
দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলো। উইকিপিডিয়ার মাধ্যমে ইক্তসখের ছবি। সৃজনি সাধারণ একইরকম ব্যবহার ৪.০।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিতে বৈশ্বিক জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশ বা প্রায় ২০৭ কোটি লোকের আবাসস্থল। অধিক হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, দ্রুত নগরায়ন, উচ্চ দারিদ্র্যের হার এবং আয় বৈষম্যসহ এই অঞ্চলটি অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এছাড়াও, এটি গণতন্ত্রের পশ্চাদপসরণ, ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদ, এবং গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের মতো, বেকারত্ব বৃদ্ধি, ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি, বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধি এবং আরো অনেক অর্থনৈতিক বিষয়সহ শাসন সংক্রান্ত নানা সমস্যা নিয়ে লড়াই করছে৷
এই অঞ্চলে ২০২৪ সালে অনেক উল্লেখযোগ্য গল্প ও সংবাদ ছিল তবুও গ্লোবাল ভয়েসেস আমাদের নিবেদিত লেখক ও অনুবাদক সম্প্রদায়ের মাধ্যমে নির্বাচিত কয়েকটি দিক তুলে ধরতে পেরেছে। এখানে আমাদের ২০২৪ সালে দক্ষিণ এশিয়া কভারেজের একটি সংক্ষিপ্তসার রয়েছে, যাতে নির্বাচন ও রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে অনলাইন স্থানগুলিতে সরকারগুলির নিয়ন্ত্রণ প্রসারণে গৃহীত নানা পদক্ষেপ তুলে ধরা হয়েছে।
গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের একটি বছর
২০২৪ সালে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিতে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন হয়৷ বিরোধী দল ও তার মিত্রদের বয়কটের মাঝে ৭ জানুয়ারি ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একতরফা নির্বাচনে টানা চতুর্থ মেয়াদে জয়লাভ করে৷ তবে নতুন সরকার স্বল্পস্থায়ী হয়। কয়েক হাজার নাগরিকের সমর্থনে একটি ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহ ২০২৪ সালের জুলাই থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ও শেখ হাসিনা সরকারের কর্তৃত্ববাদ এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালে তা ক্রমবর্ধমান অস্থিরতা নৈরাজ্যের দিকে ধাবিত হলে ৫ আগস্ট, ২০২৪ সরকার পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যায়।

শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে উল্লসিত জনতা। উইকিপিডিয়ার মাধ্যমে মোঃ জনি হোসেনের ছবি। সৃজনি সাধারণ একইরকম ব্যবহার ৪.০।
আমাদের বিশেষ কভারেজ দেখুন: বাংলাদেশে অশান্তি
ভোট কারচুপি, ইন্টারনেট বন্ধ ও ফলাফল ঘোষণায় বিলম্বের অভিযোগে পাকিস্তানে ৮ ফেব্রুয়ারির সাধারণ নির্বাচনকে বছরের সবচেয়ে কম বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন হিসেবে গণ্য করা হয়। কারাবন্দী সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) এর প্রতি অনুগত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা একটি বিরোধী জোট গঠন করলে পাকিস্তান মুসলিম লীগ (নওয়াজ) ও পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) বেশ কয়েকটি স্বতন্ত্র প্রার্থীর সাথে একটি জোট সরকার গঠন করে। পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে পিটিআইয়ের নির্বাচনী প্রতীক প্রত্যাহার করে তাদের প্রার্থীদের স্বতন্ত্রভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বাধ্য করে।
ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ২০২৪ সালের জুনে ভারতীয় সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করে এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার ক্ষমতাকে আরো সুসংহত করে তৃতীয় মেয়াদে জয়লাভ করেন।
