেয়ে ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ এলাকা । ঐতিহাসিক রেকর্ড সময় অনুসারে এই সকল কোন কোন পাথরের বয়স ৫০০ বছরের বেশী, আর এর সাথে কিছু পাথর বসানো হয়েছে ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত। নারাতিয়াং মনোলিথ গার্ডেন হচ্ছে এ রকম এমন এক জায়গা যেখানে এক সাথে এ রকম একটি একক এলাকার সবচেয়ে বিশাল আকারের পাথরের সবচেয়ে বড় সংগ্রহশালা, যার মধ্যে সবচেয়ে লম্বা মনোলিথ পাথর প্রায় ২৬ ফুট লম্বা।

বেশীর ভাগ মাওবেইয়ান্নে হচ্ছে জৈন্তিয়া রাজ্যের অংশ , যা দাহ করার পুরোপুরি এক রাজকীয় প্রথা। হাইন্নেইয়াট্রেপ সম্প্রদায় এই প্রথার অনুশীলন করতো যা মাওনিয়াম নামে পরিচিত। রাজকীয় সামরিক বাহিনীর সাফল্যের স্মরণে এরকম বেশ কিছু পাথর স্থাপন করা হয়েছে। ছবি অর্পিতা দাস চৌধুরীর। অনুমতিক্রমে প্রকাশ করা হয়েছে।
যদিও ব্রিটিশ উপনিবেশক শাসনামলে জৈন্তিয়া রাজ্যের পতন ঘটে, তারপরেও জৈন্তিয়া সমাজের মাঝে এই সকল মনোলিথ তাদের সংস্কৃতিক গুরুত্ব ধরে রেখেছে। জৈন্তিয়া গোত্রের মাঝে এই সকল মনোলিথ তাঁদের “স্মৃতির” প্রতীক।

মাওয়াইয়বান্নেতে খাড়া ভাবে রাখা পাথরকে খাসিয়া ভাষায় বলে ‘মাওশাইনারানাং’ আর পানার ভাষায় বলা হয় মো শায়নারাং, আবার সমান আকৃতির পাথর এর নাম ‘মাওকাইনেতথি’ অথবা ‘মো কাইনেতথাই’ যা কিনা নারীত্বকে প্রতিনিধিত্ব করে। ছবি অর্পিতা দাস চৌধুরীর। অনুমতিক্রমে প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রতিটি মনোলিথ দুটি আলাদা ভাগে বিভক্ত: খাড়া ভাবে রাখা পাথর যাকে ‘কি মো শেয়ইনরানং; বা মেনহির নামে উল্লেখ করা হয় যা ছেলে পূর্বপুরুষেরদের,অন্যদিকে আড়াআড়ি ভাবে রাখা নারী পুর্বপুরুষদেরকে উল্লেখ করে, যাকে ‘কি মো কিয়ান্তথি’ বা ডলমেন নামে ডাকা হয়। .
নারতিয়ানং মনোলিথ গার্ডেন এর প্রবেশপথে একটা সাইনবোর্ড আছে যা এই এলাকাটা সম্বন্ধে তথ্য প্রদান করে। সবচেয়ে লম্বা মেনহির ‘মো লং সাইজেম’ নামে পরিচিত, যেটি আট মিটার লম্বা ও ১৮ ইঞ্চি পুরু। জৈন্তিয়া প্রবাদ অনুসারে বিশাল আকৃতির ‘মার ফালানঙ্গাকি’ এই পাথর স্থাপন করেছিলেন। বাগানে রাখা বিভিন্ন মনোলিথ ৮৩৫ থেকে ১৫০০ খিস্টাব্দে স্থাপন করেছিল জৈন্তিয়ার বিভিন্ন গোত্র যার মধ্যে নারতিয়ানং গ্রামের ‘ইউ লুহ লিয়াননংসক লামারে’ এবং ‘ইউ মার মার ফালাংগাকি’ উল্লেখযোগ্য ।

‘মো শায়নারানং’ অথবা মেনহির আর ‘মো কিয়ান্তথাই’ অথবা ডলমেন মেঘালয়ের আলোচিত প্রতীকে পরিণত হয়েছে, যা প্রখ্যাত সব সরকারি ভবন ও স্থাপনায় এগুলোর রেপ্লিকা বা প্রতিরূপ উন্মুক্ত বা সুস্পশষ্টভাবে প্রদর্শনীর জন্য রাখা হচ্ছে। ছবি অর্পিতা দাস চৌধুরীর। অনুমতিক্রমে প্রকাশ করা হয়েছে।

ফ্ল্যাট বা চওড়া টেবিল-এর মত পাথর অথবা ডলমেন ছোট ছোট পাথরের উপরে রাখা আছে যেগুলোকে বলা হয় মাওয়াকহুরুম। এগুলোকে সন্তান অথবা নাতি-নাতনি হিসেবে দেখা হয়, যা কিনা একটা পরিবারের প্রতিনিধিত্ব করে। ছবি অর্পিতা দাস চৌধুরীর। অনুমতিক্রমে প্রকাশ করা হয়েছে।

এক তৃতীয়াংশ মনোলিথ স্মৃতিস্তম্ভ বা ‘মো টেইলিয়ান’ নামে পরিচিত সেগুলো ছোট ছোট পাথরের স্তূপ আকারে সজ্জিত। সেগুলো বিশেষ স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। ছবি অর্পিতা দাস চৌধুরীর। অনুমতিক্রমে প্রকাশ করা হয়েছে।
লোকগাথা অনুসার নারতিয়ানং–এ কাছে কোথাও বাজার ছিল না, যার সবচেয়ে কাছেরটি ছিল রালিনং-এ। বৃষ্টি হচ্ছিল এমন এক বাজারের দিনে জৈন্তিয়ার এক বিশাল আকৃতির একজন ফালিয়ানংকি আশ্রয়ের খোঁজে আসে এবং রালিয়ানং প্রধানের সবচেয়ে ছোট কন্যার কাছে এসে ছাতা চায়। ছোট মেয়েটি তাঁকে ছাতা দিতে অস্বীকার করে ও বাজার থেকে একটা পাথর তুলে আনার চ্যালেঞ্জ জানায়। এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে মার ফালিয়াকিনং নারতিয়ানং-এর কাছের এক বনে পাথরটি নিয়ে আসে এবং বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পর সেখানে স্থাপন করে।

লম্বা মেনহির যা নারতিয়ানং এ দেখা যায় সেগুলো এই সম্প্রদায়ের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের স্মরণে গড়া প্রতীক। এই সকল বিশাল ও লম্বা মনোলিথগুলো মেগালিথ হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে। ছবি অর্পিতা দাস চৌধুরীর। অনুমতিক্রমে প্রকাশ করা হয়েছে।
এই সকল মেগালিথ পাথর-এর কথা ১৯ শতকের সাহিত্যে উল্লেখ রয়েছে, যেখানে পাহাড়ের বাসিন্দারা এগুলোর স্থাপনের উদ্দেশ্যেকে ভিন্ন ভাবে উপস্থাপন করেছে। উপনিবেশিক সমইয়ের নৃত্তাবতিক পাঠ্যের সাথে তুলনা করে দেখা যায় যে এই সকল পাথুরে স্তম্ভ বেশ জোরালো ভাবে ধর্মীয় গুরুত্ব তুলে ধরছে সাথে জৈন্তিয়া গোত্রের রাজনৈতিক ও সামাজিক কার্যক্রম পরিচালনা করেছে।
যদিও নারতিয়ানং এর মনোলিথ পাথর প্রাকৃতিক নয়, তবে এগুলো মাতৃতান্ত্রিক সম্পর্ক, কতৃত্ব ও ক্ষমতার কাহিনী তুলে ধরার ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে, যা এক সময় ছিল এক সমৃদ্ধ রাজ্য ।