রাস্তার একটি সাক্ষাৎকারের জন্যে তুরস্কের এক নাগরিক কারগারে

ছবি: আরজু গেবুলায়েভা

স্থানীয় জনপ্রিয় ইউটিউব চ্যানেল টুইলু মিক্রোফন (অস্পষ্ট মাইক্রোফোন) এর সাথে রাস্তায় একটি সাক্ষাৎকারে সরকারের ইনস্টাগ্রাম অবরোধের সমালোচনা করায় তুরস্কের ইজমির প্রদেশে দিলরুবা ওয়াই নামে একজন নারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাকে তুরস্কে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে সরকার সমালোচকদের বিরুদ্ধে সাধারণভাবে আনা “রাষ্ট্রপতিকে অপমান,” এবং “জনগণের মধ্যে ঘৃণা ও শত্রুতার উস্কানি” এই দু’টি অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

তুর্কি যোগাযোগ কর্মকর্তা ফাহরেত্তিন আলতুন গাজার ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড শাসনকারী ইসলামি প্রতিরোধ গোষ্ঠী – হামাসের একজন প্রধান কর্মকর্তা ইসমাইল হানিয়ার মৃত্যুর জন্যে শোক বার্তা সেন্সরের জন্যে ইনস্টাগ্রামের সমালোচনা করায় ২ আগস্ট মঞ্চটিতে প্রবেশাধিকার অবরুদ্ধ করা হয়। অবরোধের কয়েক ঘন্টা পরে সংবাদ মঞ্চ মিডিয়াস্কোপের সাথে কথা বলার সময় একজন কর্মকর্তা বলেন, আলতুনের মন্তব্য মঞ্চটি অবরুদ্ধ করার আসল কারণ নয়। জাতীয় নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে অপরাধ, শিশু নির্যাতন, আত্মহত্যাকে উৎসাহিত করা, অবৈধ পণ এবং আরো অসংখ্য বিষয়ে রাষ্ট্রীয় দাবি মেনে চলতে মঞ্চটির ব্যর্থতার কারণে সিদ্ধান্তটি দীর্ঘদিন ধরে আসছে বলে তারা দাবি করেছে।

স্থানীয় গণমাধ্যম প্রতিবেদন অনুসারে, মেটা ও তুর্কি কর্মকর্তাদের মধ্যে এক সপ্তাহ আলোচনার পর ১০ আগস্ট মঞ্চে প্রবেশাধিকার পুনরুদ্ধার করা হয়

রাস্তার সাক্ষাৎকার

সাম্প্রতিক বছরগুলিতে তুরস্কে বিশেষ করে প্রায়শই রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত মূলধারার গণমাধ্যমগুলি সরকারপন্থী আউটলেটগুলির আধিপত্যের মধ্যে রাস্তার সাক্ষাৎকারগুলি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। মনের কথা বলার অবশিষ্ট কয়েকটি উপায়ের একটি হিসেবে জনগণ এসব সাক্ষাৎকারে প্রায়শই ক্ষমতাসীন সরকারের সমালোচনা করতে পারে বলেএগুলি নাগরিকদের অভিযোগসমূহ ধারণ করে থাকে। একারণে তুরস্কের প্রধান সেন্সর – রেডিও ও টেলিভিশন সর্বোচ্চ পর্ষদ (আরটিইউকে) – দীর্ঘদিন ধরে এগুলি নিয়ে অসন্তুষ্ট। সাম্প্রতিক ইনস্টাগ্রাম অবরোধে তা স্পষ্ট হয়েছে। সেসময় আরটিইউকে প্রধান ইবুবেকির শাহিন একটি টুইট বার্তায় বলেন, সেগুলি ভুল তথ্যের উৎস বলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান রাস্তার সাক্ষাৎকারকে অনুমোদন করে না। “জনগণকে প্রভাবিত করার জন্যে সচেতনভাবে এধরনের বিভ্রান্তিকর সাক্ষাৎকার কৌশল ব্যবহার করা হয়,” শাহিন লিখেছেন।

সাম্প্রতিক বছরগুলিতে অনলাইন গণমাধ্যম বিষয়বস্তু নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে আরটিইউকে’কে ব্যাপক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। মূলধারার গণমাধ্যম আউটলেটগুলির ৯০ শতাংশের বেশি সরকারপন্থী সংস্থার মালিকানাধীন হওয়ায় এই পদক্ষেপটি অস্বাভাবিক ছিল না।

ফ্রি ওয়েব তুরস্ক মঞ্চের সাম্প্রতিকতম ইন্টারনেট বিধিনিষেধ প্রতিবেদন অনুসারে, “তুরস্কে ২০২৩ সালে ১,৯৭,৯০৭টি ডোমেন নামসহ ২,১৯,০৫৯টি ইউআরএলে প্রবেশাধিকার অবরোধ করা হলেও সবচেয়ে অবরুদ্ধ দুর্নীতি ও অনিয়ম খবরের সংখ্যা ছিল ১৪,৬৮০টি।“ প্রতিবেদনটি অনুসারে, সামাজিক গণমাধ্যমের ৫,৬৪১টি পোস্ট এবং ৭৪৩টি অ্যাকাউন্ট সরিয়ে দেওয়া বা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

তুরস্কের বিষয়বস্তু অবরোধের বা ইন্টারনেটে প্রবেশাধিকার সঙ্কোচনের একটি দীর্ঘ ইতিহাসঐতিহ্য রয়েছে। অতি সম্প্রতি কোনো কারণ উল্লেখ ছাড়াই ১২ জুলাই গল্প বলার মঞ্চ ওয়াটপ্যাডে প্রবেশাধিকার অবরোধ করা হয়েছে। সরকার ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ১৬টি ভিপিএন সেবাদাতার উপর প্রবেশাধিকার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। স্বাধীনতা সদন প্রকাশিত বার্ষিক নেট স্বাধীনতা প্রতিবেদনে দেশটিকে “মুক্ত নয়” আখ্যায়িত করা হয়েছে। সীমান্তবিহীন প্রতিবেদকের সাম্প্রতিক সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে দেশটির অবস্থান ১৫৮তম।

রাষ্ট্রপতিকে অপমান

তুর্কি বাস্তবতা যাচাই মঞ্চ দগরুলুক পায়ি অনুসারে, ২০২২ সালে “রাষ্ট্রপতিকে অপমানে” অভিযুক্ত মোট লোকের সংখ্যা ১,৩৭৭টি শিশুসহ ১৬,৭৫৩ জন।

তুর্কি দণ্ডবিধির ২৯৯ ধারা অনুসারে, রাষ্ট্রপতিকে অপমান করা বেআইনি। অভিযুক্তরা চার বছর পর্যন্ত জেল খাটতে পারে। দণ্ডবিধির ৩০১ ধারা “তুর্কি জাতি, তুর্কি প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্র, [এবং] রাষ্ট্রের সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানকে হেয় করা” অপরাধী করে। ২০১৪ সালে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে স্বাধীনতা সদনের প্রতিবেদন অনুসারে, অন্তত “১,০০,০০০ লোককে বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপতির মানহানি” এবং মানবাধিকার পর্যবেক্ষকের ২০১৮ সালের একটি প্রতিবেদন অনুসারে ২০১৪ সালে রেসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে খুবই কম ব্যবহৃত একটি বিধান দণ্ডবিধির ২৯৯ ধারা ভঙ্গের জন্যে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

এই ধারা লঙ্ঘনের জন্যে শিক্ষার্থী, শিল্পী, সাংবাদিক, আইনজীবী ও সাধারণ নাগরিকদের বিচার বা বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে। বিচার মন্ত্রণালয়ের ফৌজদারি রেকর্ড ও পরিসংখ্যানের মহাপরিদপ্তর অনুসারে, রাষ্ট্রপতিকে অপমানের কথিত অভিযোগে ২০১৯ সালে ৩৬,০০০ জন এবং ২০২০ সালে ৩১,২৯৭ জন তদন্ত করা হয়। তুলনামূলকভাবে, ২০১০ সালে এই ধারায় মাত্র চার জনের বিরুদ্ধে তদন্ত করা হয়। ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালত ২০২১ সালের অক্টোবরে রায় দিয়েছে, ২৯৯ ধারায় প্রতিষ্ঠিত ফৌজদারি বিচার মানবাধিকারের ইউরোপীয় রীতি মত প্রকাশের স্বাধীনতার ১০ ধারাকে লঙ্ঘন করে।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের একটি দলকে ২০২৪ সালের মে মাসে ৬ ফেব্রুয়ারির প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পে “মাস্টারপিস” লেখা রাষ্ট্রপতি এরদোয়ানের একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উৎপাদিত চিত্রের জন্যে একই ধরনের অভিযোগের মুখোমুখি করা হয়। শুনানিতে অভিসংশকের অভিযোগ ছবিটি “স্পষ্টতই রাষ্ট্রপতির সম্মান ও মর্যাদার উপর আক্রমণ।” টুইটার ও টিকটকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভূমিকম্পের খবরের পরে প্রবেশাধিকার সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। রাষ্ট্র ভূমিকম্পে রাষ্ট্রের বিভ্রান্তিকর প্রতিক্রিয়ার সমালোচনাকারী সামাজিক গণমাধ্যম ব্যবহারকারীদের আটক ও তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি ব্যবস্থাও নিয়েছিল।

রাষ্ট্রপতি এরদোয়ানের প্রশ্নবিদ্ধ অর্থনৈতিক নীতি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে মে মাসে তুরস্কের সাধারণ নির্বাচনের আগে শুরু করা একটি স্টিকার প্রচারণার জন্যে ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে গ্রাফিক ডিজাইনার মাহির আক্কয়ুনকে আটক করা হয়। সামাজিক গণমাধ্যম মঞ্চগুলিতে তুরস্কের শহরপ্রদেশগুলি জুড়ে ব্যবহৃত স্টিকারগুলি গতি পেতে শুরু করলে আক্কয়ুন টুইট করেন রাষ্ট্রপতিকে অপমান, নির্বাচন ব্যাহত ও মিথ্যা গুজব তৈরির দায়ে তিনি আটক হতে যাচ্ছেন। কয়েক ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের পর আক্কয়ুনকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

এরদোয়ান ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে কোভিড-১৯ সংক্রামিত হলে সংবাদটি নিয়ে খুব বেশি উৎসাহ প্রকাশকারী সামাজিক গণমাধ্যম ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে অন্তত ৩৬টি তদন্ত করা হয়। তাদের মধ্যে একজন প্রাক্তন অলিম্পিক সাঁতারু দেরিয়া বিউকুঞ্চু। “তার কোভিড-১৯ হওয়ায় তিনি দোয়া চেয়েছেন। চিন্তা করবেন না, আমরা প্রার্থনা করছি। আমি ২০ হাঁড়ি হালুয়া তৈরি শুরু করেছি। সময় এলে আমি পুরো পাড়ায় কিছু দেবো,” খবরের পর বিউকুঞ্চু টুইট করেন। হালুয়া সম্পর্কে অপরিচিতদের জন্যে, আটা বা সুজি, মাখন ও মধু দিয়ে তৈরি একটি জনপ্রিয় মিষ্টান্ন ছাড়াও এটি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠানেও পরিবেশন করা হয়। ক্রীড়াবিদকে তখন “রাষ্ট্রপতিকে অপমানের” অভিযোগে প্রধান সরকারি অভিসংশকের কার্যালয় রাষ্ট্রপতির মৃত্যুর পরোক্ষ ইচ্ছা পোষণের মতো একটি অপরাধমূলক কাজের দায়ে তাকে গ্রেপ্তারের একটি পরোয়ানা জারি করা হয়। এই সাঁতারুকে তুরস্কের সাঁতার ফেডারেশন থেকেও স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করা হয়।

তবে, এই অপমান নিষেধাজ্ঞা শুধু একমুখী কাজ করে। ক্ষমতাসীন দলের মেয়াদকালে সরকারি কর্মকর্তারা নাগরিকদেরকে “রিফ্রাফ”, “দস্যু”, “সন্ত্রাসী,” “পতিতা” এবং আরো অনেক কিছু বলে জনগণকে বহুবার অপমান করেছে। অতি সম্প্রতি, এরদোয়ান ইনস্টাগ্রাম নিষেধাজ্ঞার এবং ইসমাইল হানিয়ার জন্যে একটি শোক দিবস ঘোষণার সরকারি সিদ্ধান্তের সমালোচক এবং নিষেধাজ্ঞার সমালোচনাকারীদের প্রযুক্তি দৈত্যদের জন্যে দেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতক বুঝিয়ে তাদের ম্যালকম এক্সের বিখ্যাত বক্তৃতায় উদ্ধৃত “খারাপ চরিত্রের” “গৃহপালিত কৃষ্ণাঙ্গ” বলে অভিহিত করে একটি বর্ণবাদী গালি দিয়েছেন।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .