বিপ্লব থেকে নির্বাসনে: ইরানি সক্রিয় কর্মী নাসরিন বাসিরির যাত্রা

নাসরিন বাসিরি। ইয়ানা কাজিউলিয়ার তোলা ছবি (অনুমতিসহ ব্যবহৃত)।

প্রবাসী ইরানি নারীদের স্বাধীনতার চেষ্টা ও তাদের সহনশীলতা প্রদর্শনের অভিজ্ঞতার অভ্যন্তরে ঢোকা “নির্বাসনের প্রতিকৃতি” নামের একটি ধারাবাহিকের অংশ এই গল্পটি এসেছে সম্পূর্ণভাবে চুল না ঢাকার জন্যে নৈতিকতা পুলিশের হাতে নিহত ২২ বছর বয়সী একজন কুর্দি নারী মাহসা জিনা আমিনির মর্মান্তিক মৃত্যুর স্মৃতি হিসেবে। ইরানে ব্যাপক বিক্ষোভের জন্ম দেওয়া এই ঘটনাটি সরকারি নিপীড়ন বৃদ্ধি সত্ত্বেও আজও অব্যাহত রয়েছে।

ইরানে ১৯৭৯ সালে পাহলভি রাজবংশের পতন হলে বিদেশে থাকা ৩৩ বছর বয়সী নাসরিন বাসিরি অবিলম্বে দেশে ফিরে যান।

বামপন্থী পটভূমির একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে শাহের রাজত্বের অবসান হওয়ায় তিনি স্বাধীনভাবে বাঁচার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে সাগ্রহে দেশে ফিরে যান।

“তিনি টিকিট পেলে” ইসলামী বিপ্লবের প্রথম নেতা রুহুল্লাহ খোমেনির আগেও পৌঁছে যেতে পারতেন। পরিবর্তে তিনি দুই দিন পরে পৌঁছেছেন, তিনি স্মরণ করেন।

প্রত্যাবর্তনে তার ইচ্ছা ও প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। সেবছরের ফেব্রুয়ারিতে প্যারিস থেকে খোমেনির তেহরানে ফিরে এই ধর্মীয় নেতা ক্ষমতা দখল করায় যারা তার কর্তৃত্ব মেনে চলেনি তাদের সুযোগ হ্রাস পায়।

নাসরিন ইরানি বিপ্লবের আগে অস্ট্রিয়ার গ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পিএইচডি করে জার্মানির বার্লিনে থেকে অর্থনীতির বার্লিন স্কুলে পড়াতেন।

“আমি ভেবেছিলাম ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের পক্ষে ক্ষমতায় আসা অসম্ভব। ইরানে অনেক সক্রিয়, শিক্ষিত নারী থাকায় আমি সেখানে চরমপন্থীদের নিয়ন্ত্রণ পাওয়া অসম্ভব্ মনে করতাম,” তিনি স্মরণ করেন। “আমি ধর্মীয় কাঠামো ও তাদের ভিত্তি হিসেবে কাজ করা মসজিদগুলির শক্তিকে অবমূল্যায়ন করেছিলাম। আমি তাদের সহিংসতার সম্ভাবনাকে অবমূল্যায়ন করেছিলাম,” বাসিরি বার্লিনে পপলার গাছ ও ফুলের ঝোপে ঘেরা একটি বাগানের দিকে খোলা দরজা বিশিষ্ট অ্যাপার্টমেন্টে বসে আমার কাছে তার জীবন কাহিনী বর্ণনার সময় এসব বলেছেন।

কারাগারে ১৯৮০’র দশকে কয়েক হাজার রাজনৈতিক বিরোধীদের – প্রধানত বামপন্থীদের – গণফাঁসির মাধ্যমে নতুন শাসকগোষ্ঠীর সহিংস প্রকৃতি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ভিন্নমতাবলম্বীদের লক্ষ্যবস্তু করা এই সহিংসতা ইরানের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও বিস্তৃত ছিল। তাদের মধ্যে বার্লিনের ভিলমার্সডর্ফের মিকোনোস রেস্তোরাঁয় ১৯৯২ সালে গুলি করে হত্যা করা চার কুর্দি রাজনৈতিক কর্মীর একজন নাসরিনের বন্ধু ছিলেন।

ইরান থেকে পালিয়ে বার্লিনে সক্রিয়তায় ফিরে আসা

বাসিরি ইরানে আসার চার বছর নয় মাস পরে তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সময় নারীদের জাতীয় ইউনিয়নের সহ-প্রতিষ্ঠা করে দুই বছর আত্মগোপনে থাকার পর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।

নতুন শাসনের “সাংস্কৃতিক বিপ্লবের” সময় তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেলে অন্ধকারতম দিনগুলিতে তিনি তুরস্কে পালিয়ে যান। ভুল করে প্রায়শই “পাচারকারী” বলা একজন স্থানীয় গাইডের সাহায্য নিয়ে  তিনি পায়ে হেঁটে সীমান্ত অতিক্রম করেন।

বাসিরি ১৯৮৩ সালের ডিসেম্বরে শরণার্থী হিসেবে বার্লিনে এলে তার নির্বাসিত জীবন শুরু হয়। শহরের বিমানবন্দরে যাত্রীদের স্থানান্তরের জন্যে অপেক্ষারত বাস দেখে তিনি অসুস্থ বোধ করার কথা স্মরণ করেন, কারণ এটি ছিল তার ফিরে আসার বাস্তবতার প্রতীক। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইরান থেকে পালিয়ে জার্মানিতে ফিরে এসেওতিনি অসন্তুষ্ট ছিলেন। আর্থিক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তিনি তার রাজনৈতিক সক্রিয়তা পুনরায় শুরু করেন, যা এখন তেহরানের ক্ষমতাসীন আয়াতুল্লাহদের বিরুদ্ধে পরিচালিত।

সেসময় পশ্চিম জার্মানির রাজধানী পশ্চিম বার্লিনে বসবাস করে বাসিরি ১৯৮০’র দশকে অনেক ইরানি রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের আশ্রয় দেওয়া একটি সম্প্রদায়ের অংশ হয়ে ওঠেন। এই ব্যক্তিরা পশ্চিম বার্লিনের নিরাপত্তায় যাওয়ার আগে পূর্ব বার্লিনে প্রবেশ করে। বাসিরি জার্মান ভাষায় তার দক্ষতার সদ্ব্যবহার করে ইরানি শরণার্থীদের বিশাল ঢেউকে সাহায্য ও তাদের দৈনন্দিন সমস্যার সমাধান করতেন।

তিনি বার্লিন শরণার্থী পর্ষদের সদস্য হয়ে সেসময় একমাত্র জর্মন শরণার্থী পর্ষদ এবং ইরানের রাজনৈতিক শরণার্থী কেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, যা বার্লিনের নিউকোলন জেলায় কাজ করে চলেছে। কেন্দ্রটি অনুসারে, ১৯৮৪ থেকে ২০২৩ সালের শেষ পর্যন্ত ২,১৫,৪৫১ ইরানি জার্মানিতে আশ্রয় নিয়েছে।

বাসিরি বার্লিনে বসবাসরত ইরানিদের জন্যে অ্যারবিবি (রুন্ডফুঙ্ক বের্লিন-ব্রান্ডেনবুর্গ) রেডিও মাল্টিকুলটিতে ফার্সি অনুষ্ঠান পরিকল্পনা ও পরিচালনার মাধ্যমে বিভিন্ন নারী ও গণমাধ্যম গ্রুপসহ সক্রিয় ইরানি গোষ্ঠী গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এছাড়াও তিনি অন্যান্য গণমাধ্যম সংস্থায় অবদান রেখেছেন, একটি ব্লগ লিখেছেন এবং ইরানের পরিস্থিতির উপর আলোকপাত করা একটি জনপ্রিয় বই লিখেছেন।

কয়েক দশক ধরে বার্লিনে নির্বাসিত ইরানি নাগরিক সমাজকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে সাহায্য করে প্রশংসা ও সমালোচনা দু’টোই পাওয়ার পর বাসিরি ২০১৯ সালে ওয়েইসেনসি শিল্পকলা স্কুলের  সমতা কর্মকর্তা হিসেবে তার পেশাগত ভূমিকা থেকে অবসর নেন। তবে তিনি সাংবাদিক হিসেবে সক্রিয় থেকে জার্মান গণমাধ্যমে অবদান রেখেছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে তিনি জর্মন ভাষায় ইরানের ঘটনা সম্পর্কে তথ্য দেওয়া অনলাইন পত্রিকা ইরান জার্নালের সদস্যও ছিলেন।

ইরানিদের মধ্যে ‘বাড়ি’ খুঁজে পাওয়া

“ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ থেকে, বার্লিন আমার বাড়ি,” বাসিরি আমাকে বলেন। “আমার এখানে একটি অ্যাপার্টমেন্ট আছে এবং আমার জীবনে প্রশাসনিক কাজ রয়েছে। কিন্তু আবেগগত দৃষ্টিকোণ থেকে বার্লিন আমার বাড়ি নয়। কখনো ছিলও না. আমি আমার বেশিরভাগ সময় ইরানিদের সাথে কাটাই। ইরানি সংস্কৃতি ও সম্প্রদায়ের কিছু দিক আছে যা আমি পছন্দ করি,” তিনি ব্যাখ্যা করেন।

বাসিরির কাছে ইরানের অভ্যন্তরে ইরানি নারীদের প্রতিদিনের প্রতিরোধের মাধ্যমে আজও টিকে থাকা জান, জেন্দেগি, আজাদি (“নারী, জীবন, স্বাধীনতা”) বিপ্লবী আন্দোলনটি  তার দেখা আগের আন্দোলনগুলি থেকে আলাদা। “এমনকি ইরানের সাধারণ অনেক পুরুষও এটি লক্ষ্য করে নারীদের পিছনে দাঁড়িয়েছে,” তিনি ব্যাখ্যা করেন। “তারা মনে করে তাদের আর নারীদের প্রতি লিঙ্গ বৈষম্য তাদের সংজ্ঞায়িত করতে দেওয়া উচিত নয়। অল্পবয়সী মেয়েরা স্বাধীনতার জন্যে জীবন দিয়ে প্রতিবাদের সময় এতোদিন ধরে পুরুষের বিবেচিত সাহসিকতার ধারণাটি আর শুধু পুরুষের বিষয় থাকেনি,” তিনি যোগ করেন।

“ক্ষমতা সবসময় বন্দুকের নল থেকে এলেও এবার ইরানি নারীদের শক্তি এসেছে স্বাধীনতার প্রতি তাদের আবেগ থেকে কারণ তারা ইরানের শহরের রাস্তায় তাদের ওড়না পুড়িয়েছে, নেচেছে বা গান গেয়েছে যা আর থামানো যাবে না,” নাসরিন বাসিরি নিশ্চিত করেছেন। এই ৭৯ বছর বয়সী নিজেকে একজন আশাবাদী ব্যক্তি হিসেবে সংজ্ঞায়িত না করলেও তার হিসেবে ২০২২ সালের বিদ্রোহ উল্টানো যাবে না।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .