বাংলাদেশে আকস্মিক বন্যা, সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘ভারতীয় হাত’ এর অভিযোগ

ফেনী ও নোয়াখালীতে আকস্মিক বন্যা। বায়োস্কোপ এন্টারটেইনমেন্টের ইউটিউব ভিডিও থেকে স্ক্রিনশট। ন্যায্য ব্যবহার।

ফেনী ও নোয়াখালীতে আকস্মিক বন্যা। বায়োস্কোপ এন্টারটেইনমেন্টের ইউটিউব ভিডিও থেকে স্ক্রিনশট। ন্যায্য ব্যবহার।

উজানে ভারতের ত্রিপুরা থেকে নেমে আসা ঢল ও গত কয়েক দিনের প্রবল বর্ষণে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় আকস্মিক বন্যা দেখা দিয়েছে। পানিবন্দী ও ক্ষতির মুখে পড়েছেন লাখ লাখ মানুষ। আগস্ট মাসের ২৪ তারিখ পর্যন্ত ১৮ জন মারা গেছেন বলে জানা গেছে।

১২টি জেলার ৫০ লক্ষেরও বেশি মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিন লাখেরও বেশি মানুষ কয়েক হাজার জরুরি আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছেন, যাদের জন্য সাহায্য, আবাসন এবং পুনর্বাসনের জরুরী প্রয়োজন।

বৃষ্টি আর উজান থেকে নেমে আসা ঢলে এসব জেলায় বন্যা নতুন কিছু নয়। কিন্তু এবারের বন্যা ভয়াবহতায় আগের সব বন্যাকে ছাড়িয়ে গেছে। বন্যা কবলিত এলাকার বাসিন্দারা এমন ভয়াবহ বন্যা তাদের জীবদ্দশায় দেখেননি বলে জানিয়েছেন। গ্রামের পর গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে। সবার বাড়িঘরেই বন্যার পানি।

কথাসাহিত্যিক স্বকৃত নোমানের গ্রামের বাড়িতেও বন্যার পানি ঢুকেছে। তিনি সেখানকার পরিস্থিতি নিয়ে ফেসবুকে লিখেছেন:

[…] বাড়িতে কারো সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করতে পারছি না। বিদ্যুৎ নেই, নেট নেই। মায়ের সাথে শেষ কথা হয়েছিল পরশুদিন। তারপর যোগাযোগ বন্ধ।
স্বজনেরা বেঁচে আছে, না ভেসে গেছে জানি না। কোনোভাবে বেঁচে থাকলেও খেতে না পেয়ে অবস্থা সঙ্গীন হয়ে পড়বে। কারণ নলকূপ ডুবে গেছে, খাবার পানি নেই। চুলা ভেসে গেছে, রান্নার উপায় নেই। হয়ত ফুরিয়ে গেছে দোকানপাটের শুকনো খাবারও।

এদিকে বন্যার কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ের বিভিন্ন জায়গায় পানি উঠেছে যার জন্যে ত্রাণ ও উদ্ধার কর্মসূচী ব্যহত হচ্ছে। শাখাওয়াত হোসেন আহাদ নামের এক্স (সাবেক টুইটার) ব্যবহারকারী বিমানে করে চট্টগ্রামের যাওয়ার পথে বন্যার চিত্র তুলে ধরে লিখেছেন:

বাংলাদেশ, সাধারণত দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য “রোল মডেল” হিসাবে পরিচিত। তরুপরি চলমান বন্যার জন্য পূর্বসতর্কতা ছিলনা এবং প্রস্তুতির অভাব ছিল। গত ৫ই আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে । সাধারণতঃ স্থানীয় সরকারের অধীনে স্বেচ্ছাসেবকদের নেতৃত্বে প্রস্তুতি ও ত্রাণ প্রচেষ্টা এবার দেখা যায়নি।

বন্যা বিপর্যয়কর হয়ে উঠার পিছনে ভারত দায়ী

এই আকস্মিক বন্যার পিছনে ‘ভারতের হাত’ আছে বলে বাংলাদেশের সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীরা অভিযোগ করেছেন। তাদের দাবি, ভারত ত্রিপুরার গোমতি বাঁধ খুলে দেয়ায় বাংলাদেশে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়েছে। যদিও বিশেষজ্ঞরা এটিকে প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন যে ত্রিপুরায় অত্যধিক বৃষ্টিপাতই বন্যার কারণ ছিল, তদুপরি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে উত্তেজনা অব্যাহত রয়েছে।

নাহিয়ান তাসনিম তার এক্স অ্যাকাউন্টে লিখেছেন:

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা হয়েছে। সাড়ে তিন লাখের বেশি মানুষ বন্যাক্রান্ত। বাংলাদেশকে না জানিয়ে ভারত মাঝরাতে ডম্বরু বাঁধ খুলে দেয়ায় বাংলাদেশ ব্যাপক ক্ষতি ও দুর্ভোগের শিকার।

বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষ আছেন যারা ভারতবিরোধী মনোভাব পোষণ করেন। সেটার দিকে ইঙ্গিত করে আতিয়া তামান্না লিখেছেন:

বাঁধের পানি ছেড়ে দিয়ে ভারত বাংলাদেশে কৃত্রিম বন্যার সৃষ্টি করেছে। আর আপনি আশ্চর্য হোন, বাংলাদেশের মানুষ কেন এতো ভারত বিরোধিতা করে।
মনে রাখবেন, ভারতের মতো প্রতিবেশী থাকলে আপনার শত্রুর প্রয়োজন নেই।

ভারত বাঁধ খুলে দেয়ায় বন্যা কীভাবে প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে, সেটা নিয়ে সাংবাদিক, নদী বিশেষজ্ঞ শেখ রোকন ফেসবুকে লিখেছেন:

[…]না জানিয়ে ড্যাম বা ব্যারাজ খুলে দিলে কী অসুবিধা? বন্যা তো এমনিতেই হচ্ছে। স্বাভাবিক বন্যা হতেই পারে, তাতে খুব একটা অসুবিধা নেই। কিন্তু যখন হঠাৎ ড্যাম বা ব্যারাজ খুলে দেওয়া হয়, তখন সেই বন্যা বিপর্যয়কর হতে বাধ্য। স্বাভাবিক বন্যায় হয়তো তিন দিন ধরে পানি বাড়ে ও চলে যায়। কিন্তু ড্যাম বা ব্যারাজ খুলে দিলে তিন দিনের বন্যা তিন ঘণ্টার ঘনত্বে চলে আসে। আর যদি ভাটির দেশকে না জানিয়ে ব্যারাজ ছাড়া হয়, তাহলে বন্যা মোকাবিলার প্রস্তুতি ও দুর্গতদের উদ্ধার তৎপরতার সময়ও থাকে না। জান ও মালের ক্ষতি অনেক বেশি হয়। এবার সেটাই ঘটেছে।

ভারতের ত্রিপুরার ধলাই জেলায় গোমতী নদীর ওপরে থাকা ডম্বুর বাঁধের গেট খুলে দেওয়ার কারণে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় সাম্প্রতিক বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে—বাংলাদেশের মানুষজনের এমন অভিযোগের ভিত্তিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিবৃতি দিয়েছে। অভিযোগটি সঠিক নয় জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়েছে:

ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত গোমতী নদীর অববাহিকা (ক্যাচমেন্ট) এলাকায় কয়েক দিন ধরে এ বছরের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশে এ বন্যা মূলত বাঁধের ভাটির দিকের বৃহৎ অববাহিকার পানির কারণে ঘটেছে।

বন্যায় আক্রান্ত বাংলাদেশের জেলাগুলো।

২০২৪ সালের আগস্ট মাসের বন্যায় আক্রান্ত বাংলাদেশের জেলাগুলো। ছবি উইকিপিডিয়া থেকে মেঘমল্লার২০১৭ এর সৌজন্যে. সৃজনী সাধারণ লাইসেন্স বাই ৪.০.


বিবৃতিতে ভারত পানিপ্রবাহ অত্যাধিক বেড়ে যাওয়ার তথ্য বাংলাদেশকে জানিয়েছে বলে উল্লেখ করে। ত্রিপুরার বর্ডার বাংলাদেশের সাথে রয়েছে তিন দিক থেকে এবং এটি আশেপাশের অঞ্চলের তুলনায় উঁচু জায়গায় অবস্থিত, যার অর্থ বন্যার জল প্রাকৃতিকভাবে বাংলাদেশের দিকে প্রবাহিত হয়।

তবে, সুনির্দিষ্টভাবে বাঁধের গেইট খোলার তথ্য না জানানোয় ‘বন্যাকে বিপর্যয়কর করে তুলেছে’ বলে শেখ রোকন দাবি করেছেন।

এদিকে বাঁধের গেট খুলে দেয়ার তথ্য অপপ্রচার উল্লেখ করে ত্রিপুরা রাজ্যের বিদ্যুৎমন্ত্রী রতন লাল নাথ বলেছেন:

গোমতি হাইড্রো ইলেকট্রিক প্রজেক্ট এর কোন গেইট খুলে দেওয়া হয়নি। রিজার্ভারের ধারণ ক্ষমতা ৯৪ মিটার পর্যন্ত। জল এই স্তর অতিক্রম করলেই অটোমেটিক্যালি গেট দিয়ে বেরিয়ে যাবে। আবার রিজার্ভারের জল স্তর ৯৪ মিটারের নিচে নেমে গেলে অটোমেটিক্যালি গেইট বন্ধ হয়ে যাবে। সেই মোতাবেক গোমতী রিজার্ভারের জল স্তর ৯৪ মিটার এর উপরে উঠে আসতেই দুটো গেট দিয়ে অটোমেটিক্যালি জল বেরুচ্ছে। […]

বাংলাদেশ ভারতের মধ্যে অভিন্ন নদীর সংখ্যা ৫৪টি। আন্তর্জাতিক নদী আইন লংঘন করে ভারত অনেক জায়গায় বাঁধ নির্মাণ করে একতরফা পানি প্রত্যাহার করে। ফলে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হয়ে মরুকরণের ঝুঁকিতে পড়ছে। আবার বর্ষা মৌসুমে বাঁধের গেট খুলে দিয়ে বাংলাদেশকে ভাসিয়ে দেয়। রাজধানীর ঢাকার দেয়ালচিত্রে সেটাই তুলে ধরেছেন একজন স্ট্রিট আর্টিস্ট:

জলবায়ু ঝুঁকিতে শীর্ষদশে বাংলাদেশ

ওয়ার্ল্ড ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স-এর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীর যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি জলবায়ু ঝুঁকিতে আছে, তার মাঝে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষ দশে। বাংলাদেশ সরকার জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা (ন্যাপ)-এ বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় ১৪টি জলবায়ু ঝুঁকি চিহ্নিত করে। এরমধ্যে অতিবৃষ্টি, বন্যা, আকস্মিক বন্যার মতো ঝুঁকিগুলোও রয়েছে।

গত ২৯ এপ্রিল ভারতের পুনে শহরে সাউথ এশিয়ান ক্লাইমেট আউটলুক ফোরামের ২৮তম সম্মেলন শুরু হয়। ওই সম্মেলনে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে বর্ষা মৌসুমের (জুন-সেপ্টেম্বর) আবহাওয়ার পূর্বাভাস নিয়ে আবহাওয়াবিদেরা “এল নিনো” দুর্বল হয়ে, “লা নিনা” সক্রিয় হওয়ার কথা জানান। এতে করে বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলে অতি বৃষ্টিপাত হয়ে বর্ষা শক্তিশালী হওয়ার কথা জানানো হয়।

কানাডার সাসকাচোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ু বিষয়ে পিএইচডি গবেষক আবহাওয়াবিদ মোস্তফা কামাল প্রথম আলোয় এক লেখায় বাংলাদেশ ও ত্রিপুরায় রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাত ও বন্যার জন্য আবহাওয়া সম্পর্কিত ৪টি কারণের কথা উল্লেখ করেছেন:

বাংলাদেশে ও ত্রিপুরা রাজ্যের ওপরে যে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি ও বন্যা হলো, তার জন্য আবহাওয়াসম্পর্কিত ৪টি প্রধান কারণ খুঁজে পাওয়া যায় প্রাথমিক তথ্য বিশ্লেষণ করে। ১. এল-নিনো ২. মেডেন-জুলিয়ান দোলন বা সংক্ষেপে এমজেও ৩. জেট স্ট্রিম ও ৪. বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট মৌসুমি লঘু চাপ।
[…]
দৈবক্রমে আগস্ট মাসের ১৫ তারিখের পর থেকে একই সঙ্গে ৪টি বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশ ও ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর ওপর একই সময় সক্রিয় অবস্থায় উপনীত হয়ে ৪টি বৈশিষ্ট্যের মিলিত প্রভাবে রেকর্ড পরিমাণে বৃষ্টিপাত ঘটিয়েছে।

বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ দিন দিন তীব্রতর হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে একের পর এক অর্থনীতি, সমাজ ও পরিবেশগত বিপদ আসছে। এজন্য পরিবেশবিদরা আগের চেয়ে আরও বেশি করে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার প্রস্তুতি ও উদ্যোগ নেয়ার কথা বলছেন।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .