পাকিস্তান প্রায়শই নাগরিকদের অধিকার লঙ্ঘনের জন্যে রাষ্ট্র ব্যবহৃত শব্দ জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে আনুষ্ঠানিকভাবে সামরিক আন্ত-বাহিনী গোয়েন্দা সংস্থাকে (আইএসআই) নাগরিকদের ফোন কল ও বার্তায় হস্তক্ষেপের অনুমোদন দিয়েছে। পাকিস্তানের সর্বোচ্চ আদালতের সংবিধানের ১৪ অনুচ্ছেদে উল্লেখিত মানুষের মর্যাদা লঙ্ঘন করে এই ধরনের নজরদারি অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করে রায় সত্ত্বেও এই অনুমোদন অব্যাহত রয়েছে।
কারাবন্দী প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের স্ত্রী বুশরা বিবি সংক্রান্ত একটি চলমান অডিও ফাঁস মামলা চলাকালে ইসলামাবাদ উচ্চ আদালতকে (আইএইচসি) কোনো আইনি সমর্থন ছাড়া একটি আইনি হস্তক্ষেপ ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা (এলআইএমএস) চালু হওয়ার বিষয়ে জানানো হয়। আইনি হস্তক্ষেপটি, আদালতের আদেশ বা আইনি অনুমোদনসহ নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তু কোনো টেলিযোগাযোগ গ্রাহকের ফোনে আঁড়ি পাত্তে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলিকে অনুমতি দেয়। দেশের টেলিযোগাযোগ সংস্থাগুলি গোয়েন্দা সংস্থাগুলিকে এলআইএমএসের মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের ২ শতাংশ (প্রায় ৪০ লক্ষ) ফোন কল, বার্তা ও ওয়েব অনুসন্ধানের ডেটায় প্রবেষাধিকার দেয়। পরে সরকার একটি সংবিধিবদ্ধ নিয়ন্ত্রক আদেশ (এসআরও) বিজ্ঞপ্তি জারি করে আইএসআইকে পাকিস্তান টেলিযোগাযোগ আইন ১৯৯৬ এর ৫৪/১ ধারায় নাগরিকদের নিরীক্ষণের অনুমোদনের মাধ্যমে এটিকে আইনি সুরক্ষা দেয়।
বিতর্কিত এই সিদ্ধান্তটি সামাজিক গণমাধ্যমে বিরোধীদলীয় নেতা, নাগরিক ও ডিজিটাল অধিকার কর্মীদের মধ্যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। তাদের যুক্তিতে এটি সংবিধানের ৪ ধারায় বর্ণিত নাগরিক অধিকার লঙ্ঘন করে।
পাকিস্তানের মানবাধিকার কমিশন (এইচআরসিপি) বলেছে বিজ্ঞপ্তিটি স্পষ্টভাবে নাগরিকদের সাংবিধানিকভাবে সুরক্ষিত অধিকার লঙ্ঘন করে:
🔴 HRCP is deeply concerned by the recent unconstitutional notification issued by the federal government giving intelligence personnel carte blanche to intercept and trace the calls of any citizen in the interest of ‘national security’.
The notification is in flagrant violation…
— Human Rights Commission of Pakistan (@HRCP87) July 10, 2024
🔴 এইচআরসিপি ‘জাতীয় নিরাপত্তার’ স্বার্থে যেকোনো নাগরিকের কলে হস্তক্ষেপ ও অনুসন্ধানের জন্যে কেন্দ্রীয় সরকারের জারি করা সাম্প্রতিক অসাংবিধানিক বিজ্ঞপ্তি নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।
বিজ্ঞপ্তিটি স্পষ্ট লঙ্ঘনের মধ্যে রয়েছে
আন্তর্জাতিক বিচারকদের কমিশনের দক্ষিণ এশীয় আইনি উপদেষ্টা রিমা ওমর কেন এই বিজ্ঞপ্তিটি অসদুদ্দেশ্যে করা হয়েছে তা তুলে ধরেছেন:
1. The Government’s notification authorising the ISI to intercept and trace calls is mala fide, unlawful, and a glaring surrender of human rights and fundamental freedoms
Some reasons why: pic.twitter.com/bW2U3eWah2
— Reema Omer (@reema_omer) July 10, 2024
১. আইএসআই-কে কল হস্তক্ষেপ ও অনুসন্ধানের অনুমোদনের সরকারি প্রজ্ঞাপনটি অসৎ, বেআইনি এবং মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার স্পষ্ট আত্মসমর্পণ
এটি কারণগুলির একটি।
পাকিস্তানে নজরদারি আইনসমূহ:
পাকিস্তান ১৯৪৭ সালে তার স্বাধীনতার পর থেকে তার নাগরিকদের নজরদারির জন্যে বিভিন্ন বিধি ও আইন ব্যবহার করে আসছে। জননিরাপত্তার স্বার্থে বা জরুরী অবস্থার সময় টেলিগ্রাফ আইন ১৮৮৫ বার্তায় হস্তক্ষেপ ও অনুমোদিত টেলিগ্রাফ নিয়ন্ত্রণের অনুমতি দেয়। কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা আইন ১৯৭৪ এর লক্ষ্য পাকিস্তান দণ্ডবিধি, সরকারি গোপনীয়তা আইন এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের আওতায় অপরাধসহ বিভিন্ন লঙ্ঘন প্রতিরোধ ও সনাক্ত করা। পাকিস্তান টেলিযোগাযোগ আইন ১৯৯৬-তে টেলিযোগাযোগের নজরদারি ও হস্তক্ষেপের একটি কাঠামোর রূপরেখা রয়েছে।
সাম্প্রতিক ন্যায্য বিচারের জন্যে তদন্ত আইন ২০১৩ আদালতের আদেশে ইমেল ও টেলিফোন কলের মতো যোগাযোগের বিভিন্ন ধরনে প্রবেশের অনুমতি দিলেও তদন্তকারী সংস্থাগুলিকে ব্যক্তিগত যোগাযোগ পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা দেয়নি। পাকিস্তান টেলিযোগাযোগ কর্তৃপক্ষকে (পিটিএ) ২০১৬ সালের ইলেকট্রনিক অপরাধ প্রতিরোধ আইন (পিইসিএ) ইন্টারনেটে তথ্য অবরোধ বা অপসারণের ক্ষমতা দিয়েছে। টেলিফোনের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের পর্যবেক্ষণ ও আপস ২০১০ পরিষেবা প্রদানকারীদের বাস্তব সময়ে নেটওয়ার্ক ট্রাফিক পর্যবেক্ষণ ও রেকর্ড করার ব্যবস্থা স্থাপনে বাধ্য ও সংকেতায়নের সফ্টওয়্যার ব্যবহার নিষিদ্ধ করে পিটিএকে ইন্টারনেট পরিষেবা প্রদানকারীদের চালু করা বাধ্যতামূলক একটি পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থার মাধ্যমে সকল ইন্টারনেট ট্রাফিক নিরীক্ষণের ক্ষমতা দিয়েছে।
পাকিস্তানে অডিও ফাঁসের ইতিহাস
অতীতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা তাদের ব্যক্তিগত টেলিফোন কথোপকথন প্রকাশ্যে আনার অভিযোগ করেছে। উল্লেখযোগ্য বেনজির ভুট্টো বনাম পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি মামলায় সরকারকে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় রাজনৈতিক বিরোধীদের ফোনে আঁড়ি পাতার জন্যে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। সর্বোচ্চ আদালত রায় দিয়েছে গোপনীয়তা ও বাক স্বাধীনতার সাংবিধানিক অধিকার রক্ষার্থে যথাযথ আইন প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত ফোনে আঁড়ি পাতার প্রতিটি ক্ষেত্রে সরকারকে কমিশন বা সর্বোচ্চ আদালতের অনুমতি নিতে হবে। সংসদ ২০১৩ সালে ন্যায্য বিচারের তদন্ত আইন পাস করে।
ফেব্রুয়ারির ৮ তারিখের নির্বাচনের অব্যবহিত পূর্বে বিভিন্ন রাজনীতিবিদ, সামরিক কর্মকর্তা ও বিচারকদের নিয়ে অডিও এবং ভিডিও ফাঁসের একটি সিরিজ সামাজিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উৎপাদিত বিষয়বস্তুর আবির্ভাব রেকর্ড করার সত্যতা নির্ধারণে ময়না তদন্তের প্রয়োজন হওয়ায় জটিলতা ও সম্ভাব্য হুমকি যোগ করলে এই ফাঁসের অনেকগুলিকে খণ্ডন অথবা নীরবতার সাথে দেখা হয়। জবাবদিহিতা আদালতের বিচারককে নিয়ে ২০১৯ সালের ভিডিও কেলেঙ্কারির মামলায় পাঞ্জাব ময়না তদন্ত বিজ্ঞান সংস্থাআইন ২০০৭ এর ৯(৩) ধারা অনুসারে সর্বোচ্চ আদালত রায় দেয় “পাঞ্জাব ময়না তদন্ত বিজ্ঞান সংস্থার কোনো বিশ্লেষকের ময়না তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি না হওয়া পর্যন্ত আদালত কোনো অডিও টেপ বা ভিডিওর উপর নির্ভর করবে না।
এই সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়া:
সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ওমর আইয়ুব খান গোয়েন্দা সংস্থা আইন প্রণেতাদের লক্ষ্যবস্তু করবে মনে করে বিজ্ঞপ্তিটিকে “কালো আইন” হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রী খাজা আসিফ, এই পদক্ষেপের একজন শক্তিশালী সমর্থক, রাজনীতিবিদদের ফোন কলের অননুমোদিত নজরদারিতে জড়িত সামরিক সংস্থার (আইএসআই) প্রতি ইমরান খানের সমর্থনের কথা স্মরণ করেছেন।
পাকিস্তান আইনজীবী পর্ষদের (পিবিসি) ছয় সদস্য ইসলামাবাদ উচ্চ আদালতে গণনজরদারি বৈধ করার সরকারের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে আদালতকে এটি বাতিল ও অকার্যকর ঘোষণার অনুরোধ করেছে। লে আঁড়ি পাতা গোপনীয়তার প্রতি একটি গুরুতর আক্রমণ এই যুক্তিতে লাহোর উচ্চ আদালতে এই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে একটি আবেদনও দাখিল করা হয়েছে।
গ্লোবাল ভয়েসেস এলআইএমএস নিয়ে পাকিস্তান টেলিযোগাযোগ কতৃপক্ষের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, “আমরা এই বিষয়টি পরিচালনা করি না, আর পিটিএ এধরনের কার্যকলাপের সাথে জড়িত নয়।”
গ্লোবাল ভয়েসেস হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে অলাভজনক গণতন্ত্রের জন্যে গণমাধ্যমের সাদাফ খানের সাথে নজরদারি নিয়ে সচেতনতার অভাব সম্পর্কে কথা বলেছে। তিনি বলেছেন:
পাকিস্তানের সাক্ষরতা কম থাকায় জনগণ খুব কমই নজরদারি বিধিগুলি বোঝে বা তা নিয়ে আলোচনা করে। সরকারি নজরদারির ভয় অনলাইনে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে প্রভাবিত করে বলে এই সচেতনতার অভাব উদ্বেগজনক ৷ মূল সমস্যা হলো আমরা আদালতের নথির মাধ্যমে জেনেছি ২০১৩ সালের ন্যায্য বিচার আইন লঙ্ঘন করে এই নজরদারি ঘটেছে। এই উন্মোচন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত করে আত্ম বিধিনিষেধ আরোপের ভয় সৃষ্টি করতে পারে।
তিনি আরো বলেন রাষ্ট্রকে অবশ্যই ন্যায্যভাবে নজরদারি পরিচালনা করতে হবে:
পাকিস্তান চলমান সন্ত্রাসবাদের হুমকিসহ উল্লেখযোগ্য আইন প্রয়োগের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। নজরদারি বিশ্বব্যাপী আইন প্রয়োগকারীদের তদন্ত ও আইন প্রয়োগের একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। পাকিস্তান এধরনের আক্রমণাত্মক পদ্ধতির ন্যায্য ব্যবহার নিশ্চিত করতে সমনের প্রয়োজনীয়তা ও সময়োপযোগিতসহ আইনসম্মত নজরদারির বিচারিক পদ্ধতি চালু করে ২০১৩ সালে ন্যায্য বিচারের তদন্ত আইন প্রণয়ন করে। একইভাবে পিইসিএ ডিজিটাল নজরদারির পদ্ধতিতে বিচারিক হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা অন্তর্ভুক্ত করেছে। তবে পিটিএর বর্তমান অনুমোদনের মাধ্যমে এই সুরক্ষামূলক প্রক্রিয়াগুলি এড়িয়ে যাওয়া খুবই উদ্বেগজনক। জাতীয় নিরাপত্তা গুরুত্বপূর্ণ হলেও নজরদারির ন্যায্যতা ও যথাযথতা ন্যায়সঙ্গত নিশ্চিত করতে প্রতিরক্ষামূলক আইন প্রয়োগের একটি ভারসাম্য থাকতে হবে।
হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে ব্যারিস্টার আলী তাহির গ্লোবাল ভয়েসেসকে বলেছেন:
পাকিস্তানে বেসরকারি কোম্পানি ও টেলিযোগাযোগ প্রদানকারীদের মাধ্যমে নজরদারিতে মূলত রাষ্ট্রীয় নজরদারি জড়িত। গোপনীয়তা-লঙ্ঘনকারী আইন ও আইনি অনিশ্চয়তার মাধ্যমে এই সহযোগিতা ক্রিয়াশীল। এমনকি কোনো আইনি সমর্থন ছাড়াই, গোয়েন্দা সংস্থাগুলি অবৈধভাবে কল ও বার্তায় আঁড়ি পাতে ও রেকর্ড করে। ফাঁস হওয়া অডিওর শিকার হয়েছে প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতিসহ বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ।
বাধা দেওয়ার পিছনে উদ্দেশ্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি আরো বলেন:
এটা স্পষ্টতই আইনি উদ্দেশ্যে নয়। ফোনে অবৈধ আঁড়ি পাতাকে নির্দেশ করে আইএইচসি আদালত এগারো বছর ধরে কোনো আইনি বৈধতা না থাকার কথা প্রকাশ করেছে। নিরাপত্তার জন্যে হলেও সমনের অভাব এটিকে অবৈধ করে তোলে। সংবিধানের ১৪(১) ধারা ফোন কল পর্যন্ত গোপনীয়তার অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়। টেলিফোনে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ পর্যবেক্ষণ ও আপস (২০১০) এবং ন্যায্য বিচারের তদন্ত আইন (২০১৩) এর মতো নজরদারি নিয়ন্ত্রণকারী আইনগুলির ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট অপরাধের জন্যে আদালতের সমন ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের থেকে অনুমতির দরকার হয়৷ রাষ্ট্রীয় স্বার্থ পরিপন্থী বলে কোনো সংস্থার ইচ্ছামত কোনো ব্যক্তির গোপনীয়তা আক্রমণ করা উচিত নয়।