ঢাকার রাজপথে নতুন বিপত্তি অটোরিকশা! কিন্তু বন্ধ করা যাচ্ছে না কেন?

ব্যাটারিচালিত রিকশার একটি নমুনা। এখন টিভির ইউটিউব চ্যানেল থেকে “দুই সিটি কর্পোরেশের গলার কাঁটা ব্যাটারি চালিত রিকশা” নাম্নী ভিডিও থেকে পর্দাচিত্র। ফেয়ার ইউজ।

ব্যাটারিচালিত রিকশার একটি নমুনা। এখন টিভির ইউটিউব চ্যানেল থেকে “দুই সিটি কর্পোরেশের গলার কাঁটা ব্যাটারি চালিত রিকশা” নাম্নী ভিডিও থেকে পর্দাচিত্র। ফেয়ার ইউজ।

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় যানজট নতুন কিছু নয়। এ শহরে যানজটের কারণে প্রতিদিন ৮২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। তাছাড়া গত দেড় দশকে ঢাকার সড়কে যানবাহন চলাচলের গতি কমেছে ঘণ্টায় ১৬ কিলোমিটার। ২০০৭ সালে গতি ছিল গড়ে ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটারে।

যানজটের এমন শহরে নতুন বিপত্তি হিসেবে এসেছে তিন চাকার ব্যাটারিচালিত রিকশা, যা ইজি বাইক বা অটোরিক্সা নামেও পরিচিত। এই বছরের মে মাসে, সরকার এই যানবাহনগুলিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, যদিও দেশজুড়ে প্রধান মহাসড়কে এগুলো চালান যেত না। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পরে ঢাকায় হঠাৎ করেই ব্যাটারি চালিত রিকশা বিপুল পরিমাণে বেড়ে গেছে। অলি-গলিসহ রাজপথে সবখানেই এখন তাদের দাপট। অনুমোদন না থাকলেও মূল সড়কে নির্দ্বিধায় যাতায়াত করছে।

আর এই রিকশাগুলোর মূল সমস্যা হচ্ছে এগুলো চালাতে লাইসেন্স লাগে না। ফলে যে কেউ এগুলো নিয়ে রাস্তায় নেমে যাচ্ছে এবং এদের বেপরোয়া গতির কারণে দুর্ঘটনাও অনেক বেড়ে গেছে। নভেম্বর মাসে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী ব্যাটারি-চালিত রিকশা দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। এই প্রেক্ষিতে দেশের উচ্চ আদালত তিন দিনের মধ্যেই ঢাকা মহানগরে ব্যাটারি-চালিত রিকশা বন্ধের নির্দেশ জারি করে।

উচ্চ আদালতের নির্দেশের পরেই অটোরিকশা চালকরা রাজপথে নামেন। তারা লাইসেন্স ও রুট পারমিটসহ ১১ দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। তাদের আন্দোলনের মুখে ব্যাটারি-চালিত রিকশা চলাচল বন্ধে হাইকোর্ট যে আদেশ দিয়েছিল, তার উপর গত ২৫শে নভেম্বর থেকে একমাসের স্থিতিবস্থা দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের চেম্বার আদালত। ফলে ব্যাটারি-চালিত রিকশা চলাচলে আর কোনো আইনি বাধা নেই।

নীচের এই ইউটিউব ভিডিওতে বিভিন্ন ধরনের ব্যাটারি-চালিত রিকশাকে পথে চলতে দেখা যাচ্ছেঃ

দুর্ঘটনা, যানজট বৃদ্ধিতে ব্যাটারি-চালিত রিকশা কতোটা দায়ী?
ঢাকায় ব্যাটারি চালিত রিকশার সংখ্যা কত, তা কেউ বলতে পারে না। তবে, কারো কারো মতে, এই সংখ্যা ৪ লাখ। ২০০৯-২০১০ সাল থেকে বাংলাদেশে এসব রিকশা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে সড়কে নেমেছে। বাড়তে বাড়তে এদের সংখ্যা এখন অনেক বেশি হয়ে গেছে। এ ছাড়াও এদের ব্যাটারী চার্জ করার জন্যে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে যা যোগানের চেয়ে বেশী।

স্থানীয় ওয়ার্কশপগুলোতে পায়ে চালিত রিকশার বডিতে মোটর এবং ব্যাটারি লাগিয়ে সাধারণত ব্যাটারি-চালিত রিকশা তৈরি করা হয়। প্রতি চার্জে এসব রিকশা যাত্রীর ওজন, ভূখণ্ড এবং গতির উপর নির্ভর করে ৮০ থেকে ১২০ কিমি পর্যন্ত দূরত্ব ভ্রমণ করতে পারে। শুরুতে, এই রিকশাগুলি ৬০০ ওয়াটের মোটর ব্যবহার করত, যা দিয়ে ঘণ্টাপ্রতি ২০-২৫ কিলোমিটার পর্যন্ত গতিতে চলতে পারত। এইসব যানবাহনের চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে অনেকে ৮০০ ওয়াট বা ১২০০ ওয়াট মোটর ব্যবহার করছে। ফলে এসব রিকশায় ঘণ্টাপ্রতি ৪০ কিলোমিটার পর্যন্ত গতি ওঠানো যায় – যা দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বাড়ায়।