জনতা বিমুক্তি পেরামুনা (গণমুক্তি ফ্রন্ট) এর নেতা অনুরা কুমারা দিসানায়েকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়ী হয়ে শ্রীলঙ্কার নবম কার্যনির্বাহী রাষ্ট্রপতি হয়েছেন।
সামাজিক গণমাধ্যম ও সাইবার-বাহিনী
বাংলাদেশে ৫.২৯ কোটিরও বেশি সামাজিক গণমাধ্যম ব্যবহারকারী – বেশিরভাগই ফেসবুকে – লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়ে রাজনৈতিক দলগুলির বর্ণনাকে ঠেলে দিচ্ছে৷ সশস্ত্র ভুল তথ্য ও বিভ্রান্তির মাধ্যমে প্রায়শই ভুয়া প্রবন্ধ ব্যবহার ও বিরোধীদের কালিমালিপ্ত করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ন কাহিনীকে তুলে ধরেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়ার গল্প ছড়িয়ে দিয়ে কর্তৃত্ববাদ প্রতিরোধে অনুসারীদের সমাবেশ করে।
মেটা তার ট্রান্সপারেন্সি প্রতিবেদনে বিরোধীদের সম্পর্কে ভুল তথ্য ছড়ানোর জন্যে ২০২৪ সালের প্রথম প্রান্তিকে বাংলাদেশ থেকে ৫০টি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ও ৯৮টি পৃষ্ঠা মুছে ফেলার কথা জানিয়েছে। টিকটক শুধু জানুয়ারি মাসেই নির্বাচনী বর্ণনায় কারচুপি চেষ্টার জন্যে বাংলাদেশ থেকে ২,৩০০ টিরও বেশি অ্যাকাউন্ট সরিয়ে ফেলার কথা জানিয়েছে। বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ডিপফেক ব্যবহারের কথাও জানানো হয়েছে।

পাকিস্তানে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্যে ইমরান খানের আহ্বানের প্রতিধ্বনি করে লন্ডনে পিটিআই সমর্থকদের বিক্ষোভ। ফ্লিকারের মাধ্যমে অ্যালিসডেয়ার হিকসনের ছবি। সৃজনি সাধারণ একইরকম ব্যবহার ৪.০।
পাকিস্তানে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই), পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) ও পাকিস্তান মুসলিম লীগ এন (পিএমএলএন) এর মতো রাজনৈতিক দলগুলি তাদের নির্বাচনী প্রচারণার জন্যে সামাজিক গণমাধ্যম ব্যবহার করে ভোটারদের যথেষ্ট প্রভাবিত করেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে পাকিস্তানের কারাবন্দী নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে কারাগার থেকে বক্তৃতা দিতে দেখা গেছে।
৮০ কোটিরও বেশি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী নিয়ে বৈশ্বিকভাবে বিশ্বব্যাপী ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপে নেতৃত্ব প্রদানকারী ভারত রাজনৈতিক দলগুলিকে তাদের বার্তা প্রসারিত করতে সামাজিক গণমাধ্যম প্রভাবক ব্যবহারে প্ররোচিত করে। একটি তরুণ, হাইপার-অনলাইন জনসংখ্যা্কে আবেদন জানাতে, রাজনৈতিক দলগুলি গেমারসহ হাজার হাজার প্রভাবক একত্রিত করে যারা বিভিন্ন জনগণের সাথে তাদের সংযোগ স্থাপনে সক্ষম করে। বিভিন্ন নির্বাচনী আখ্যান প্রচারের জন্যে বিভিন্ন কার্টুন, মেমে ও ট্রল ব্যবহার করা হয়। ক্ষমতাসীন বিজেপির তথ্যপ্রযুক্তি সেলের ২০১৪ ও ২০১৯ সালের নির্বাচনে দৃশ্যমান ডেটা বিশ্লেষণ ও সামাজিক গণমাধ্যম কৌশল ব্যবহারের ইতিহাস ছিল। প্রতিবেদনগুলি ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে ব্যবহারকারীর বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করতে সরল নামে একটি অ্যাপ ব্যবহারের ইঙ্গিত দেয়।
শ্রীলঙ্কায় ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের নির্বাচনের আগে নেতৃস্থানীয় রাষ্ট্রপতি প্রার্থীরা বিভিন্ন ইস্যু ও লক্ষ্য কেন্দ্রিক প্রচারণা ও রাজনৈতিক বর্ণনার জন্যে ব্যাপকভাবে সামাজিক গণমাধ্যম ব্যবহার করেছেন। ড. সঞ্জনা হাত্তোতুওয়া রাষ্ট্রপতি প্রার্থী রনিল বিক্রমাসিংহে, অনুরা কুমারা দিসানায়েক ও সজিথ প্রেমাদাসার সাথে যুক্ত ৪,০০০ টিরও বেশি টুইটের ডেটাসেট ব্যবহৃত একটি বিশ্লেষণ সামাজিক গণমাধ্যম ভালো ও আদর্শ ব্যক্তিত্বদের কাজে লাগানো দেখিয়েছেন। এই চরিত্রায়ণগুলিকে প্রায়শই প্রামাণিক বিবেচনা করা হলেও তা হেরফেরের ঝুঁকিপূর্ণ।
শ্রীলঙ্কায় বিদ্যমান প্রায় ৮৫ লক্ষ ফেসবুক ব্যবহারকারীদের অনেকেই নির্বাচন, রাজনীতি ও প্রার্থী নিয়ে আলোচনার জন্যে মঞ্চটি ব্যবহার করে থাকে। মেটার নতুন বিষয়বস্তু লাইব্রেরি (এমসিএল) ব্যবহার করে ড. হাত্তোতুওয়া ৩০ দিনে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী রনিল, সজিথ ও অনুরা’র অফিসিয়াল ফেসবুক অ্যাকাউন্টের তিনটি জনপ্রিয় পোস্ট ও প্রায় ১,৫০০ মন্তব্য বিশ্লেষণ করেছেন। বিশ্লেষণটি এই প্রার্থীরা কীভাবে মূল সমর্থক-ভিত্তি বুঝতে পারে এবং অনুসন্ধানগুলি কীভাবে আধুনিক রাজনৈতিক আলোচনার কাঠামোর একটি আভাস প্রদান করে তার মানচিত্রায়ণ করেছে।

শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি অনুরা কুমারা দিসানায়েকে ২০২৩ সালে। উইকিমিডিয়া সাধারণের মাধ্যমে বান্টি৪৫৬-এর ছবি সৃজনি সাধারণ (একইরকম ব্যবহার ৪.০)।
কর্তৃত্ববাদের হাতিয়ার হিসেবে ডিজিটাল দমন
কয়েকটি ওয়েবসাইট ব্লক ছাড়া জানুয়ারির নির্বাচনের সময় বাংলাদেশে বড় ধরনের কোনো ইন্টারনেট ব্যাঘাত না ঘটলেও, ১৬ জুলাই-৫ আগস্ট পর্যন্ত জুলাই বিক্ষোভের সময় বেশ কয়েকটি সামাজিক গণমাধ্যম মঞ্চের নিষেধাজ্ঞাসহ মাঝে মাঝে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়। ১৮ ও ২৩ জুলাইয়ের মধ্যবর্তী সময়ে গণমাধ্যম ব্ল্যাকআউটসহ দেশব্যাপী সম্পূর্ণ ইন্টারনেট বন্ধের ফলে বাংলাদেশের সাথে প্রায় সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ভুল তথ্য ও বিভ্রান্তির ব্যাপক বিস্তার করায় এই ব্যবস্থাগুলি অনলাইনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
পাকিস্তান এই বছর ভিন্নমত ও বাকস্বাধীনতার উপর বিধিনিষেধ আরো কঠোর করেছে। ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের আগে কর্তৃপক্ষ একের পর এক ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। পাকিস্তানিরা ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে এক্স (আগের টুইটার) মঞ্চে ঢুকতে অসুবিধায় পড়ে এবং ২০২৪ সালের এপ্রিলে সরকার জাতীয় নিরাপত্তার উদ্বেগ উল্লেখ করে মঞ্চটি নিষিদ্ধ করার কথা স্বীকার করেছে। আগস্টে পাকিস্তান বিষয়বস্তু অনুসরণ, অবরোধ বা প্রচারণা হিসেবে সীমাবদ্ধ করতে একটি জাতীয় ফায়ারওয়াল মোতায়েন করেছে। ভিপিএন ব্যবহার করে পাকিস্তানিরা অবরুদ্ধ সাইট ও মঞ্চগুলিতে ঢুকতে শুরু করলে ১৬ নভেম্বর কর্তৃপক্ষ “সন্ত্রাসী, পর্নোগ্রাফিক ও নিন্দামূলক বিষয়বস্তুতে প্রবেশ রোধের প্রয়াসে পাকিস্তান টেলিকম কর্তৃপক্ষকে অনিবন্ধিত ভিপিএন অবরোধের নির্দেশ দেয়৷ এক্স ব্যবহারকারীরা অন্য একটি সামাজিক গণমাধ্যম মঞ্চ ব্লুস্কাইতে স্থানান্তরিত হতে শুরু করলে নভেম্বরে সেই মঞ্চটি তাদের অবরোধের কথা জানায়।

জিওভানা ফ্লেকের ছবি, অনুমতিসহ ব্যবহৃত।
নাগরিক গণমাধ্যম মানমন্দিরের একটি বিশ্লেষণে জানা যায় সাম্প্রতিক বছরগুলিতে কীভাবে ভারত সরকার একটি মূল কৌশল হিসেবে ওয়েবসাইট অবরোধ ব্যবহার করে সক্রিয়ভাবে অনলাইন স্থানে তার নিয়ন্ত্রণ প্রসারিত করেছে। ডিজিটাল অধিকার গোষ্ঠী গিক্স ফর গিক্সের একটি প্রতিবেদনে ২০২৪ সালের মার্চ মাসে বিগত এক দশকে ৫৫,০০০টিরও বেশি ওয়েবসাইট অবরোধ করা হয়েছে, যার ৪৮ শতাংশই হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের অধীনে। লক্ষ্যবস্তুগুলির মধ্যে ছিল স্বাধীন সংবাদ আউটলেট, ঘৃণামূলক বক্তব্য ট্র্যাকার ও স্ট্রিমিং মঞ্চ।
শ্রীলঙ্কায় ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে প্রবর্তিত অনলাইন নিরাপত্তা আইনে “অনলাইন নিরাপত্তা কমিশন”কে “নিষিদ্ধ বিবৃতি” সংজ্ঞায়িত করা, বিষয়বস্তু অপসারণের সুপারিশ এবং অপরাধীদের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধের বিস্তৃত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এটিকে শ্রীলঙ্কায় মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্যে একটি বড় আঘাত বলে মনে করেছে।