বাংলাদেশের পূর্ব সীমান্তবর্তী ১২টি জেলায় স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। সেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষ পানিবন্দী, গৃহহীন, খাবারবিহীন অবস্থায় রয়েছেন। ২৯শে আগস্ট পর্যন্ত বন্যায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৫২ হয়েছে।
বানের পানিতে আটক মানুষদের উদ্ধারে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ট্রাকে করে নৌকা, স্পিডবোট নিয়ে বন্যা প্লাবিত এলাকায় যাচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবী মানুষজন। অনেকে কাভার্ড ভ্যান, পিকআপ, মাইক্রোবাসে করে নিয়ে যাচ্ছেন শুকনো খাবার, ঔষধ, নিরাপদ পানি, চাল-ডাল। সরকারি-বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের একদিনের বেতন ত্রাণ তহবিলে দান করেছে। এছাড়াও, দেশের মোবাইল অপারেটরগুলি বন্যা দুর্গতদের জন্য বিনামূল্যে টকটাইম এবং ইন্টারনেট পরিষেবা দিচ্ছে।
সাধারণ মানুষজনও সামর্থ্য অনুযায়ী স্বেচ্ছাসেবীদের কাছে টাকা-পয়সা, ত্রাণসামগ্রী দিচ্ছেন। পাবলিক কিংবা প্রাইভেট সেক্টরের সবাই যার যার জায়গা থেকে দাঁড়াচ্ছেন বানভাসী মানুষদের পাশে। সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই বলছেন, দুর্যোগ ঘিরে এমন ‘একতাবদ্ধ বাংলাদেশ’ আগে দেখেননি তারা।
সাংবাদিক মেহেদি হাসান মারুফ এক্স প্লাটফর্মে পোস্ট করেছেন:
Floods in Bangladesh worsen as 8 rivers surge above danger levels, leaving 5M+ stranded across Cumilla, Feni, Chattogram, Khagrachhari, Noakhali, & Moulvibazar. Power out, roads cutoff, & more rain forecasted. Muhuri & Gomati Rivers at their highest in 40 years. #BangladeshFloods pic.twitter.com/z6hAZ6DjF2
— Mehedi Hasan Marof (@MehediMarof) August 22, 2024
বাংলাদেশে বন্যা পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে কারণ ৮টি নদীর পানি বিপদসীমার উপরে উঠে গেছে। যার ফলে কুমিল্লা, ফেনী, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী এবং মৌলভীবাজার জুড়ে ৫০ লাখ এর বেশী মানুষ আটকা পড়েছে। বিদ্যুৎ নাই, রাস্তা ডুবে গেছে, আরও বৃষ্টির পূর্বাভাস। মুহুরী ও গোমতী নদীর পানির উচ্চতা ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে রোল মডেল হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ। দেশটির ইউনিয়নের ওয়ার্ড পর্যায় পর্যন্ত স্থানীয় সরকারের অধীনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি রয়েছে। কিন্তু ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়ে দেশত্যাগ করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর স্থানীয় পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিরা পালিয়ে থাকায় স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। তাই, অতি বৃষ্টি ও বন্যার পূর্বাভাস থাকলেও ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর পাশাপাশি মানবিক বিপর্যয় মোকাবেলায় তেমন কোনো পূর্বপ্রস্তুতি ছিল না। তবে, স্থানীয় সরকারের অধীনে স্বেচ্ছাসেবকদের নেতৃত্বে প্রস্তুতি ও ত্রাণ প্রচেষ্টা দেখা না গেলেও বন্যার্তদের পাশে সাধারণ মানুষ একসাথে এগিয়ে এসেছেন।
ছাত্রনেতৃত্বে ত্রাণ প্রচেষ্টা
সাম্প্রতিক ছাত্রজনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সংগঠনের দুই সমন্বয়ক ২১ আগস্টে ‘গণ-ত্রাণ সংগ্রহের’ ঘোষণা দেন। তাদের আহ্বানের পরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) ত্রাণ পৌঁছে দিতে হাজারো মানুষের ঢল নামে। ব্যক্তিগত গাড়ি থেকে শুরু করে, ট্রাক, সিএনজি, রিকশা বা হাতে করে অসংখ্য মানুষ ত্রাণ দিতে আসেন।
টিএসসি’র ত্রাণ-যজ্ঞের ভিডিও দিয়ে জানে আলম লিখেছেন:
টিএসসিতে গাড়ির লাইন, মানুষের ভীড় প্রত্যেকটা গাড়ি ভর্তি ব্যক্তিগত উদ্যোগে সংগ্রহ করা ত্রাণ। এতো মানুষ ত্রাণ দিতে এসেছে যে ভলান্টিয়াররা রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে ত্রাণ নিতে।
এরা ত্রান নিতে আসে নাই আসছে♥️ এমন বাংলাদেশ-ই তো চাচ্ছি♥️♥️ pic.twitter.com/9Y8U8WpACI— Jane alam (@Janeala68677775) August 23, 2024
বাচ্চারাও তাদের জমানো টাকা ত্রাণ তহবিলে দিচ্ছে, এমন ছবি পোস্ট করেছেন ইউজার মিমিওন:
So many little kids donated whatever money they had in their plastic piggy banks.
Location- Relief Collection Booth TSC/DU
Credit: Daniel Afzalur Rahman ( on facebook) #Bangladesh #BangladeshFlood #BangladeshFlood2024 pic.twitter.com/30h8CBQW4B
— M (@meeemion) August 24, 2024
অনেক ছোট বাচ্চা তাদের মাটির বা প্লাস্টিকের ব্যাঙ্কে যা কিছু টাকা ছিল তা দান করেছে।
স্থান- ত্রাণ সংগ্রহ বুথ টিএসসি/ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
কার্যক্রমের প্রথম সপ্তাহে বৈষম্যাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এই উদ্যোগে টিএসসিতে জমা পরেছে ৭ কোটি ৭৮ লাখ ৭৬ হাজার টাকা৷ নগদ অর্থের পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষেরা যে পরিমাণ ত্রাণসামগ্রী টিএসসিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কাছে তুলে দিয়েছেন, তা বহন করতে প্রায় ৫০টি ট্রাক লেগেছে৷
দুর্যোগ ঘিরে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ঐক্য গড়ে উঠেছে, সেটা নিয়ে দ্যা প্রোটেস্টার এক্স-এ পোস্ট দিয়েছেন:
The Unity of Bangladeshi People!
This Nation Cannot be Held Down by Anyone.July : They Became United to Step Down ex PM Fascist Hasina.
August : Again United to Help Flood Victims. #Bangladesh #BangladeshFlood #IndiaOut #BoycottIndia #FloodInBangladesh #FloodCrisisBd pic.twitter.com/kvYTnMcEhc— The Protester 𓆝 𓆟 𓆞 𓆝 𓆟 (@TheProtesterBD) August 23, 2024
বাংলাদেশের মানুষের ঐক্য। এই জাতিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না।
জুলাই: তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে।
আগস্ট: বন্যার্তদের সহায়তায় আবারো একতাবদ্ধ হয়েছে।
বন্যার্তদের উদ্ধারে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর মেডিক্যাল টিমও চিকিৎসাসহায়তায় কাজ করছে।
বন্যা কবলিত এলাকায় উদ্ধার কাজে নেমে পড়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
We are really proud of Bangladesh Army. pic.twitter.com/7bHe0zFn7z— Md. Sabbir Ahmed (@FmSabbirahmed) August 21, 2024
সেনাবাহিনী, নৌ-বাহিনী, কোস্টগার্ডের পাশাপাশি বন্যা কবলিত মানুষদের উদ্ধারে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে স্বেচ্ছাসেবীরা ট্রাকে করে স্পিডবোট, নৌকা নিয়ে রওনা হওয়ার ছবি-ভিডিও শেয়ার হতে দেখা গেছে সোশ্যাল মিডিয়ার প্ল্যাটফর্মগুলোতে।
এটাই সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির বাংলাদেশ।চট্টগ্রামের হৃদয়বান মানুষ গুলো শত শত বোট নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ফেনী বন্যা কবলিত এলাকায়। pic.twitter.com/QdiEZaWoAu
— Anika ₐₙgₑₗₑ (ₜₛ)ₒₛ (@anikaos06) August 22, 2024
বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। দেশের মসজিদের সংখ্যা ৩ লাখের উপরে। গত শুক্রবার মসজিদগুলো থেকে জুম্মার নামাজের সময় বন্যার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানানো হয়েছে। অনেক মসজিদ থেকেই সাহায্য তোলা হয়েছে। আস সুন্নাহ্ ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, তারা এখন পর্যন্ত বন্যার্তদের সহায়তার জন্য ২০ কোটি টাকার বেশি অনুদান পেয়েছে। সেই অর্থ দিয়ে তারা বন্যাদুর্গত এলাকায় ত্রাণ কার্যক্রম চালাচ্ছে। আবার সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষেরাও তাদের দুর্গোৎসবের বাজেট থেকে বন্যার্তদের অর্থ সহায়তা করেছেন।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্বেচ্ছাসেবীদের মানুষের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে ত্রাণ সংগ্রহ করতে দেখা গেছে।
পথে নামলে বোঝা যাচ্ছে,আমরা লালনের মাটিতেই থাকি।বন্যার্ত মানুষের জন্য সহমর্মী মানুষের সাহায্য পৌঁছে দিতে আমরা গান গেয়ে হাঁটছি,আজ দ্বিতীয় দিন।আবার একজন অপরিচিত মানুষ যোগ দিলেন।
মাগুরা – ২৪.০৮.২৪।স্বত্ব: নাফিসা নাওয়ার নিঝুম pic.twitter.com/2yicx1C9y4
— Md Al Amin Mia🇧🇩 🇵🇸🕊 (@Mdalaminmia7890) August 24, 2024
বন্যার্তদের সহায়তায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে কনসার্ট অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই কনসার্ট থেকে অর্থের পাশাপাশি পানি বিশুদ্ধকারী ট্যাবলেট, প্রয়োজনীয় ওষুধ, শুকনা খাবার এবং স্যানেটারি প্যাড জোগাড় করা হয়েছে।
ভারতীয় সাংবাদিক নাভিন টুইট করেছেনঃ
Bands perform in Dhaka to aid Bangladesh's flood-hit people https://t.co/xtp5tWEaQS
— Naveen S Garewal (@naveengarewal) August 24, 2024
বন্যার্তদের সহায়তায় ঢাকায় ব্যান্ডদলগুলো গান করছে।
বন্যায় প্রাণিদেরও বিপদ কম নয়। তাদের পাশেও এসে দাঁড়িয়েছে মানুষ।
𝗡𝗼𝘁𝗵𝗶𝗻𝗴 𝗰𝗮𝗻 𝘀𝗲𝗽𝗮𝗿𝗮𝘁𝗲 𝘂𝘀 🙏🏾
Keeping the flood-affected people and animals of Bangladesh in thoughts and prayers. #FloodInBangladesh #SaveBangladesh #BangladeshFlood #Flood #Bangladesh pic.twitter.com/oQYVjX34tX— Ajay Joe (@joedelhi) August 23, 2024
কেউই আমাদের ঐক্য ভাঙতে পারবে না। বাংলাদেশের বন্যার্ত মানুষ ও পশুপাখিদের জন্য প্রার্থনা করছি।
যেকোনো দুর্যোগে মানুষ মানুষের পাশে ছুটে যায়- এটিই বাংলাদেশের অন্যতম সৌন্দর্যময় বৈশিষ্ট্য। এবারের বন্যায় সেই দৃশ্যই আবার দেখা গেল।
বন্যা কবলিত এলাকাগুলোর পুনর্বাসনের জন্য এডিবির কাছে ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাজেট সহায়তার অনুরোধ করেছে বাংলাদেশ সরকার। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, মুহাম্মদ ইউনূস, বন্যা পুনর্বাসনের জন্য হাজার কোটি টাকার বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেশের এনজিও এবং দাতাদের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহ শুরু করেছেন।