এই রিকশাগুলোর দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ এর ব্রেকিং সিস্টেমের দুর্বলতা। এতে ইউ ব্রেক থাকে। এই ব্রেকের কার্যকারিতা খুবই কম। ফলে জোরে চালানোর সময় প্রায়ই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটায়।

বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ব্যাটারি চালিত তিন চাকার যানবাহনের কারণে সারাদেশে ৯০০টি দুর্ঘটনা ঘটেছে।

এদিকে ঢাকার যানজটের পিছনে ব্যাটারি-চালিত রিকশার ভূমিকা মানতে নারাজ রিকশা-ভ্যান-ইজিবাইক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস। তিনি ঢাকার যানজটের পিছনে ব্যক্তিগত গাড়িকে দায়ী করে বলেন:

[…] একটি আদর্শ নগরে ২৫ শতাংশ সড়ক থাকতে হয়, কিন্তু ঢাকা মহানগরীতে আছে মাত্র ৮ শতাংশ। যার ৭৫ শতাংশই দখল করে আছে ব্যক্তি মালিকানাধীন গাড়ি। ফলে নগরীর যানজটের প্রধান কারণ হচ্ছে অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও ব্যক্তিগত গাড়ি।

পায়ে চালিত রিকশায় তুলনায় ব্যাটারি চালিত রিকশায় আয় বেশি। সেজন্য বাংলাদেশে ব্যাটারি-চালিত রিকশা বেড়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন গ্লোবাল ভয়েসেস বাংলা’র অনুবাদক নুরুন্নবী চৌধুরী। তিনি তার এক্স হ্যান্ডেলে পায়ে ও ব্যাটারি চালিত রিকশার পিছনে ব্যয় ও আয়ের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরেছেন:

উৎপাদন ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বেশি হওয়া সত্ত্বেও রিকশা চালকরা গতানুগতিক পায়ে চালিত রিকশার চেয়ে ব্যাটারি চালিত রিকশা বেশি পছন্দ করেন। আর পিছনে বড় কারণ হলো, প্রতিদিন রিকশা চালিয়ে বেশি আয় এবং বিনিয়োগের টাকা দ্রুত তুলে ফেলা যায়।

গত দেড় দশকে প্রবৃদ্ধি আর উন্নয়নের জমজমাট গল্পের বিপরীতে কর্মসংস্থানের গল্পটা অনেকটাই ফিকেদেশি-বিদেশি বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি নেই। বরং পুঁজির একটা বড় অংশ পাচার হয়ে গেছে দুর্নীতির কারণে। ফলে কর্মসংস্থানের পালে হাওয়া লাগেনি। কৃষিতেও ক্রমাগত কর্মসংস্থান কমছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সরকারি পাটকল, চিনিকল একের পর এক বন্ধ হয়েছে। ফলে গরিব মানুষেরা কাজের খোঁজে শহরমুখী হয়েছে। ফুটপাতে দোকান দেয়া থেকে শুরু করে অটোরিকশা চালিয়ে শহরের রাস্তায় টিকে থাকার সংগ্রাম করছে বলে মনে করেন, শিক্ষক, গবেষক মাহা মির্জা:

লাখ লাখ বাদ দিলাম, হাজারটা চাকরিও সৃষ্টি হয়েছে? শেষ পর্যন্ত কোটি মানুষের ঠাঁই হয়েছে ইনফরমাল খাতে।

বন্ধের চেষ্টা বারবার বিফল
এবারই প্রথম নয়, এর আগেও ব্যাটারি-চালিত রিকশা বন্ধের চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু স্বল্প আয়ের মানুষের কষ্টের কথা বিবেচনা করে ঢাকা শহরে এইসব রিকশা চলাচলে পরে আর বাধা আসেনি।

তাছাড়া ব্যাটারি-চালিত রিকশা বন্ধ নিয়ে মানুষের মধ্যেও রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। অনেকে যন্ত্রচালিত রিকশা বন্ধ করার পক্ষে থাকলেও আগে বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে বলেছেন। তা না হলে, কাজ না পেয়ে এসব রিকশা চালকরা চুরি-ছিনতাই জাতীয় ঘটনায় জড়িয়ে পড়তে পারেন। আবার কেউ কেউ জীবিকার কথা বলে ঝুঁকিপূর্ণ যান চলাচলে অনুমতি দেয়া ঠিক হবে না বলে মনে করেন।

ননসেন্স নামের একজন এক্স প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারকারী প্রযুক্তির এই যুগে পায়ে চালিত রিকশার পরিবর্তে ব্যাটারি-চালিত রিকশা থাকাই উচিত বলে মনে করেন:

ভালো কর্মসংস্থানের ভালো ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারলে ব্যাটারি-চালিত রিকশা আপনাআপনিই বন্ধ হয়ে যাবে বলে মনে করেন ফেসবুক ব্যবহারকারী রিদওয়ান বাশার

সরকার সঠিকভাবে এইসব যন্ত্রচালিত রিকশা তৈরির জন্য শক্তিশালী শিল্প মান প্রতিষ্ঠার কথা বার বার বলে আসছে, কিন্তু এখনো এ বিষয়ে কোন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। এদিকে, রিকশা চালকদের সমিতি এই যানবাহনের জন্য লাইসেন্স প্রদানের দাবি অব্যাহত রেখেছে, অন্যদিকে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি ব্যাটারিচালিত রিকশা এবং অন্যান্য ছোট যানবাহনের রোড পারমিট নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি নীতিমালার আহ্বান জানিয়েছে

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .