মিয়ানমার থেকে থাইল্যান্ড: বাস্তুচ্যুত সাংবাদিকরা তাদের গল্প বলছে

Journalist Ja

সাংবাদিক জা গাড়ি ও মোটরসাইকেলের জন্যে দুর্গম পাহাড়ি এলাকার খবর জানাতে পায়ে হেঁটে যাচ্ছেন: উৎস: প্রচাতাই (সরবরাহকৃত ছবি)

মূলত থাইল্যান্ডের স্বাধীন সংবাদ সাইট প্রাচাতাই প্রকাশিত সিচা রুংরোজতানাকুলের এই নিবন্ধটির একটি সম্পাদিত সংস্করণ বিষয়বস্তু ভাগাভাগি চুক্তির আওতায় গ্লোবাল ভয়েসেসে পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে।

মিয়ানমারে ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর থেকে, সামরিক জান্তা দেশটির নাগরিকদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়নের অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। হয়রানির লক্ষ্যবস্তু অনেক গোষ্ঠীর একটি প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলিকে কভার করা স্বাধীন সাংবাদিকবৃন্দ। অনেকে অবৈধভাবে থাইল্যান্ডে পালিয়ে গেছে। কেউ কেউ পরে অভিবাসী শ্রমিক দাবি করে তাদের অভিবাসন মান বৈধ করলেও বেশিরভাগ সাংবাদিক তাদের মূল পেশা গোপন রাখতে বাধ্য হয়েছে।

বিগত তিন বছরে নারীএলজিবিটিকিউ+ সাংবাদিকরা যৌন হয়রানি মোকাবেলা ও বাস্তুচ্যুত হয়েও পরিবারের সদস্যদের দেখাশোনার ভার নিতে গিয়ে মাঠ পর্যায়ে তাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়েছে। একই সময়ে তারা স্থানীয় উৎসগুলির সাথে যোগাযোগ ও থাইল্যান্ডে আইনি মর্যাদা পাওয়ার জন্যে সংগ্রাম করার অতিরিক্ত অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছে।

নির্বাসিত সাংবাদিক

প্রায় ১৪ বছরের বেশি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সাংবাদিক মি (ছদ্মনাম) থাইল্যান্ডের একটি সীমান্ত শহরে গোপনে সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার জন্যে ইয়াঙ্গুন থেকে পালিয়ে যান। অভ্যুত্থানের আগে তিনি স্বাধীনভাবে প্রতিবেদন করতে পারলেও অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্র কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে।

প্রতিরোধে যোগ দিয়েও তিনি মিয়ানমারে গোপনে কাজ করতে থাকেন। তবে অভ্যুত্থানের দুই বছর পর সামরিক কর্তারা তার অনুপস্থিতিতে তার বাড়ির আশেপাশে তল্লাশি চালালে তিনি থাইল্যান্ডে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পরিবারের উপার্জনকারী হিসেবে তিনি এখানে একজন প্রতিবেদক হিসেবে কাজ চালিয়ে গেছেন।

শিক্ষা'র্থী ভিসায় থাইল্যান্ডে বৈধভাবে বসবাস করতে মি’কে ৫০ হাজার থাই বাথ (প্রায় ১.৭৬ লক্ষ টাকা) খরচ করতে হয়েছে। অনলাইনে সাংবাদিকতা করার সময় মি বেশিরভাগ সময় ক্লাসে কাটান। দেশ থেকে রাজনৈতিক চাপ এবং থাইল্যান্ড থেকে দূর থেকে কাজ করা তার মানসিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলেছে।

আমি (থাইল্যান্ডে) আসার পর আমি নিজেকে প্রশ্ন করেছি কেন আমি নিজেকে এই সবের মধ্যে জড়িয়েছি। ইতোমধ্যে কাজের যথেষ্ট চাপ তৈরি হয়েছে। এখন মাসিকের এক সপ্তাহ আগেই আমি বিস্ফোরিত হওয়ার মতো চাপে পড়ে যাই। এতটাই যে মাঝে মাঝে ভাবি জীবনের আদৌ কোনো উদ্দেশ্য আছে কিনা।

নিজ দেশে হয়রানির শিকার ১০ বছরের বেশি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন আরাকানি (রাখাইন) সাংবাদিক কে জুয়ে থাইল্যান্ডে যাওয়ার কাগজপত্র করতে কিছু টাকা বিনিয়োগ করেন।

গর্ব করে আমাদের বলেছিলেন অভ্যুত্থানের আগে তিনি আরাকান রাজ্যের সংঘাত বিশেষজ্ঞ হিসেবে ইয়াঙ্গুন-ভিত্তিক মিজিমা সংবাদ সংস্থায় কাজ করতেন। অভ্যুত্থানের পর পদত্যাগ করে তিনি “আরাকান সাগাওয়ার” নামে রোহিঙ্গা ও আরাকানি এই  দুটি ভাষায় স্থানীয় সংবাদ পরিবেশক একটি স্থানীয় সংবাদ সংস্থা প্রতিষ্ঠা করতে দেশে ফিরে আসেন। একদিন তার অনুপস্থিতিতে মিয়ানমারের সামরিক কর্তারা তার বাড়িতে গেলে, তিনি থাইল্যান্ডে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

কে জুয়ে ও তার সঙ্গী একসঙ্গে অবৈধভাবে মিয়ানমার-থাই সীমান্ত অতিক্রম করেন। তিনি এখন ফ্রিল্যান্সার হিসেবে মিজিমা সংবাদের একটি রেডিও অনুষ্ঠান চালানোর কাজ করেন, যা লে ওয়াদি এফএমেও সম্প্রচারিত হয়। তার সঙ্গী চাকরির জন্যে একটি কারখানায় আবেদন করেছে।

শুরুতে … আরাকান রাজ্যে ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্নের কারণে আমরা আমাদের পরিবার নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলাম। আমি শুধু প্রতিবেদন পাঠানো চালিয়ে যেতে পারতাম। আমরা আরাকান রাজ্যের জনগণের তথ্যে প্রবেশাধিকার বজায় রাখতে চাইতাম বলে মিজিমা আমাকে একটি রেডিও সংবাদ অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে দেয়।

কাজ ছাড়াও থাইল্যান্ডে অধিকতর এলজিবিটিকিউ+ সহনশীল থাই সমাজে বসবাস দম্পতিটির জন্যে অনেক কিছু। দেশে ফিরে গেলে তাদের পরিবার তাদের সম্পর্ক মানবে না।

কাগজপত্র জোগাড়ের পর কে জুয়ে একটি ছোট আয়োজন করে তার সঙ্গীকে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখেন। তবে তাকে এখনো তার পেশা গোপন করতে হবে।

জঙ্গলে নারী সাংবাদিকের জীবন

অভ্যুত্থানের পর অনেক নারী সাংবাদিক নিজেদেরকে জাতিস্বত্তার সশস্ত্র গোষ্ঠী ও প্রতিরোধ যোদ্ধা নিয়ন্ত্রিত এলাকায় সরেজমিন প্রতিবেদক হিসেবে প্র্তিষ্ঠিত করতে চায়। নারী হিসেবে জঙ্গল জীবনের কষ্ট ও পুরুষ-শাসিত পরিবেশে কাজ করতে গিয়ে তারা নিরাপত্তা উদ্বেগসহ বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে জা (ছদ্মনাম) গণমাধ্যমে কাজ করলেও অভ্যুত্থানের পর জান্তা তারটিসহ অনেক সংবাদ প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়। কয়েক মাস পরে কারেন রাজ্যে নতুন চাকরি পেয়ে তিনি ২০ জন সহকর্মীর সাথে একটি উদ্বাস্তু গ্রামের একটি বাড়িতে থাকতেন। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নেই, বিদ্যুৎ নিজেদেরই তৈরি ও কাঠকয়লা দিয়ে রান্না করতে হয়।  বিশুদ্ধ পানির অভাবে সবাইকে একই কূপের পানি পান করতে হয়। স্নান করতে ১৫ মিনিটের পথ। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড গরমে ফ্যান ছাড়া ঘুমানো কঠিন। বর্ষাকালে বেশি বৃষ্টির প্রভাবে গ্রামের জেনারেটর কুলিয়ে ওঠে না। ইন্টারনেট ও টেলিফোন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বৃষ্টির শব্দে সম্প্রচারও বিঘ্নিত হয়।

জা’র কভার এলাকা প্রায়ই বিমান হামলার লক্ষ্যবস্তু হ্তো। তিনি ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাসে কারেন রাজ্যের অন্য একটি অংশে একটি সশস্ত্র দলের সাথে চলার সময় মাথার উপরে প্রায়শই যুদ্ধবিমান দেখতে পেতেন।

“আমি একটি রাতও ভালো ঘুমাতে পারিনি,” তিনি বলেন।

মাথার উপর দিয়ে যতোবার বিমান গর্জন করেছে, ততোবারই তিনি বাঙ্কারের দিকে ছুটে গেছেন। কাছাকাছি বোমা পড়ার শব্দ ও বিস্ফোরণে ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়িগুলি তাকে শব্দটিতে আতঙ্কিত করতো।

মিয়ানমারে গণমাধ্যমের নারীর প্রতিষ্ঠাতা টিন জার অং অভ্যুত্থানে অনেক নারী সাংবাদিকদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার কথা উল্লেখ করেছেন। সীমান্ত অতিক্রমের সাথে সাথে তার মধ্যে কিছু ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। মিয়ানমারে থাকাকালীন বেশিরভাগ নিদ্রাহীনতার শিকার হলেও থাইল্যান্ডে রাতের হামলার ভয় না থাকায় তাদের ঘুম ভাল হয়েছিল।

বসবাসের অনুমতি সংক্রান্ত সমস্যা

অভিবাসী কর্মী গোষ্ঠীর মতে, কোনো ব্যক্তির থাইল্যান্ডে বৈধভাবে বসবাস ও কাজ করতে অবশ্যই একটি বৈধ অস্থায়ী বসবাসের অনুমতি, ব্যক্তিগত শনাক্তকরণ নথি, একটি পাসপোর্ট ও ভিসা, অথবা থাই নয় এমন নাগরিক হিসেবে একটি পরিচয়পত্র এবং একটি কর্ম অনুমতি থাকতে হবে।

প্রাচাতাইয়ের নেওয়া বাস্তুচ্যুত সাংবাদিকদের সাক্ষাৎকার অনুসারে মি’র শিক্ষাগত ভিসা, অভিবাসী কর্মী হিসেবে জায়ের কাজের অনুমতিপত্র এবং কে জুয়ে অভিবাসী কর্মী হিসেবে থাকার আবেদন রয়েছে।

ডালিয়া কারেন রাজ্যে জন্ম নিলেও স্বদেশে সশস্ত্র সংঘর্ষের কারণে দশ বছর বয়সে থাইল্যান্ডে চলে যাওয়া একজন কারেন সাংবাদিক। তার কাছে থাকা একজন ব্যক্তির জন্যে জারি করা একটি অনিবন্ধিত পরিচয়পত্র তাকে থাইল্যান্ডে বসবাস করতে ও প্রদেশটিতে ঘুরে বেড়াতে দেয়। প্রদেশ ছেড়ে যেতে তাকে অবশ্যই জেলা অফিসের অনুমতি নিতে হয়।

তারা অন্যান্য দেশ থেকে আসা সাংবাদিকদের মতো থাই রাষ্ট্রের প্রেস সদস্য হিসেবে স্বীকৃত নয়।

জা স্মরণ করেন এসব কাগজপত্র যোগাতে তার অনেক সময় লেগেছিল। তিনি থানার কর্মকর্তা ও পুরুষ দোভাষীর হয়রানি ও অভদ্র আচরণের কথাও স্মরণ করেন। পুলিশ তার ছবি, ভিডিও ও পাঠ্যসহ তার ব্যক্তিগত ডেটা দেখার জন্যে তাকে তার ফোন আনলক করতে বাধ্য করে। দোভাষী বিবাহিত কিনা জিজ্ঞেস করে তিনি বেড়াতে যাবেন কিনা জানার চেষ্টা করে এবং তার নম্বর নেওয়ার জন্যে তার ফোন থেকে নিজেকে কল করে।

“আমি ভীত ও রাগান্বিত হলেও সে আমাকে গ্রেপ্তারের কারণ খুঁজে পাবে বলে আমি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাইনি। যেহেতু আমি থানায় ছিলাম তাই,” জা বলেন।

জা ২০২৩ সালে চিয়াং মাইতে চলে আসেন। তার বসবাসের প্রাক্তন সীমান্ত শহরের তুলনায় তিনি এই পর্যটন শহরে ভিন্ন পরিবেশ দেখতে পান। সেখানে তাকে দুবার গ্রেপ্তার করা হয় এবং তিনি মিয়ানমারের অন্যান্য জনগণের মতো কঠোর নিয়ন্ত্রণাধীন  এবং কর্তৃপক্ষের চাঁদাবাজির লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন। চিয়াং মাইতে চলে যাওয়ার পর তার পাওয়া নথিপত্র তাকে থাইল্যান্ডে বসবাসের এবং অন্যান্য প্রদেশে ভ্রমণের অনুমতি দেয়। পুরো প্রক্রিয়াটি এক বছর সময় নিয়েছিল। তিনি এখন থাইল্যান্ডে নিরাপদ বোধ করলেও সাংবাদিক হিসেবে নিবন্ধন বা কাজ করতে পারছেন না।

আমি এখনো একজন সাধারণ কর্মী হিসেবে নিবন্ধিত। থাইল্যান্ডে এখনো মিয়ানমারের সাংবাদিক হিসেবে কাজ করা বৈধ নয়। আমাদের কাছে সংবাদ সংস্থা পরিচালনা করার অনুমতি না থাকায় পুলিশ আমাদের অফিসে অভিযান চালিয়ে আমাদের গ্রেপ্তার করতে পারে বলে আমি এখনো উদ্বিগ্ন।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .