বানভাসী মানুষের পাশে মানুষ: এটাই সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির বাংলাদেশ

বাংলাদেশে ২০২৪ সালের আগস্ট মাসের বন্যা।

বাংলাদেশে ২০২৪ সালের আগস্ট মাসের বন্যা। ইউটিউব থেকে পর্দাছবি আল জাজিরা নিউজের। ফেয়ার ইউজ।

বাংলাদেশের পূর্ব সীমান্তবর্তী ১২টি জেলায় স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। সেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষ পানিবন্দী, গৃহহীন, খাবারবিহীন অবস্থায় রয়েছেন। ২৯শে আগস্ট পর্যন্ত বন্যায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৫২ হয়েছে

বানের পানিতে আটক মানুষদের উদ্ধারে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ট্রাকে করে নৌকা, স্পিডবোট নিয়ে বন্যা প্লাবিত এলাকায় যাচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবী মানুষজন। অনেকে কাভার্ড ভ্যান, পিকআপ, মাইক্রোবাসে করে নিয়ে যাচ্ছেন শুকনো খাবার, ঔষধ, নিরাপদ পানি, চাল-ডাল। সরকারি-বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের একদিনের বেতন ত্রাণ তহবিলে দান করেছে। এছাড়াও, দেশের মোবাইল অপারেটরগুলি বন্যা দুর্গতদের জন্য বিনামূল্যে টকটাইম এবং ইন্টারনেট পরিষেবা দিচ্ছে।

সাধারণ মানুষজনও সামর্থ্য অনুযায়ী স্বেচ্ছাসেবীদের কাছে টাকা-পয়সা, ত্রাণসামগ্রী দিচ্ছেন। পাবলিক কিংবা প্রাইভেট সেক্টরের সবাই যার যার জায়গা থেকে দাঁড়াচ্ছেন বানভাসী মানুষদের পাশে। সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই বলছেন, দুর্যোগ ঘিরে এমন ‘একতাবদ্ধ বাংলাদেশ’ আগে দেখেননি তারা।

সাংবাদিক মেহেদি হাসান মারুফ এক্স প্লাটফর্মে পোস্ট করেছেন:

বাংলাদেশে বন্যা পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে কারণ ৮টি নদীর পানি বিপদসীমার উপরে উঠে গেছে। যার ফলে কুমিল্লা, ফেনী, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী এবং মৌলভীবাজার জুড়ে ৫০ লাখ এর বেশী মানুষ আটকা পড়েছে। বিদ্যুৎ নাই, রাস্তা ডুবে গেছে, আরও বৃষ্টির পূর্বাভাস। মুহুরী ও গোমতী নদীর পানির উচ্চতা ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে রোল মডেল হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ। দেশটির ইউনিয়নের ওয়ার্ড পর্যায় পর্যন্ত স্থানীয় সরকারের অধীনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি রয়েছে। কিন্তু ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়ে দেশত্যাগ করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর স্থানীয় পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিরা পালিয়ে থাকায় স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। তাই, অতি বৃষ্টি ও বন্যার পূর্বাভাস থাকলেও ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর পাশাপাশি মানবিক বিপর্যয় মোকাবেলায় তেমন কোনো পূর্বপ্রস্তুতি ছিল না। তবে, স্থানীয় সরকারের অধীনে স্বেচ্ছাসেবকদের নেতৃত্বে প্রস্তুতি ও ত্রাণ প্রচেষ্টা দেখা না গেলেও বন্যার্তদের পাশে সাধারণ মানুষ একসাথে এগিয়ে এসেছেন।

বাংলাদেশে বন্যায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন ১০ লাখ ৪৭ হাজারের বেশি পরিবার। আর ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৫২ লাখ। বিপ্লব সরকার তুলির আঁচড়ে বন্যা কবলিত মানুষের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরেছেন। চিত্রকর্মটি অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে।

ছাত্রনেতৃত্বে ত্রাণ প্রচেষ্টা

সাম্প্রতিক ছাত্রজনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সংগঠনের দুই সমন্বয়ক ২১ আগস্টে ‘গণ-ত্রাণ সংগ্রহের’ ঘোষণা দেন। তাদের আহ্বানের পরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) ত্রাণ পৌঁছে দিতে হাজারো মানুষের ঢল নামে। ব্যক্তিগত গাড়ি থেকে শুরু করে, ট্রাক, সিএনজি, রিকশা বা হাতে করে অসংখ্য মানুষ ত্রাণ দিতে আসেন।

টিএসসি’র ত্রাণ-যজ্ঞের ভিডিও দিয়ে জানে আলম লিখেছেন:

বাচ্চারাও তাদের জমানো টাকা ত্রাণ তহবিলে দিচ্ছে, এমন ছবি পোস্ট করেছেন ইউজার মিমিওন:

অনেক ছোট বাচ্চা তাদের মাটির বা প্লাস্টিকের ব্যাঙ্কে যা কিছু টাকা ছিল তা দান করেছে।

স্থান- ত্রাণ সংগ্রহ বুথ টিএসসি/ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

কার্যক্রমের প্রথম সপ্তাহে বৈষম্যাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এই উদ্যোগে টিএসসিতে জমা পরেছে ৭ কোটি ৭৮ লাখ ৭৬ হাজার টাকা৷ নগদ অর্থের পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষেরা যে পরিমাণ ত্রাণসামগ্রী টিএসসিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কাছে তুলে দিয়েছেন, তা বহন করতে প্রায় ৫০টি ট্রাক লেগেছে৷

দুর্যোগ ঘিরে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ঐক্য গড়ে উঠেছে, সেটা নিয়ে দ্যা প্রোটেস্টার এক্স-এ পোস্ট দিয়েছেন:

বাংলাদেশের মানুষের ঐক্য। এই জাতিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না।
জুলাই: তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে।
আগস্ট: বন্যার্তদের সহায়তায় আবারো একতাবদ্ধ হয়েছে।

বন্যার্তদের উদ্ধারে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর মেডিক্যাল টিমও চিকিৎসাসহায়তায় কাজ করছে।

সেনাবাহিনী, নৌ-বাহিনী, কোস্টগার্ডের পাশাপাশি বন্যা কবলিত মানুষদের উদ্ধারে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে স্বেচ্ছাসেবীরা ট্রাকে করে স্পিডবোট, নৌকা নিয়ে রওনা হওয়ার ছবি-ভিডিও শেয়ার হতে দেখা গেছে সোশ্যাল মিডিয়ার প্ল্যাটফর্মগুলোতে।

বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। দেশের মসজিদের সংখ্যা ৩ লাখের উপরে। গত শুক্রবার মসজিদগুলো থেকে জুম্মার নামাজের সময় বন্যার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানানো হয়েছে। অনেক মসজিদ থেকেই সাহায্য তোলা হয়েছে। আস সুন্নাহ্ ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, তারা এখন পর্যন্ত বন্যার্তদের সহায়তার জন্য ২০ কোটি টাকার বেশি অনুদান পেয়েছে। সেই অর্থ দিয়ে তারা বন্যাদুর্গত এলাকায় ত্রাণ কার্যক্রম চালাচ্ছে। আবার সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষেরাও তাদের দুর্গোৎসবের বাজেট থেকে বন্যার্তদের অর্থ সহায়তা করেছেন।

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্বেচ্ছাসেবীদের মানুষের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে ত্রাণ সংগ্রহ করতে দেখা গেছে।

বন্যার্তদের সহায়তায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে কনসার্ট অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই কনসার্ট থেকে অর্থের পাশাপাশি পানি বিশুদ্ধকারী ট্যাবলেট, প্রয়োজনীয় ওষুধ, শুকনা খাবার এবং স্যানেটারি প্যাড জোগাড় করা হয়েছে।

ভারতীয় সাংবাদিক নাভিন টুইট করেছেনঃ

বন্যার্তদের সহায়তায় ঢাকায় ব্যান্ডদলগুলো গান করছে।

বন্যায় প্রাণিদেরও বিপদ কম নয়। তাদের পাশেও এসে দাঁড়িয়েছে মানুষ।

কেউই আমাদের ঐক্য ভাঙতে পারবে না। বাংলাদেশের বন্যার্ত মানুষ ও পশুপাখিদের জন্য প্রার্থনা করছি।

যেকোনো দুর্যোগে মানুষ মানুষের পাশে ছুটে যায়- এটিই বাংলাদেশের অন্যতম সৌন্দর্যময় বৈশিষ্ট্য। এবারের বন্যায় সেই দৃশ্যই আবার দেখা গেল।

বন্যা কবলিত এলাকাগুলোর পুনর্বাসনের জন্য এডিবির কাছে ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাজেট সহায়তার অনুরোধ করেছে বাংলাদেশ সরকার। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, মুহাম্মদ ইউনূস, বন্যা পুনর্বাসনের জন্য হাজার কোটি টাকার বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেশের এনজিও এবং দাতাদের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহ শুরু করেছেন

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .