এই গল্পটি নাগরিক গণমাধ্যম মানমন্দিরের এল সালভাদর, ব্রাজিল, তুরস্ক, সুদান এবং ভারতে শাসন, নিয়ন্ত্রণ ও নীতির জন্যে ব্যবহৃত ডেটা আখ্যান সনাক্ত ও বোঝার প্রকল্প ডেটা ন্যারেটিভসের অংশ। এখানে প্রকল্প সম্পর্কে আরো পড়ুন এবং নীচের পাঠ্যে কভার করা সম্পূর্ণ বিশ্লেষণের জন্যে আমাদের প্রকাশ্য ডেটাসেট দেখুন।
তুরস্ক ২০১৮ সাল থেকে ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি, মুদ্রার ব্যাপক অবমূল্যায়ন ও জীবনযাত্রার বর্ধিত ব্যয়সহ একটি গুরুতর অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন। কয়েক বছর আগে ১০০ তুর্কি লিরায় (প্রায় ৩৫২ টাকা, প্রাক-সংকট মূল্যমান ) তুরস্কে কয়েক দিন টেকা যেতো, কিন্তু বিশেষ করে বড় শহরগুলিতে আজকাল এই টাকায় বেশি কিছু কেনা যায় না।
মহানগর ইস্তাম্বুলে আজকাল সস্তা শ্রমজীবী শ্রেণির প্রধান খাবার একটি গ্রিল করা মাছ “বালিক একমেক” ও লেটুস পাতার স্যান্ডউইচের দাম ১২০ থেকে ১৫০ লিরা (১ লিরা = প্রায় ৩.৫২ টাকা)। এমনকি শহরের সরকারি যানবাহনের নেটওয়ার্কে চড়ে বালিক একমেকের জন্যে উপকূলের বিখ্যাত জেলা গোল্ডেন হর্ন ও ইস্তানবুলের ঐতিহাসিক পুরনো শহরের মিলনস্থল এমিনোনুতে একবার বাহন পরিবর্তন ধরে নিয়ে পৌঁছাতেও ১০৫ লিরা খরচ হয়। আবার বাড়িতে বসে থেকে কাছের ম্যাকডোনাল্ডসে একটি বিগ ম্যাক অর্ডার করলেও তার জন্যে আজকে ১৭০ লিরা খরচ হবে।
আপনার ইস্তাম্বুল অ্যাপার্টমেন্টে বসে দুপুরে না খেয়ে ১০০ লিরায় আপনি নিজের জন্যে কী করতে পারেন? তুরস্কের সাথে পরিচিতরা শুনে অবাক হবেন না এরকম একটা কাজ হলো বীমা ও ফোন নম্বর, ঠিকানা, কর্মসংস্থানের তথ্য, স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত তথ্য, সম্পত্তির দলিল ও সকল পারিবারিক সম্পর্কসহ তুরস্কের যেকোনো নাগরিক বা বাসিন্দার পরিচয়-সম্পর্কিত সকল ডেটা। লোকেরা সামান্য ১০০ লিরা দিয়ে এসব তথ্য এবং সাম্প্রতিক অতীতে তুরস্কে বসবাসকারী যেকোনো ব্যক্তির সম্পর্কে আরো কিছু কিনতে পারে। (বর্তমান দাম সামান্য ভিন্ন হতে পারে। তুরস্কে দাম দ্রুত পরিবর্তিত হয়; মুদ্রাস্ফীতি সাইবার অপরাধীদেরও প্রভাবিত করে। যদিও এটি এখনো ধূলোর মতো সস্তা।)
আপনি হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন এধরনের সংবেদনশীল তথ্য কীভাবে এতো সস্তা হয়? তবে কম প্রান্তিক খরচ বিশিষ্ট কোনো খাতে প্রতিযোগিতা বেশি হলে দাম কমতে থাকে। অন্য কথায়, প্রত্যেকের কাছেই রয়েছে বলে এটি সস্তা। তাই আসল প্রশ্নটি দাঁড়ায়, “কেন প্রত্যেকেরই এটি থাকে?”
এর উত্তর হলো ডেটা ফাঁস। তুরস্কের ডেটা ফাঁসের একটি দীর্ঘ ইতিহাস থাকায় এই নিবন্ধে তাদের প্রত্যেকটির বিশদ বিবরণ দেওয়া যাবে না। সর্বশেষ উল্লেখযোগ্য পাবলিক ডেটা লঙ্ঘনটি ঘটেছিল বছরখানেক আগে ২০২৩ সালে জুনের কাছাকাছি। ৮.৫ কোটি নাগরিকের ই-দেভলেতের (তুর্কি নাগরিক ও বাসিন্দাদের অনলাইনে সরকারি পরিষেবা প্রাপ্তির একটি ওয়েব-ভিত্তিক ব্যবস্থা) ডেটা চুরি হয়ে যায়। স্পষ্টতই সরকারের নাগরিকদের ডেটা সুরক্ষার পদক্ষেপগুলি এতোটাই দুর্বল ছিল যে ডেটা ফাঁসকারী হ্যাকাররাও এটি সম্পর্কে অভিযোগের পাশাপাশি রাষ্ট্রের ব্যক্তিগত ডেটা বেসরকারি সংস্থাগুলির কাছে বিক্রির অভিযোগ তোলে।
অন্যদিকে সরকার নিজের দায় অস্বীকার করছে। তুরস্কের রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ানের সরাসরি অধীনস্ত পরিষেবা ও সাইবার নিরাপত্তা ডিজিটালাকরণের বিভাগ ডিজিটাল রূপান্তর (ডিডিও) কার্যালয়ের প্রাক্তন সভাপতি আলী তাহা কোক ফাঁসের জন্যে বেসরকারি খাতকে দায়ী করে বলেছেন সরকার তার উপর অর্পিত সমস্ত ডেটা সুরক্ষিত করেছে। কোনো নাম না নিলেও কোক সম্ভবত পরপর ইয়েমেকসেপেতি ডেটা ফাঁসের কথা উল্লেখ করেছেন। তুরস্কে বছরের পর বছর প্রায় একচেটিয়া অবস্থানে থাকা খাদ্য সরবরাহ অ্যাপটি কয়েক মাসের ব্যবধানে একবার নয় বরং দুবার তার তিন কোটি ব্যবহারকারীর তথ্য ফাঁস করেছে।
প্রকৃত অপরাধী (উপরে উল্লিখিত হিসেবে হ্যাকাররা নিজেরাই সরকারের দিকে নির্দেশ করে) বিবেচনায় না নিয়েই বলা যায় ফলাফলটি গোপনীয়তার সকল প্রত্যাশা্কে নিঃশেষ করেছে। তুর্কি নাগরিকরা অনলাইনে আর কোনো গোপনীয়তা আশা করে না। কোনো তথ্য ফাঁস হলে — এবং হ্যাঁ, নির্দিষ্ট না করেই ডেটা ফাঁস সম্পর্কে যথেষ্ট ঘন ঘন কথা বলতে গিয়ে — সামাজিক গণমাধ্যম ব্যবহারকারীরা উপহাসের সুরে এটি নিয়ে অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া ব্যক্তকারীকে মজা করে।
এই পরিবেশে সৃষ্ট হতাশ গ্রহণযোগ্যতাটি ডক্সিংয়ের হুমকির আলোচনা করা এই টুইটার ব্যবহারকারীর কথায় উঠে এসেছে: “আপনার কাছে আমার আইডি আছে? ২ ডলার খরচ করতে পারলে সবাই ফাঁস করা ই-দেভলেত পায়। আপনিবিশেষ কেউ নন।” অধিকারের কোনো প্রত্যাশা না থাকলে আইনিভাবে বিদ্যমান হলেও অধিকারটিও কার্যত বিদ্যমান থাকে না। ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা আইন #৬৬৯৮ গোপনীয়তার সাংবিধানিক অধিকার সুরক্ষিত করার কথা। তবে বাস্তবে সঠিক টেলিগ্রাম গোষ্ঠী চেনা যেকোনো অনুসন্ধানকারী কয়েক মার্কিন ডলারের বিনিময়ে এই আইনটি ভাঙতে পারে।
এই প্রত্যাশা হারানোর মানে হলো অনেক নাগরিক অন্যান্য মৌলিক নাগরিক অধিকারগুলিও ছেড়ে দিয়েছে। সূক্ষ্ম হলেও এটি জনগণের মানসিকতায় স্পষ্ট দৃশ্যমান। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুলেমান সোয়লু ২০২৩ সালের মে মাসে শিফ টডিলিট নামের একটি প্রযুক্তি সংবাদ সাইটে সাক্ষাৎকারের সময় তার ফোনে কিম নামের একটি অ্যাপ্লিকেশনে সাক্ষাৎকারকারীর ছবি তোলার পরে তার নাম, উপাধি, আইডি নম্বর ও তার আরো কয়েকটি ছবিসহ সকল তথ্যে প্রবেশ দেখিয়েছিলেন। ভিডিওটিতে সোয়লুর “রাষ্ট্রের ক্ষমতা দেখিয়েছে” দাবি স্বাভাবিকভাবেই বেশ বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।
বিরোধী রাজনীতিবিদ ও বরেণ্য ব্যক্তিরা এধরনের অ্যাপ ব্যবহারের কঠোর সমালোচনা করেছে। বিবিসি তুরস্কের মেরভে কারা-কাসকার সাথে সাক্ষাৎকারে এরকম অনেক বিশেষজ্ঞ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর অ্যাপ ব্যবহারের সমালোচনা করে প্রশ্ন করেছেন কাদের কাছে এসব সফটওয়্যার আছে এবং কারা এটা ব্যবহারের অনুমতি পেয়েছে, যা খুবই প্রাসঙ্গিক সমালোচনা। গণমাধ্যম ও আইন শিক্ষা সমিতি (এমএলএসএ) তুরস্কের সহ-পরিচালক ভেসেল ওকে উল্লেখযোগ্য আরো একটি প্রশ্ন করেছেন, রাষ্ট্র কেন প্রথমেই তার নাগরিকদের এসব তথ্য সংগ্রহ করে জমা রাখে? ডেটা গোপনীয়তার আশা এতোটাই ক্ষয়ে গেছে যে অনেক বিশেষজ্ঞ ও সিংহভাগ নাগরিক প্রথমেই এই মৌলিক প্রশ্নটি করার কথা ভাবেও নি। তুর্কি নাগরিকদের ব্যক্তিগত ডেটাতে অনেক সরকারি ও বেসরকারি, আইনি-বেআইনি সংস্থার সহজ প্রবেশাধিকার রয়েছে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেই ডেটা সংরক্ষণ বিশ্বের সবচেয়ে স্বাভাবিক ব্যাপার বলেই মনে হয়।
ইস্তাম্বুলের প্রাক্তন গভর্নর আলী ইয়ারলিকায়া ২০২৩ সালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে মন্ত্রণালয়ের কখনো কিম অ্যাপ ব্যবহার অস্বীকার করে বুঝাতে চেয়েছেন ঐ অ্যাপে প্রবেশ প্রাক্তন মন্ত্রীর ব্যক্তিগত সমস্যা, প্রাতিষ্ঠানিক কিছু নয়। এভাবে প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব এড়িয়ে অ্যাপটি ব্যবহারের আইনি বা অন্যান্য সকল দায়িত্ব ব্যক্তি সাবেক মন্ত্রী সোয়লুর উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। ডেটা ব্যবহারের প্রশ্নটি আপাতভাবে “মীমাংসিত” হলেও এটা বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই যে মন্ত্রণালয় এখনো একই তথ্য সংরক্ষণ করে না বা কেউ এটি নিয়ে কথা বলে না।
তুর্কি নাগরিকরা অধিকার ও স্বত্ব সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন নয় এবং খুব সহজেই অনলাইন গোপনীয়তা ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগে দোষারোপ করা সহজ হলেও আমাদের বুঝতে হবে জনগণের উদাসীনতার প্রতিক্রিয়া পুরোপুরি যুক্তিসঙ্গত। আমি এখানে ডেটা গোপনীয়তানিয়ে লেখার পর কেউ আমার নিবন্ধকে সমস্য মনে করে আমার ব্যক্তিগত তথ্য অনলাইনে ফাঁস করটে চাইলেও আমি খুব অবাক হবো না। এটি এতোটাই স্বাভাবিক যে ইন্টারনেটে আপলোড করা নাগরিক সম্পর্কিত মৌলিক ডেটা, মূল্যবান সবকিছু ইন্টারনেটে চিরতরে সহজে প্রবেশাধিকারযোগ্যই থেকে যাবে। কীভাবে এই বাস্তবতার মোকাবেলা করা যায় তা ডেটা গোপনীয়তার রাজনীতির জন্যে একটি জটিল প্রশ্ন। তাত্ত্বিকভাবে ব্যক্তিগত ডেটা ব্যক্তিগত রাখার কথা ভেবেই নীতিমালা প্রণীত হয়। বাস্তবতা অনেক বেশি বিশৃঙ্খল।