শ্রীলঙ্কানরা ইতিহাস সৃষ্টি করেছে গত ২১শে সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অনুরা কুমারা দিসানায়াকা (একেডি) কে শ্রীলঙ্কার নবম নির্বাহী প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত করে। জনতা বিমুক্তি পেরামুনা (জনগণের মুক্তি ফ্রন্ট)-এর জনপ্রিয় একসময়ের বামপন্থী নেতা দিসানায়াকা দ্বীপ দেশটিতে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাম্প্রতিককালে একজন উল্লেখযোগ্য বিরোধী নেতা হিসেবে পরিচিত। ২০১৯ সাল থেকে শ্রীলঙ্কা একটি অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে রয়েছে এবং রাষ্ট্রপতি দিসানায়াকা জনগণের এই অবস্থা থেকে উত্তরণে আশার প্রতীক হয়ে এসেছেন।
সাংবাদিক আজ্জাম আমিন “এক্স” (পূর্বে টুইটার) এ পোস্ট করেছেন:
Official: Anura Kumara Dissanayake has won the 2024 Sri Lanka Presidential Election. He will be the 9th Executive President of Sri Lanka pic.twitter.com/eDFwA1eFFI
— Azzam Ameen (@AzzamAmeen) September 22, 2024
অফিসিয়ালঃ অনুরা কুমারা দিসানায়াকা ২০২৪ সালের শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। তিনি শ্রীলঙ্কার ৯ম কার্যনির্বাহী রাষ্ট্রপতি হবেন।
২০২২ সালের ১৪ই জুলাই শ্রীলঙ্কার প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপাকসার তৃণমূল প্রতিরোধ আন্দোলন আরাগালয় (সংগ্রাম) এর তুমুল চাপে দেশ ছাড়েন এবং পদত্যাগ করেন। তার পরপর শ্রীলঙ্কার সংসদে একটি পরোক্ষ রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২০২২ সালের ২০শে জুলাই, তখনকার প্রধানমন্ত্রী রানিল বিক্রমাসিংহে সংসদে একটি গোপন ব্যালটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। মধ্য-ডানপন্থী ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির (ইউএনপি) নেতা বিক্রমাসিংহে ২০২৩ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে ২.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এর বেইলআউট নিশ্চিত করে দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর নেতৃত্ব দেশকে আগের সংকটময় অবস্থা থেকে পুনরুদ্ধার করতে সাহায্য করেছিল, কিন্তু নাগরিকরা তাঁর কৃচ্ছতাসাধন পদক্ষেপ এবং ক্ষমতাচ্যুত রাজাপাকসে পরিবারের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে খুশি ছিলেন না।
এই নির্বাচনে তিন প্রধান রাষ্ট্রপতি প্রার্থী তাদের প্রচারে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছেন। দেশের এক কোটি একাত্তুর লাখ ভোটারদের মধ্যে তাদের মূল্য লক্ষ্য ছিল প্রায় ২ লাখের মত প্রথমবার ভোটার এবং দশ লাখ নতুন ভোটারদের সমর্থন নিশ্চিত করা।
আরও পড়ুন: ডিজিটাল সমর্থকঃ ফেসবুকে দৃশ্যমান শ্রীলঙ্কার প্রধান রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীদের প্রতি সমর্থনের ব্যবচ্ছেদ
দ্বিতীয় দফার ভোট
গত ২১শে সেপ্টেম্বর শনিবার শ্রীলঙ্কায় নবম রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। দেশের ২ কোটি ২০ লক্ষ জনসংখ্যার মধ্যে নির্বাচিত ভোটার ছিল ১ কোটি ৭১ লক্ষ এবং প্রায় ৭৬% ভোট পরেছে। প্রথম দফার ভোটে কোনও প্রার্থী প্রয়োজনীয় ৫০ শতাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেননি, এবং দিসানায়াকা ৪২ শতাংশ এবং বিরোধী নেতা সাজিথ প্রেমাদাসা ৩৩ শতাংশ ভোট পেয়ে এগিয়ে ছিলেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট বিক্রমাসিংহে ১৭% শতাংশ ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থানে ছিলেন।
Final result of first count – Sri Lanka Presidential election 2024.
3%>42.31% AKD
52.25%>2.57% SLPP
41.9%>32.76% SP
*People’s mandate above all!
*Nobody is irreplaceable !
*Organic growth matters! Votes gained by creating fear + racisms and blood will never last long. ✌️ pic.twitter.com/Xzq9ZYLkuO— Dr.Amila Fernando🪬 (@DrBukkabwoi) September 22, 2024
প্রথম দফার গণনার চূড়ান্ত ফলাফল-শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ২০২৪।
৩% > ৪২.৩১% একেডি
৫২.২৫% > ২.৫৭% এসএলপিপি
৪১.৯% > ৩২,৭৬% এসপি
* সবকিছুর ঊর্ধ্বে জনগণের রায়!
* কেউই অপরিবর্তনীয় নয়!
শ্রীলঙ্কার নির্বাচনী আইন অনুসারে, দিসানায়াকা এবং রানার-আপ সাজিথ প্রেমাদাসার মধ্যে বিজয়ী নির্ধারণের জন্য দ্বিতীয় দফা পছন্দের ভোট গণনা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। শ্রীলঙ্কার প্রেফারেন্সিয়াল ভোটিং সিস্টেমের অধীনে ভোটাররা তাদের ব্যালটে তিনজন রাষ্ট্রপতি প্রার্থী পর্যন্ত র্যাঙ্কিং (পছন্দের ক্রম) করতে পারেন। গত ২২শে সেপ্টেম্বর নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করে যে দ্বিতীয় দফা গণনার পর দিসানায়াকা পেয়েছেন ৫৭ লাখ চল্লিশ হাজার ভোট (৫৬%) এবং প্রেমাদাসা পেয়েছেন ৪৫ লক্ষ ৩০ হাজার ভোট। (৪৪%).
পরের দিন দিসানায়াকার রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথগ্রহণ হয় যেখানে তিনি “রাজনীতিবিদদের প্রতি জনগণের আস্থা পুরোপুরি পুনরুদ্ধার” করার অঙ্গীকার করেন।
Photos of President Anura Kumara Dissanayake taking the oath as the 9th Executive President of the Democratic Socialist Republic of Sri Lanka.#LKA #SriLanka #SriLankaElections @anuradisanayake pic.twitter.com/pcxMZtgBS6
— Sri Lanka Tweet 🇱🇰 (@SriLankaTweet) September 23, 2024
গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র শ্রীলঙ্কার ৯ম কার্যনির্বাহী রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহণকারী রাষ্ট্রপতি অনুরা কুমার দিসানায়াকার ছবি।
অনুরা কুমারা দিসানায়াকার (একেডি) উত্থান
“একেডি” নামে পরিচিত অনুরা কুমারা দিসানায়াকা ১৯৬৮ সালের ২৪শে নভেম্বর অনুরাধাপুরের একটি সাধারণ কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার ছোটবেলার অভিজ্ঞতা এবং চারিপাশে দেখা রাজনৈতিক সহিংসতা দেখে কিছু করার প্রয়াসে অনুপ্রাণিত হয়ে জনতা বিমুক্তি পেরামুনা (জেভিপি) ছাত্র শাখার যোগদানের মাধ্যমে তাঁর রাজনৈতিক কর্মজীবন শুরু হয়। জেভিপি পার্টির সূচনা ১৯৬৫ সালে একটি কমিউনিস্ট পার্টি হিসাবে এবং এটি ১৯৭০ এবং ১৯৮০-এর দশকে সরকারের বিরুদ্ধে দুটি বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেয়, যার ফলে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। ২০০০ সালের পর সহিংসতা ত্যাগ করার ঘোষণা দিয়ে জেভিপি একটি সিংহলি জাতীয়তাবাদী-কেন্দ্রিক রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। দিসানায়াকা ২০০০ সালে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং ২০০৪-২০০৫ সালের দিকে রাষ্ট্রপতি চন্দ্রিকা বন্দরনায়েকের অধীনে কৃষি মন্ত্রী হিসাবে সংক্ষিপ্তভাবে দায়িত্ব পালন করেন।
২০১৯ সালে দিসানায়াকা দুই ডজনেরও বেশি রাজনৈতিক দল, পেশাদার, শিক্ষাবিদ এবং কর্মীদের একত্রিত করে ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার (এনপিপি) জোট প্রতিষ্ঠা করেন। পরের বছরগুলোতে তিনি এনপিপি-কে শ্রীলঙ্কার প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল শ্রীলঙ্কা পিপলস ফ্রন্ট (এসএলপিপি), শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টি (এসএলএফপি) এবং ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির (ইউএনপি) বিকল্প হিসাবে স্থাপন করেন। যদিও ২০২০ সালের সংসদীয় নির্বাচনে এনপিপি ২২৫টির মধ্যে মাত্র তিনটি আসনে জয়লাভ করে এবং রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিসেবে দিসানায়াকা ২০১৯ ও ২০২২ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে হেরে যান।
দিসানায়াকা ঘুরে দাঁড়ান ২০২২ সালের আরাগালয় বিক্ষোভের সময়, যার ফলশ্রুতিতে রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপাকসে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন। যদিও বিকেন্দ্রীভূত আন্দোলনটির নির্দিষ্ট কোন সঞ্চালক ছিলনা, তবুও এসএলপিপি, এসএলএফপি এবং ইউএনপির গতানুগতিক রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করে একটি বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প হিসাবে দিসানায়াকার এনপিপি জনগণের “সংস্কার” আন্দোলনের সাথে একীভূত হয়েছিল এবং তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠের আস্থা অর্জন করেছেন। দিসানায়াকা একজন দক্ষ বক্তা এবং তাঁর সমাবেশগুলি বিপুল জনসমাগমকে আকৃষ্ট করে। সংস্কারের জন্য তাঁর আবেগপূর্ণ আহ্বান এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ডাক বহু মানুষের মনে গেঁথে গিয়েছিল।
শ্রীলঙ্কার অনেক নাগরিকের কাছে রাষ্ট্রপতি দিসানায়াকা আশার প্রতীক হয়ে উঠেছেন, যেমনটি শ্রীলঙ্কার এক্স ব্যবহারকারী থিলাঙ্কা রাথনায়াকা শেয়ার করেছেনঃ
The one and only hope for #SriLanka #akd pic.twitter.com/mtnuiZhbCT
— Thilanka Rathnayaka 🙏🙏🌱🇱🇰🇱🇰🇱🇰 (@thilankadinush) September 21, 2024
শ্রীলঙ্কার জন্যে একমাত্র আশার প্রতীক একেডি
পররাষ্ট্রনীতিঃ ভারত বনাম চীন
দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ভারতের সামুদ্রিক সীমান্ত রয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে শক্তিশালী জাতিগত ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কের পাশাপাশি, দুই দেশ ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে, যেখানে ভারত শ্রীলঙ্কার বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। দেশটিতে সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সঙ্কটের সময় ভারত ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আর্থিক ও মানবিক সহায়তা প্রদান করেছে।
ভারত মহাসাগরে চীনের কৌশলগত একটি রাজনৈতিক ধারণা স্ট্রিং অফ পার্লস, যাকে মেরিটাইম সিল্ক রোড বলা হয়, এর গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে শ্রীলঙ্কা। দেশটি চীনের বিস্তৃত বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) উন্নয়ন কৌশলের অন্যতম অংশ।
দ্বীপরাষ্ট্রের সাথে চীনেরও ঐতিহাসিক সম্পর্ক ছিল এবং ২০০৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি মাহিন্দা রাজাপাকসের শাসনামলে চীন ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে সম্পর্ক একটি নতুন স্তরে পৌঁছেছিল। ২০০৯ সালে শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের সমাপ্তির পর, চীন শ্রীলঙ্কার জন্য বিদেশী বিনিয়োগ ও ঋণের একটি প্রধান উৎস হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে বড় আকারের পরিকাঠামো প্রকল্পে অর্থায়নের ক্ষেত্রে। ২০১৭ সালে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর হাম্বানটোটাকে ৯৯ বছরের ইজারা দেয়া হয়েছে চীনের কাছে, যাকে প্রায়ই বিআরআই উন্নয়ন প্রকল্পের সাথে যুক্ত চীনা ঋণ ফাঁদের উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করা হয়।
দিসানায়াকাকে চীনপন্থী বলে মনে করা হয় এবং তিনি চীনের কাছ থেকে সর্বাধিক সমর্থন চাইবেন বলে আশা করা হচ্ছে। তবে, তিনি সাংবাদিকদের বলেন যে শ্রীলঙ্কা চীন ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কের চাপে থাকতে চায় না কারণ উভয়ই মূল্যবান বন্ধু এবং ঘনিষ্ঠ অংশীদার।
On Sunday (22), I met the Ambassador of the People’s Republic of China at the JVP Headquarters. The Ambassador conveyed the good wishes of the Chinese Government on my being elected as the new President and handed me a special congratulatory message from the Chinese President. pic.twitter.com/TP7dnNkeFp
— Anura Kumara Dissanayake (@anuradisanayake) September 23, 2024
২২শে সেপ্টেম্বর রবিবার জেভিপি সদর দফতরে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়। রাষ্ট্রদূত আমার নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার জন্য চীন সরকারের শুভেচ্ছা জানান এবং চীনা রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে একটি বিশেষ অভিনন্দন বার্তা আমার হাতে তুলে দেন।
এরপর গত ২৫শে সেপ্টেম্বর দিসানায়াকা শ্রীলঙ্কার সংসদ ভেঙে দেন। ফলে দেশটিতে একটি আগাম সংসদীয় নির্বাচনের পথ তৈরি হয়েছে। এই নির্বাচনের তারিখ নির্ধারিত হয়েছে আগামী ১৪ই নভেম্বর এবং আশা করা যাচ্ছে এতে তাঁর এনপিপি জোট সংসদীয় ক্ষমতা সুসংহত করতে পারবে।
রাষ্ট্রপতি হিসাবে দিসানায়াকা কী করবেন তা দেখা বাকি রয়েছে। তবে এটি অনস্বীকার্য যে তাঁর সংস্কারের বার্তাটি অনেক নির্দলীয় আরাগালয় সমর্থকদের বহুদিনের দাবি এবং তাঁর ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার জোট এই সংস্কার বাস্তবায়িত করার অঙ্গীকার করেছে।