একটি বিষয়বস্তু ভাগাভাগির চুক্তির অংশ হিসেবে নেপালি টাইমসে প্রথম প্রকাশিত বাংলাদেশের ফটোসাংবাদিক শহিদুল আলমের জার্নালের একটি সম্পাদিত সংস্করণ নীচে পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে৷
এই আন্দোলনকে কেবল চাকরির কোটা সংস্কারের দাবি হিসেবে দেখলে ভুল হবে। কোটা (সংস্কার) আন্দোলনের ন্যাযতা কেবল হিমশৈলের চূড়াকে প্রদর্শন করে। এতোদিন ধরে জনগণের ওপর বর্বরতা চালাতে থাকা সরকার চরম অসন্তোষের জন্ম দিয়েছে।
কোটা সমস্যা এই অগ্নিগর্ভটিকে জ্বালাতে বা জ্বলতে সাহায্য করেছে মাত্র। জনগণ যখন মার খাচ্ছে ও মরছে তখন দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজারে পর্যটন সম্ভাবনার উপর একটি জলজ চাষ ও সামুদ্রিক খাদ্য সম্মেলনে উপস্থিতদের পরামর্শ দিচ্ছিলেন।
মূল কোটাটি ১৯৭২ সালে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে মুক্তিযোদ্ধাদের (সেসময় জনসংখ্যার ০.২৫ শতাংশেরও কম) অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়ার একটি অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা হিসেবে প্রণীত হয়েছিল।
স্বাধীনতার ৫০ বছরেরও বেশি সময় পরে সেই হিসেবের ১২০ গুণ ৩০ শতাংশ কোটার মাধ্যমে বরাদ্দ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি করা অবিশ্বাস্যভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত বলে কথিত একটি সরকারের দলীয় ক্যাডারদের অনেক চাওয়া-পাওয়ার সরকারি চাকরি লাভের একটি সহজ পিছনের দরজা হয়ে উঠেছে।
এই অসন্তোষের ফলে ২০০৮ ও ২০১৩ সালে সৃষ্ট ক্ষোভ ২০১৮ সালে বিস্ফোরোন্মুখ হয়। দমনমূলক পদক্ষেপ সেই অস্থিরতাকে দমন করতে ব্যর্থ হলে প্রধানমন্ত্রী তার কর্তৃত্বকে অতিক্রম করে একতরফাভাবে পুরো ব্যবস্থাটি বাতিল করে দেন।
কখনোই এটি অনগ্রসর সম্প্রদায়ের জন্যে ইতিবাচক বৈষম্যের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করা প্রতিবাদকারীদের দাবি ছিল না। অস্থিরতার আরো অনেক কারণ রয়েছে। বছরের পর বছর ধরে আকাশচুম্বী নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামে মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকেছে।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী নিজেই প্রকাশ্যে জানিয়েছেন তার প্রাক্তন “পিয়ন” ৪০০ কোটি টাকার মালিক যে শুধু হেলিকপ্টারেই ভ্রমণ করে। একমাত্র সেই হেলিকপ্টারে যাতায়াত করে না। বিক্ষুব্ধ বিক্ষোভকারীদের চাপে ছাদে আটকে পড়া পুলিশকেও উদ্ধার করতে গতকাল হেলিকপ্টার পাঠানো হয়েছিল।
ডেটলাইন ১৫ জুলাই, ২০২৪। মনে করিয়ে দেয় ২০১৮ সালের কথা। সোমবার নীলক্ষেত কোণে দাঁড়িয়ে থাকা জলকামানসহ পুলিশের ভ্যান ও পুলিশ সদস্যদের দীর্ঘ লাইন তাদের প্রস্তুতি স্পষ্ট করে দেয়। এটা কীসের প্রস্তুতি?
অবশ্যই নিরস্ত্র ছাত্র বা সাধারণ জনগণের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা নয়। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের (বিসিএল) সশস্ত্র গুন্ডারা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালানোর সময় তারা ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়। স্পষ্টতই ছাত্রলীগকে রক্ষার জন্যেই পুলিশ প্রস্তুত ছিল।
নিরস্ত্র ছাত্ররা লেলিয়ে দেওয়া হেলমেটধারী সশস্ত্র সরকার-সমর্থক পাহারাদারদের বিরুদ্ধে খুব একটা কিছু করে উঠতে পারেনি; জনশক্তির কাছে স্যাঙ্গাতরা পর্যুদস্ত না হওয়া পর্যন্ত পুলিশ বিশৃঙ্খলা চলতে দিয়েছে।
আমরা রক্তাক্ত ও ছিটিয়ে থাকা স্যান্ডেলপূর্ণ রাস্তায় হেঁটে চলেছি। আহতদের ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে লোকজন আমাদের থামিয়ে দেয়।
কয়েকজন আহতকে চিকিৎসা দেওয়া ওয়ার্ডের আশেপাশে অবস্থান নিয়ে ছাত্রলীগ কর্মীরা এর চারপাশে মিছিল করলেও সশস্ত্র পুলিশ সুবিধাজনক দূরত্ব বজায় রাখে। ছাত্রলীগের কর্মীরা আহত শিক্ষার্থীদের মারধর করতে ওয়ার্ডের ভেতরে গেলে পুলিশ অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে।
ছাত্রলীগ বিপদে না পড়লে হস্তক্ষেপের দরকার নেই। জাতি, গণতন্ত্র, সাধারণ শালীনতাবোধ ও জনগণ মারাত্মক বিপদে থাকলেও এটা পুলিশের চিন্তার বিষয় নয়। তাদের সমীকরণে প্রাথমিক কাজ কখনোই জনগণের সুরক্ষা না হওয়ায় সেদিন সারাদেশে বেশ কয়েকজন নিহত হয়।
“বিচার তার নিজস্ব গতিতে চলবে” আইনমন্ত্রীর একটি সাধারণ বুলি। বাংলাদেশে কখনোই বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগ আলাদা ছিল না। এটি সরকারের সাথে একাকার।
সরকার ভালো পুলিশ/খারাপ পুলিশ খেলতে চায় তখনই এটি ব্যবহার করা হয়। আদালত সরকারি নির্দেশ জারি করে। সরকার বাহবা নেয়। আদালতকে দোষারোপ করে। কোটার নাটকও এর ব্যতিক্রম নয়।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে নির্যাতন কেন্দ্র। সকল ভিন্নমত দমন। বিরোধী নেতাকর্মীদের জেলে পাঠানো। বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম। বিশাল ছাড়ের বিনিময়ে ভারত এই অবৈধ শাসনকে সমর্থন করছে। এসবই রাগের কারণ।
১৬ জুলাই, ২০২৪
পুলিশের চারটি রাবার বুলেটের শিকার বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরস্ত্র শিক্ষার্থী আবু সাঈদ সাম্প্রতিক একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসে শিক্ষার্থীদের জীবন বাঁচাতে গিয়ে ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে নিহত তার প্রিয় শিক্ষক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের শিক্ষক ও প্রক্টর শামসুজ্জোহাকে একটি কথোপকথন লিখেছিল।
হ্যাঁ, আপনিও মারা যাবেন, তবে বেঁচে থাকতে আপনি মেরুদণ্ডহীন হবেন না। শুধু কারণটিকে সমর্থন করে রাস্তায় বেরিয়ে আসুন। শিক্ষার্থীদের জন্যে ঢাল হয়ে উঠুন। তাহলেই আপনি সম্মানিত ও শ্রদ্ধেয় হবেন। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আপনি সময়ের ইতিহাসে বিলীন হয়ে যাবেন না। চিরজীবী হোন শামসুজ্জোহা।
কোনো হেলিকপ্টার আসেনি, বা আসলে অসহায় ছাত্রটিকে উদ্ধারের কোনো চেষ্টা করা হয়নি। সে শামসুজ্জোহা হয়ে গেলো।
টেলিভিশনে প্রচারিত হত্যাকাণ্ডটি অনেক আগেই শাসনের অধিকার হারানো একটি দুর্বৃত্ত সরকারের অপরাধের প্রমাণ। দুইবাহু প্রসারিত দুর্দম যুবকের টেলিভিশনে প্রচারিত হত্যাটি জনগণের স্মৃতিতে থেকে যাবে। প্রথম বুলেটে তার শরীর কেঁপে উঠলেও অটল সে দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর আরেকটি বুলেট, এবং আরেকটি এবং আরো একটি। সবগুলি খুব কাছ থেকে। শরীর ঝুঁকে যায়, তারপর মুচড়ে ভাঁজ হয়ে যায়। পুলিশের মোকাবেলা করা তার প্রসারিত বাহুদ্বয় বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রতিবাদী মুহূর্ত হয়ে থাকবে।
১৭ জুলাই, ২০২৪
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর নিয়মিত লক্ষ্যবস্তু চর্চার শিকার দেশের নাগরিকদের রক্ষা করতে অক্ষম বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের দিকে তাদের নিজেদের বন্দুক তাক করতে পেরে খুশি বলে মনে হচ্ছে। অশান্ত ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণ করতে (শব্দ) গ্রেনেড ছোঁড়ার দাবি করা পুলিশ স্পষ্টতই মিথ্যা বলছে।
মাত্র চারজনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রাজু ভাস্কর্যের কাছে ছাত্রলীগ ও পুলিশের বেষ্টনী অতিক্রম করতে পারে। তার আবু সাঈদ ও অন্যান্য নিহত বন্ধুদের জানাজা করতে চায়। পুলিশ তাদের তাড়িয়ে দিতে উদ্যত হলে প্রতিবাদে তারা মাটিতে শুয়ে পড়ে। সাংবাদিকরা তাদের ঘিরে ফেললে সাংবাদিক ও ছাত্র উভয়কে বিক্ষিপ্ত করতে পুলিশ একটি সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এরপর তারা সাংবাদিক ও দাঁড়িয়ে থাকা দর্শকদের লক্ষ্য করে আরো গ্রেনেড নিক্ষেপ করলে আমার সহকর্মী আহত হন।
শতাধিক সশস্ত্র পুলিশ দিয়ে ঘিরে রাখা পুরো স্থানটিতে একমাত্র পুলিশই সহিংস ছিল। সেখানে সাঁজোয়া যান, জলকামান ট্রাক এমনকি একটি জেল ভ্যানও ছিল। আমি ভাবছি কোন দেশ আমাদের পুলিশকে ৪৮ মিমি সাউন্ড গ্রেনেড (এনএফ২৪, এনইএনএফ২৪বিপি প্রস্তত: ২০২২, বাংলাদেশ পুলিশ/ বিপি) সরবরাহ করেছে। সরাসরি বিক্ষোভে প্রথমবার যোগ দেওয়া নারীকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। তিনি অন্তত দেখতে পেয়েছেন আমাদের পুলিশ বাহিনী কতটা সাহসী।
১৮ জুলাই, ২০২৪
বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়তে হবে না মনে করে একদল নারীবাদী কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করতে শাহবাগ চত্বরে জড়ো হওয়ার পরিকল্পনা করে। পুলিশ ও সরকারি পাহারাদারেরা তাদের জড়ো হতে নাদিলে তারা ধানমন্ডির নারীপক্ষ অফিসের বাইরে পুনরায় সংগঠিত হয়। তাদের ওপর সেখানে হামলা হয়। সাফিয়া আজিম আহত হলেও হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয়নি।
দাঁত চেপে মিথ্যা বলায় পারদর্শী আইনমন্ত্রী এর আগে বিবিসিতে বলেছেন বিক্ষোভকারীরাই সহিংসতা উস্কে দিয়েছে। এরই মধ্যে রাষ্ট্র পরিচালিত জাতীয় টেলিভিশন কেন্দ্র বিটিভিতে আগুন দেয়া হয়। মোবাইল ডেটা অবরোধ করা হয়। বিষয়গুলো বাড়তে থাকলে সেই রাতে ইন্টারনেট পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।
রাস্তায় এপিসি (সেনা বহনকারী সাঁজোয়া যান) এর একটি সারি দেখা গেলে সামরিক বাহিনী নামার গুজব ছড়িয়ে পড়ে। অন্যরা প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন থেকে ১৫টি হেলিকপ্টার উড্ডয়নের দৃশ্য দেখলে গুজব ছড়ায় প্রধানমন্ত্রী পালানোর চেষ্টা করছেন। সারারাত গোলাগুলি ও গুলির শব্দ শোনা যায়।
১৯ জুলাই, ২০২৪
ইন্টারনেটের মতো জাতীয় টেলিভিশন কেন্দ্র বিটিভি বন্ধ। অর্ধ-শতাধিক মানুষ নিহতের কথা শোনা যায়। সরকারপন্থী সংবাদ কেন্দ্রগুলি প্রতিবাদী শিক্ষার্থীদের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালে পাকবাহিনীর বহুল ব্যবহৃত “দুর্বৃত্ত” অভিহিত করতে শুরু করে।
আরো মিল রয়েছে। নিপীড়ক শাসকগোষ্ঠীর ভয় কাটানো ক্ষুব্ধ জনতার হাত থেকে বাঁচার জন্যে একটি অত্যাচারী স্বৈরশাসকের আকুতি। অনেক বেশি বিক্ষোভকারী জড়ো হওয়ায় আবু সাঈদের স্মরণে সংসদ ভবনের বাইরে সকালের বিক্ষোভে বাধা দেওয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
ইন্টারনেট আংশিকভাবে পুনরুদ্ধার হলেও বিটিভি চালু হয়নি। তখনই সারাদেশে হামলার খবর আসতে থাকে। পুরানা পল্টনে বামপন্থী নেতা জোনায়েদ সাকিসহ দলের অন্য সদস্যদের বেধড়ক মারধর করা হয়। পুলিশ-সমর্থিত পাহারাদাররা ক্রমবর্ধমান বিক্ষুব্ধ বিক্ষোভকারীদের দমনের মরিয়া চেষ্টা করে। মরিয়া সরকার একটি চুক্তি প্রস্তাব করে।
রবিবার আদালত আহ্বান ও কর্তৃপক্ষের সংলাপের প্রস্তুতি। শিক্ষার্থীদের জবাব, “মানুষের লাশের উপর বসে নয়।” “বেসামরিক ক্ষমতার সহায়তায়” হস্তক্ষেপ চেয়ে সামরিক বাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতাদানের নতুন গুজব বিদ্রূপাত্মক বলে মনে হচ্ছে। জনগণ কথা বলেছে। সমাধান নিকটবর্তী।