সামরিক শাসনে মিয়ানমারের বৃহত্তম শহরের জীবনধারা

Yangon

মিয়ানমারের সামরিক শাসন ১৯ জুলাই ৭৭তম শহীদ দিবস উদযাপনের সময় ইয়াঙ্গুন শহরের কেন্দ্রস্থলে নিরাপত্তা জোরদার করেছে। গ্লোবাল ভয়েসেসের বিষয়বস্তু অংশীদার ইরাবতী – ইংরেজি সংস্করণ থেকে নেওয়া ছবি ও ক্যাপশন।

বিষয়বস্তু ভাগাভাগি চুক্তির অংশ হিসেবে মূলত মিয়ানমারের একটি স্বাধীন সংবাদ ওয়েবসাইট ইরাবতীতে প্রকাশিত ইয়াজার অংয়ের নিবন্ধের একটি সম্পাদিত সংস্করণ গ্লোবাল ভয়েসেসে পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে।

গত কয়েক মাস ধরে লাফিয়ে বাড়া মুদ্রাস্ফীতি মিয়ানমারের জনগণকে ঈশ্বরের দিকে ঠেলে দিয়েছে। ধর্মানুরাগ ও দামের মধ্যে যোগসূত্র আছে কি? প্রতি চার বা পাঁচ দিনে খাদ্য ও জ্বালানী থেকে শুরু করে ঔষধ পর্যন্ত সবকিছুর দাম বেড়ে গেলে ঘন ঘন প্রতিক্রিয়া শোনা যায় “হায় ঈশ্বর।”

একটি মুরগির ডিমের দাম ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের আগে ছিল ১২০ কিয়াত (প্রায় ৪.৩৪ টাকা), এখন ৩৬০ কিয়াত (প্রায় ১২.৯ টাকা)। একটি হাঁসের ডিম ২০০ কিয়াত (প্রায় ৭.২৭ টাকা)  থেকে ৫০০ কিয়াত (প্রায় ১৭.৬০ টাকা) হয়েছে। রান্নার তেল, চাল, টমেটো, বাঁধাকপি, সাদা মুলা, মুরগি, শুয়োরের মাংস বা চিংড়ির ক্ষেত্রে একই কথা। এমন কোনো খাবার নেই যার দাম বাড়েনি।

ইয়াঙ্গুনে পাম তেল কেনার জন্যে সারিবদ্ধ মানুষের দীর্ঘ লাইন নে উইনের যুগের কথা মনে করিয়ে দেয় যখন চালসহ প্রয়োজনীয় জিনিসগুলি রেশন করা হতো। অতিরিক্ত রান্নার তেলের জন্যে দুবার লোকেদের লাইনে দাঁড়ানো ঠেকাতে গ্রাহকদের অবশ্যই তাদের নাগরিকত্বের আইডি দেখাতে হয়। ভ্রাম্যমাণ দোকানে বাজার মূল্যের অর্ধেক ভর্তুকিযুক্ত রান্নার তেল প্রতি ভিস (প্রায় ১.৬ কিলো) ৬,০০০ কিয়াতে (প্রায় ২১৭ টাকা) বিক্রি হলে ভিড় জমে গিয়ে দ্রুত বিক্রি হয়ে যায়।

সামাজিক গণমাধ্যমে ব্যঙ্গাত্মক কার্টুনগুলিতে জনগণকে বাজার থেকে বাঁধাকপি ছিনিয়ে নিতে দেখানো একেবারে অতিরঞ্জিত নয়।

বাঁধাকপি, জল পালং শাক ও ডিম একসময় নিম্ন আয়ের পরিবারের খাবার টেবিলে সাধারণ হলেও (জেনারেল) মিন অং হ্লাইংয়ের শাসনামলে এমনকি মধ্যবিত্ত পরিবারগুলিও এসবের দামের জন্যে প্রবল দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

অন্যকোথাও কেনাকাটা উপভোগ্য বিনোদন হলেও মিয়ানমারের মানুষের জন্যে নয়। গৃহস্থালি দ্রব্যাদির জন্যে কাড়াকাড়ি বেশিরভাগ পরিবারের জন্যে একটি দৈনন্দিন যন্ত্রণা।

নিম্নমানের চাল অভ্যুত্থানের আগের ২,০০০ কিয়াত (প্রায় ৭২.৭৪ টাকা) প্রতি ভিস (২.১৩ কিলো) থেকে বেড়ে ৫,০০০ কিয়াত (প্রায় ১৮১ টাকা) হয়েছে। উচ্চ-মানের শস্য শুধু সচ্ছল পরিবারগুলোই এখন কিনতে পারে। কয়েকদিন আগে রাত ৮টায় প্রচারিত খবরে জান্তা প্রধান মিন অং হ্লাইং মিয়ানমার উদ্বৃত্ত চাল রপ্তানি করছে বললে আমি নির্বাক হয়ে গিয়েছিলাম।

আমার এক খালা রাস্তার কুকুরদের খাওয়ানোর সামুদ্রিক মাছের ঊর্ধ্বগতি সম্পর্কে অভিযোগ করেছেন। মিন অং হ্লাইংয়ের অভ্যুত্থান রাস্তার প্রাণীদের কষ্টও বাড়িয়ে দিয়েছে।

ইয়াঙ্গুনের একজন বাসিন্দা আকাশ ছোঁয়া খাবারের দাম, ঘাটতি, অপরাধ বৃদ্ধি ও সৈন্যদের গ্রেতারের ক্রমাগত ভয়ের বর্ণনা দিয়েছেন। #আমরমিয়ানমারেকীহচ্ছে

মিয়ানমার থেকে ইরাবতীকে সত্য প্রতিবেদন করতে সাহায্য করুন

এদিকে বিদ্যুৎ বিভ্রাট আমাকে আমার বাচ্চাদের দুপুরের খাবার রান্না করতে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করতে বাধ্য করে। রান্নার গ্যাসের দামও সম্প্রতি বাড়লেও কাঠকয়লার দামও সস্তা নয়। আমিও বিড়বিড় করছি “হায় ঈশ্বর!”

তবে দাম বৃদ্ধিই একমাত্র সমস্যা নয়। কিছু জিনিসপত্র দুষ্প্রাপ্যও হয়ে পড়ছে।

আমি কয়েকদিন আগে চিকেন সিজনিং পাউডার কিনতে গিয়ে একটি দোকানে ঢুকে তাকগুলিতে কিছুই খুঁজে পাইনি। আমাকে একজন নিয়মিত গ্রাহক হিসেবে চেনা বিক্রয়কর্মী আমাকে নীচু কণ্ঠে স্টোররুম থেকে কিছু নিয়ে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেন। আমি আমার স্ত্রীকে বিষয়টি জানালে সে অবাক হয়ে বলে কয়েক সপ্তাহ ধরে মুরগির মশলা পাওয়া যাচ্ছে না।

সিটি মার্টের একটি সুপারমার্কেটে আমি ওভালটিন পুষ্টি পানীয় গ্রাহক প্রতি দুই প্যাকেটে রেশন কটতে দেখেছি। আমি আমার দাদা-দাদির জন্যে আমার তিনটি প্যাকেটের দরকারের কথা বললে ক্যাশিয়ার দয়া করে আমাকে দুটি প্যাকেট এবং তৃতীয়টি একটি আলাদা রসিদ দিয়ে বিক্রি করেন। আমি বুঝেছিলাম ওভালটিনের স্টকও শেষ হতে পারে।

আমি কয়েক মাস জনপ্রিয় বিক্রয় কেন্দ্রে খোঁজার পর অবশেষে একটি ফার্মেসিতে জিলেট ফোমি শেভিং ক্রিমের দুটি বোতল খুঁজে পেয়েছি। যুক্তি আমাকে দুটিই নিতে আগ্রহী করলেও সবার আগে ডায়াপারের দামও বাড়ছে বলে আমার দুটি ছোট বাচ্চার চাহিদার কথা আগে ভেবেছি।

ওষুধের দামও আকাশ ছোঁয়া হয়েছে। প্রয়োজনীয় ওষুধের দাম শুনতে পেলে পায় রোগীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যায়। আজকাল ফার্মেসি কাউন্টারগুলিতে “ওষুধটি শেষ” একটি সাধারণ বিরতি। প্রায়শই ক্রেমিল-এস অ্যান্টাসিডের স্টক থাকে না বলে আমার স্ত্রীকে তার পেটের ব্যথায় অভ্যস্ত হতে হয়েছে।

আমি মিন অং হ্লাইংকে অভিশাপ না দিয়ে পারি না। তবে আমরা শহুরে বাসিন্দারা জান্তার বিমান হামলা ও আর্টিলারি ব্যারেজ থেকে পালানোর সময় জিনিসপত্র ও ব্যবসা ত্যাগ করতে বাধ্য অন্য জায়গার স্বদেশীদের তুলনায় অন্তত বেশি ভাগ্যবান।

মুদ্রাস্ফীতি, ভোগ্যপণ্যের ঘাটতি, মারাত্মক বিদ্যুৎ বিভ্রাট, এবং চুরি, ছিনতাই ও পকেটমারের মতো অপরাধের তরঙ্গ শহরগুলির জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। সাধারণ অবনতির সাথে যোগ হয়েছে ইয়াঙ্গুনের রাস্তায় ফিরে য়াসা লাইসেন্সবিহীন বাসগুলি। যাত্রীদের জন্যে দুর্বৃত্ত যানবাহনগুলি বিপজ্জনকভাবে চালিয়ে ঝাঁকুনি দেওয়ার জন্যে কুখ্যাত।

কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ পরা নারীরা ইয়াঙ্গুনে আর নিরাপদ নয়। ছিনতাই মহামারী ফোন, বাইক ও বৈদ্যুতিক বাইককেও ছাড়ে না। পরিবহনে পকেটমার থাকায় সরকারি বাসের চালকরা প্রায়ই যাত্রীদের “তাদের ফোন এবং পার্সের যত্ন নিতে” সতর্ক করে।

সরকারি বাস ও ট্যাক্সিগুলিকে ওভারটেক করার জন্যে গতি বাড়ানো দুর্বৃত্ত বাস চালকরা যাত্রীদের ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করার পরামর্শ দেয়। তারা ট্রাফিক পুলিশ ও সৈন্যদের অতিরিক্ত আয়ের উৎসও বটে। ইয়াঙ্গুনে “বাস ঘুষ” এখন একটি পরিচিত দৃশ্য।

রাস্তায় বেরিয়ে ইয়াঙ্গুনবাসী ক্রমাগত জান্তা সৈন্যদের তাদের থামিয়ে দেওয়া ও ফোন চেক করার ভয়ে থাকে। ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (ভিপিএন) ব্যবহার বা রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল বা শাসনের জন্যে আপত্তিকর বিবেচিত ছবি সংরক্ষণের জন্যে আপনাকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে।

ইয়াঙ্গুন শহরের কেন্দ্রস্থলে হাঁটলে, ডিজেল জেনারেটরের শব্দ আপনার কানে ঝাঁকুনি দেবে এবং উপচে পড়া আবর্জনার পাত্রের দুর্গন্ধে আপনার মাথাব্যথা করবে।

অভ্যুত্থানের পর থেকে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গ্রাহকদের আকর্ষণ করা গেকোর মতো চমৎকার জাপানি খাবারের দোকান রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়ে গেছে।

শাসকগোষ্ঠীর বিদেশী আগমন বৃদ্ধির দাবি স্বত্ত্বেও ইয়াঙ্গুনে পর্যটকদের সংখ্যা বিরল। চিনাটাউনের ইয়াঙ্গুন সিটি হলের বাইরে, শ্বেডাগন প্যাগোডা ও  বিমানবন্দরে আসা-যাওয়ার বাসে বিদেশিদের ঝাঁক দেখতে পাওয়া এখন অতীতের বিষয়।

অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারের শহর ও গ্রামীণ উভয় এলাকাই অশান্তিতে রয়েছে।

কোন অতিথি একটি অশান্ত বাড়িতে যেতে পছন্দ করে না।

প্রতিদিন সকালে আমার স্ত্রী আমাকে বলে, “কেন তুমি তোমার কম্পিউটারে পারিত্তা [দুর্ভাগ্য বা বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার বৌদ্ধ মন্ত্র] বাজাও না?”

তবে আমি জানি সামরিক শাসনের অভিশাপ হটাতে জপ করার চেয়ে বেশি কিছু করা দরকার।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .