
রোহিঙ্গা অধিকারের সহকর্মী-সমর্থকদের সাথে নূর আজিজা (বাম থেকে দ্বিতীয়)। নূর আজিজার ছবি। অনুমতিসহ ব্যবহৃত
মিয়ানমারে ১৯৯৫ সালে জন্ম নেওয়া নূর আজিজা মালয়েশিয়ায় আট বছর কাটিয়ে ২০০৩ সালে অস্ট্রেলিয়ায় আশ্রয় লাভ করেন। তিনি কয়েক দশক ধরে বৈষম্যের শিকার ও নাগরিকত্ব অস্বীকৃত মিয়ানমারের একটি মুসলমান সংখ্যালঘু গোষ্ঠী রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের সদস্য। জাতিসংঘের হিসেবে এখন পর্যন্ত দশ লক্ষেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসেছে। তাদেরকে বিশ্বের বৃহত্তম রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠী বিবেচনা করা হয়।
গ্লোবাল ভয়েসেসের সাথে এক সাক্ষাৎকারে নূর আজিজা শরণার্থী হিসেবে তার অভিজ্ঞতা এবং অস্ট্রেলিয়া ছাড়াও জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে রোহিঙ্গা অধিকারের একজন বিশিষ্ট সমর্থক হয়ে ওঠার গল্প ভাগাভাগি করেছেন।
‘পিছনে পড়ে থাকার চেয়ে ভয়ঙ্কর সমুদ্রকেও নিরাপদ মনে হয়েছে’
নূর আজিজা মিয়ানমার থেকে তার পরিবারের পালানোর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন।
আমি তখন শিশু হলেও বেশিরভাগ বাস্তুচ্যুত মানুষের অনুভব করতে পারা তীব্র সহিংসতা থেকে পালিয়ে আসা এই যাত্রাটিতে ভয়ঙ্কর সমুদ্রকেও নিরাপদ মনে হয়েছে।
পথের সকল কষ্ট সহ্য করে আমরা পায়ে হেঁটে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করি। ঘন জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতাম, আমাদের নিরাপদে নিয়ে যাওয়ার মতো কোনো নৌকার সাহায্য খুঁজতাম। মালয়েশিয়ার সাবাহতে পৌঁছানোর পূর্ব পর্যন্ত আমরা স্থানীয় বাসের উপর নির্ভর করে ও অপরিচিত দয়ালুদের কাছ থেকে সাহায্য চেয়ে খাবারগুলো খেয়েছিলাম।
কিন্তু অবৈধ অভিবাসী বিবেচিত হওয়ায় মালয়েশিয়াতেও তারা কষ্টের মুখোমুখি হয়। তারা আট বছর দারিদ্র্য, বৈষম্য ও পুলিশি ভয়ভীতি সহ্য করে। ২০০৩ সালে অস্ট্রেলিয়াতে তাদের আশ্রয় দেওয়া হয়।
কানাডা, নিউজিল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে পুনর্বাসিত আট রোহিঙ্গা নারীর সাথে, নূর আজিজা মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কে শিক্ষা, মানবিক সহায়তা এবং মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা প্রদান করা লক্ষ্যে রোহিঙ্গা মাইয়াফুইনর সহযোগী নেটওয়ার্ক (আরএমসিএন) প্রতিষ্ঠা করেন।
আরএমসিএন সীমান্ত অতিক্রমকারী ও এশীয় সরকারগুলির অপর্যাপ্ত সহযোগিতার ফলে সাহায্য প্রয়োজন এমন রোহিঙ্গা পরিবারের জীবন রক্ষাকারী মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে। লক্ষ্য পূরণের জন্যে নূর আজিজার দলকে শরণার্থী সম্প্রদায়ের মধ্যে আস্থা তৈরিসহ অনেক চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে হয়েছে।
মুখোমুখি হওয়া আমাদের প্রধান চ্যালেঞ্জগুলির একটি হলো গভীর বিশ্বাসের অভাব ও বাস্তুচ্যুতিতে সৃষ্ট বিচ্ছিন্নতাবোধ। বছরের পর বছর ধরে নিপীড়ন ও মাতৃভূমি থেকে বিচ্ছিন্নতার কারণে আমরাসহ অনেক রোহিঙ্গা জনগণ অসুস্থ হয়ে পড়েছি। শরণার্থী হিসেবে আমরা প্রায়শই প্রান্তিক হয়ে পড়ি এবং আমরা সবাই যে মানসিক আঘাতের সম্মুখীন হয়েছি তার কারণে নিজেদের জন্যে ঐক্যবদ্ধ হতে বা নিজেদের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে বহিরাগত ও কখনো কখনো আমাদের নিজ সম্প্রদায় থেকেও বাধা পাই।
Today, we stand in solidarity with Noor Azizah, a young Rohingya woman activist who has made it her mission to fight for the rights of her community ✊🏾
Noor’s journey has been one of overcoming unimaginable adversity. Forced into displacement, she has become a leading advocate… pic.twitter.com/s4hGfYidQC
— WITNESS Asia-Pacific (@witnessorg_asia) December 19, 2024
আজকে আমরা নিজ সম্প্রদায়ের অধিকারের জন্যে লড়াই করাকে লক্ষ্য করে তোলা তরুণ রোহিঙ্গা নারী কর্মী নূর আজিজার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করছি ✊🏾
নুরের যাত্রা্টি অকল্পনীয় প্রতিকূলতা কাটিয়ে ওঠার একটি পথ। বাস্তুচ্যুত হতে বাধ্য হয়ে তিনি একজন শীর্ষস্থানীয় সমর্থক হয়ে উঠেছেন …
জান্তা ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ক্ষমতা দখলের পর রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ তীব্রতর হয়। আরএমসিএন প্রতিরোধ ও জাতিগত শক্তি নিয়ে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর কল্যাণ প্রচারে লিপ্ত। নূর আজিজা জান্তার অত্যাচারকে পরাজিত করতে সংহতির গুরুত্ব উল্লেখ করেছেন।
আমরা শান, বামার, কারেন, পা-ও এবং কা’মন টন সম্প্রদায়ের নারীসহ জাতিগত গোষ্ঠীগুলির সাথে ইতিবাচক জোট গড়ে তুলতে কঠোর পরিশ্রম করেছি। তারা এখন বুঝতে পেরেছে রোহিঙ্গারা সহিংসতার অপরাধী নয়, বরং আমরা একটি সাধারণ শত্রু সামরিক জান্তার শিকার। আমাদের বাস্তুচ্যুতি, নিপীড়ন ও মৌলিক অধিকার অস্বীকারের সাধারণ অভিজ্ঞতা একটি ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট গঠনে সাহায্য করেছে এবং সংলাপের মাধ্যমে আমরা আরো শক্তিশালী সংহতির বন্ধন তৈরি করেছি।
‘উদ্দেশ্যের মধ্যে নিজের শক্তি খুঁজে বের করাটাই এডভোকেসি’
নারী কর্মীদের প্রতি পরামর্শ হিসেবে নূর আজিজা সহকর্মীদের সম্মিলিত সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্যে অধ্যবসায় বজায় রাখতে ও ভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে উৎসাহিত করেছেন।
এই যাত্রাপথে আমার পাওয়া সবচেয়ে বড় উপহার হলো আমার রোহিঙ্গা বোনদের সাথে গড়ে তোলা বা তুলতে পারা এবং আবিষ্কৃত ভ্রাতৃত্ব। যারা আপনাকে বোঝে, হোঁচট খেলে আপনাকে সমর্থন করবে, সন্ধিহান মুহূর্তে আপনাকে বাঁচাবে এমন লোকদের দিয়ে নিজেকে ঘিরে রাখুন। পরস্পরের উপর বিশ্বাস রাখুন এবং নির্ভর করুন, কারণ এটা একা করার কাজ নয়। এগিয়ে যেতে আমাদের পরস্পরের শক্তি, প্রজ্ঞা ও সহানুভূতি প্রয়োজন। হৃদয়ের গভীর থেকে আমি আপনাকে বলতে পারি আপনার সংগ্রাম বোঝে, আপনার বোঝা ভাগাভাগি করে নিতে পারার মতো নারীদের একটি নেটওয়ার্ক থাকা সব পার্থক্য তৈরি করে।
সামনের পথ সবসময় সহজ না হলেও আপনাকে একা হাঁটতে হবে না। নিজ সম্প্রদায় ও ভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলুন এবং জেনে রাখুন, যাত্রাপথ দীর্ঘ হলেও যাদের এটি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন প্রতিটি পদক্ষেপে আপনি বিশ্বকে তাদের জন্যে একটি উন্নত স্থান করে তুলছেন।
নূর আজিজা উল্লেখ করেছেন আরএমসিএনের এই বছরের অগ্রাধিকারের মধ্যে রয়েছে বেঁচে থাকা শিশুদের জরুরি সহায়তা প্রদান, রোহিঙ্গা ঐতিহ্য রক্ষার জন্যে সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ প্রচেষ্টা, ন্যায়বিচার ও সমঝোতার জন্যে দীর্ঘমেয়াদী সমর্থন এবং আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক জোট গঠন।
‘সত্য-বলা, সমঝোতা ও হিসেব-নিকেশ’
রোহিঙ্গাদের কল্যাণের নিশ্চিত করার জন্যে জাতীয় ঐক্য সরকারের (গণতন্ত্রপন্থী শক্তি) সাথে কাজ করা এই প্রচারণার অংশ। নূর আজিজা আরো বলেন:
তাৎক্ষণিক ত্রাণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও ন্যায়বিচারের জন্যে আমরা দীর্ঘমেয়াদী সমর্থনের উপরও মনোনিবেশ করছি। আমরা বার্মায় অর্থপূর্ণ গণতন্ত্রীকরণের জন্যে জাতীয় ঐক্য সরকার ও অন্যান্য অংশীদারদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে এই প্রক্রিয়াগুলি থেকে রোহিঙ্গাদের বাদ দেওয়ার বিষয়টি তুলে ধরতে থাকবো।
আমাদের জন্যে শুধু নাগরিকত্ব কখ্নোই যথেষ্ট নয়। আমরা আরাকান/রাখাইন রাজ্যে আমাদের ন্যায্য স্থানকে সম্পূর্ণরূপে স্বীকৃতি দেয় এমন একটি সমঝোতা, হিসেব-নিকেশ ও সত্য-বলার প্রক্রিয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।
তিনি জোর দিয়ে বলেন এর মধ্যে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে করা ক্ষতির স্বীকৃতি ও তাদের পূর্বপুরুষের ভূমি পুনরুদ্ধার রয়েছে।
সবশেষে তিনি রোহিঙ্গা সংগ্রামের ক্ষেত্রে স্বাধীনতার অর্থ কী তা স্পষ্ট করে বলেন। “আমার সকল মানুষ স্বাধীন হলে তবেই প্রকৃত স্বাধীনতা আসবে।”