ব্রাজিলে বৈদ্যুতিক যানবাহন গতি পাওয়ার সাথে সাথে চীনের প্রভাবও উজ্জ্বল হচ্ছে

রিও ডি জেনিরোতে একটি নিসান লিফ বৈদ্যুতিক যান ট্যাক্সি হিসেবে কাজ করছে। ছবি উইকিপিডিয়া থেকে নেওয়া। সৃজনী সাধারণ একইরকম ব্যবহার ৩.০ অনুমতি

ব্রাজিল বিশ্বব্যাপী ষষ্ঠ-সর্বোচ্চ গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমন করে, যার মোট নির্গমনের প্রায় ১৬ শতাংশের জন্যে শুধুই পরিবহন দায়ী। ডিজেল ও পেট্রলের উল্লেখযোগ্য ব্যবহার এর অন্যতম প্রধান কারণ। গবেষণায় দেখা গেছে বৈদ্যুতিক যানবাহন (ইভি) ব্যাটারির কারণে তৈরিতে আরো বেশি শক্তির দরকার হওয়া সত্ত্বেও তা তাদের জীবদ্দশায় গ্যাসোলিন-চালিত যানবাহনের তুলনায় যথেষ্ট কম কার্বন নির্গমন করে। নির্গমনের এই পার্থক্যের কারণে ইভিগুলি ব্রাজিলের সবুজ শক্তি পরিবর্তনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

ব্রাজিলে ইভির সিংহভাগই চীন থেকে আমদানি করা। এর ক্রমবর্ধমান অভ্যন্তরীণ শিল্পকে রক্ষার জন্যে ব্রাজিল চীনা ইভির উপর একটি আমদানি কর পুনঃপ্রবর্তনের পাশাপাশি বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশীয় কোম্পানিগুলির উদ্ভাবনকে সমর্থন করার একটি নতুন নীতি মুভার জারি করেছে। চীনা কোম্পানিগুলি নতুন নীতির সাথে তাল মেলাতে ব্রাজিলের ইভিগুলির ব্যাটারি তৈরির একটি মূল কাঁচামাল লিথিয়াম নিষ্কাশন শিল্পে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ লাভের চেষ্টা করছে ৷

ব্রাজিলের ২১.৫ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে, গত কয়েক বছরে ক্রমাগত ইভির জনপ্রিয়তা বেড়েছে। আগের বছরেরতুলনায় ২০২৩ সালে ইভি গাড়ির বিক্রি ৯১ শতাংশ বেড়েছে যার বেশিরভাগই চীনা ইভি আমদানি ও চীনা উৎপাদকদের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের কারণে। তবে ব্রাজিলের বাজারে চীনা কোম্পানিগুলো এগিয়ে যাওয়া স্বত্ত্বেও তারা উচ্চ মূল্য, অবকাঠামোর অভাব ও বর্তমানে ব্রাজিলের উচ্চ অর্থনৈতিক শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ বাজারের কারণে বাধার সম্মুখীন হবে।

ব্রাজিলের আইনপ্রণেতারা দীর্ঘদিন ধরে অটো সেক্টরে সবুজ পরিবর্তনকে উৎসাহিত করে আসছে। ব্রাজিলের কেন্দ্রীয় সরকার ২০১৮ সালের প্রথম দিকে ২০৩০ সালের মধ্যে ব্রাজিলের মোট গাড়ি বিক্রয়ের ৩০ শতাংশ বৈদ্যুতিক গাড়ির বিক্রয়ের একটি লক্ষ্যমাত্রা ধরে “রোটা ২০৩০” পরিকল্পনা শুরু করে। গত ডিসেম্বরে রোটা ২০৩০ প্রতিস্থাপনের একটি নতুন কর্মসূচির মাধ্যমে গাড়ি নির্মাতাদের ইভি এবং হাইব্রিড গাড়িসহ টেকসই গতিশীলতায় বিনিয়োগের বিনিময়ে আর্থিক ঋণেপ্রবেশাধিকার দিতে “মুভার” চালু করে। এই কর্মসূচির উদ্দেশ্য হলো শক্তির কার্যকারিতায় বিনিয়োগ সম্প্রসারিত করে গাড়ি তৈরিতে পুনর্ব্যবহারের ন্যূনতম সীমা স্থাপন এবং কর ভর্তুকির মাধ্যমে কম দূষণের জন্যে প্রণোদনা তৈরি করা।

ব্রাজিলের উপ-রাষ্ট্রপতি জেরাল্ডো অ্যালকমিন এটিকে “ইতিহাসের বৃহত্তম কার্বনহ্রাস কর্মসূচি” হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কর্মসূচিটি ২০২৯ সালের জানুয়ারির মধ্যে প্রায় ৩৫০ কোটি মার্কিন ডলার আর্থিক ঋণ প্রদান করবে। বৈশ্বিক পরামর্শক কেপিএমজির মতে, যানবাহন খাতে মুভারেরকার্বন হ্রাস ত্বরান্বিত করার সম্ভাবনা রয়েছে।

ব্রাজিলের বৈদ্যুতিক যান (ইভি) বাজারের গতিশীলতা

এই কর্মসূচিগুলি ইভি বাজারকে উৎসাহিত করতে কাজ করছে বলে মনে হয়। ব্রাজিলীয় বৈদ্যুতিক যান সমিতির (এবিভিই) ডেটা অনুসারে ব্রাজিলে ২০২৩ সালে প্রচলিত যানবাহনের (ই -বাইক, বৈদ্যুতিক স্কুটার ও বৈদ্যুতিক মাইক্রোকার) তুলনায় সাধারণত ছোট, হালকা এবং বেশি শক্তি-দক্ষ বিদ্যুৎ-চালিত গাড়ির একটি প্রকার হালকা বৈদ্যুতিক গাড়ির (এলইভি) বিক্রি প্রায় ৯৪,০০০ ইউনিটে পৌঁছেছে। এটি ২০২৩ সালে ব্রাজিলে বিক্রি হওয়া সকল যানবাহনের মাত্র ৪.৩% হলেও ইভিগুলির বিক্রয় একটি নির্দিষ্ট ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় রয়েছে।

“চীন বুঝতে পেরেছে এই প্রযুক্তিটি বায়ু দূষণ হ্রাস, আমদানি করা তেলের উপর নির্ভরতা এবং ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের পরে অর্থনীতির পুনর্গঠনের মতো বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান করার ক্ষমতা রাখে,” ডায়ালগ আর্থের প্রতিবেদন অনুসারে এই কথা  বলেছেন ব্রাজিলের মোটরগাড়ির বাজারের অন্যতম প্রধান পরামর্শদাতা ব্রাইট কনসাল্টিংয়ের মুরিলো ব্রিগ্যান্টি।

স্থানীয় শিল্পের বিকাশকে উৎসাহিত করতে ব্রাজিল ২০২২ সালের জুলাই থেকে নতুন শক্তির গাড়ির উপর আমদানি কর বাড়িয়েছে। জানুয়ারি ২০২২ থেকে সম্পূর্ণ বৈদ্যুতিক যানবাহন ১০ শতাংশ আমদানি কর এই মাসে ১৮ শতাংশে বৃদ্ধি পাবে এবং জুলাই ২০২৬ এর মধ্যে ৩৫ শতাংশে পৌঁছাবে। এই বিপুল আমদানি কর এড়াতে কিছু চীনা গাড়ি কোম্পানি ব্রাজিলে কিছু উৎপাদন ক্ষমতা স্থানান্তর করতে শুরু করেছে। একটি প্রধান চীনা ইভি প্রস্তুতকারক বিওয়াইডি ব্রাজিলের উত্তর-পূর্বে বাহিয়াতে একটি বড় উৎপাদন স্থাপনা নির্মাণ শুরু করেছেএই নতুন কারখানাটি ২০২৪ সালের শেষের দিকে বা ২০২৫ সালের প্রথম দিকে কাজ শুরু করবে বলে আশা করা হচ্ছে। একটি বেসরকারি চীনা ইভি প্রস্তুতকারক গ্রেট ওয়াল মোটরস গত বছর ঘোষণা করেছে সাও পাওলো রাজ্যের ইরাসেমাপোলিসে তাদের কারখানাটি হয়তো ২০২৪ সালের দ্বিতীয়ার্ধে কাজ শুরু করবে।

লিথিয়াম প্রহেলিকা

ইভি গাড়ি প্রস্তুতকারকদের একটি কেন্দ্র হিসেবে ব্রাজিলকে আকর্ষণীয় করে তোলার আরেকটি কারণ হলো দেশটিতে বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারি তৈরিতে ব্যবহৃত লিথিয়ামের বিশাল মজুদ। ব্রাজিলীয় রাজ্য মিনাস গেরাইসের এক ডজন পৌরসভা জুড়ে বিস্তৃত জেকুইতিনহোনহা উপত্যকার ৪৫টি সঞ্চিতি সমন্বিত দেশের বৃহত্তম লিথিয়াম মজুদ। সেই একই অঞ্চলে রয়েছে কুইলোম্বোলাস (স্বাধীনতার জন্যে পালিয়ে প্রাক্তন ক্রীতদাসদের সম্প্রদায় কুইলোম্বো) এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ের মতো কয়েক ডজন ঐতিহ্যবাহী ব্রাজিলীয় গোষ্ঠীর বাসস্থান।

সিইবিসি’র একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৫ সালে ব্রাজিলে কার্যত লিথিয়ামের কোনো উৎপাদন না থাকলেও ২০২৩ সালে ছিল বিশ্ব বাজারের দুই শতাংশ৷ একই বছর ব্রাজিল সেই অঞ্চলে খননকৃত লিথিয়ামের প্রথম ব্যাচ চীনে রপ্তানি করলেওকিন্তু বিওয়াইডি-এর মতো চীনা বিভিন্ন কোম্পানি উপাদানের বিষয়ে বড় কিছু করার আগ্রহ দেখায়। রয়টার্স অনুসারে জানুয়ারিতে বিওয়াইডি একটি সম্ভাব্য সরবরাহ চুক্তি, যৌথ উদ্যোগ বা অধিগ্রহণের বিষয়ে মিনাস গেরাইসের বর্তমান অপারেটর সিগমা লিথিয়ামের সাথে আলোচনা করছে। লিথিয়াম বৈদ্যুতিক যানবাহনে রূপান্তরের একটি মূল উপাদান হলেও এর নিষ্কাশনে দৃশ্যপটের বন্যপ্রাণী ও মজুদের কাছাকাছি অবস্থিত মানুষদের প্রভাবিত করা উচ্চ পরিবেশপ্রতিবেশগত খরচ রয়েছে।

লিথিয়াম খনির পরিবেশগত প্রভাব সুস্পষ্ট এবং সুদূরপ্রসারী। উদাহরণস্বরূপ, লিথিয়াম খনির কাজকর্মের জন্যে সেই খনির এলাকায় একটি মূল্যবান সম্পদ বিবেচিত বিপুল পরিমাণ মিঠা পানি সরানো হয়েছে

বৈদ্যুতিক যানবাহন প্রস্তুতকারকের লিথিয়ামের চাহিদা ইলেকট্রনিক অ্যাসেম্বলি লাইন বা সেল ফোনের তুলনায় অনেক বেশি। একেকটি গাড়িতে গড়ে ৫০ কিলো (১১০পাউন্ড) এবং বাসে ২০০ কিলো (৪৪১ পাউন্ড) পর্যন্ত। সিইবিসি প্রতিবেদনে অনুমান করা হয়েছে লিথিয়ামের বৈশ্বিক চাহিদা আগামী বছরগুলিতে বেড়ে ২০৩০ সালে ১৮ মিলিয়ন টনে পৌঁছতে পারে, যা ২০২০ সালের রেকর্ডের চেয়ে ছয় গুণ বেশি।

শিল্পটি আশাব্যঞ্জক হলেও ব্রাজিলের ইভি গাড়ি নির্মাতাদের দুটি গুরুত্বপূর্ণ বাধা: দহন যানবাহনের তুলনায় উচ্চ মূল্য এবং বিশাল মহাদেশীয় অনুপাতের সাথে একটি দেশে চার্জিং স্টেশনের জন্যে একটি শক্ত অবকাঠামোর অভাব অতিক্রম করতে হবে। একটি আন্তর্জাতিক অ্যাকাউন্টিং কোম্পানি ইওয়াই পরিচালিত একটি সমীক্ষায় ২০২৩ সালের শেষের দিকে প্রায় ৫৭ শতাংশ ব্রাজিলীয় প্রধানত জ্বালানির উচ্চমূল্যের কারণে তারা একটি ইভি কিনতে ইচ্ছুক। একই সমীক্ষা অনুসারে প্রায় ৩০ শতাংশ উত্তরদাতা অপর্যাপ্ত চার্জিং পরিকাঠামোর কারণে এসময় ইভি কিনতে দ্বিধা বোধ করছেন।

বৈদ্যুতিক গতিশীলতার তৃতীয় বার্ষিক নির্দেশিকা অনুসারে, ২০১৯সালে, ব্রাজিলে মাত্র ২২০টি চার্জিং স্টেশন ছিল। পরের কয়েক বছরে বিশাল পরিমাণে বেড়ে গিয়ে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর র পর্যন্ত, ৩,৮০০টি স্টেশন চালু ছিল। বৈদ্যুতিক গতিশীলতার জাতীয় মঞ্চের (পিএনএমই) অনুমান অনুসারে ২০২৫ সালের মধ্যে অন্তত ১০,০০০টি স্টেশন চালু থাকবে। অবকাঠামো তৈরি করতে কোম্পানিগুলোকে অতিরিক্ত পরিষ্রম করতে হচ্ছে। রয়টার্স অনুসারে, ফেব্রুয়ারিতে বিওয়াইডি ব্রাজিলের আটটি শহরে ৬০০টি চার্জিং স্টেশনের একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করতে শেল ও কোসান নিয়ন্ত্রিত একটি চিনি ও ইথানল ফার্ম রাইজেনের সাথে যুক্ত হওয়ার ঘোষণা  দিয়েছে।

আলোচনার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ব্রাজিলীয়দের কারা ইভি উত্তরণে অংশ নিতে পারবে?

পিএনএমই’র গবেষণা অনুসারে ইভি কেনাকাটা এখনো ব্রাজিলের দক্ষিণ-পূর্বে খুব কেন্দ্রীভূত, যা ২০২৩ সালে সকল ইভি বিক্রির অর্ধেক ছিল। তুলনামূলকভাবে উত্তর অঞ্চলটি বিক্রয়ের তিন শতাংশের কম প্রতিনিধিত্ব করে। ডেটা অনুসারে সবচেয়ে ধনী রাজ্যগুলি বেশি ইভি ক্রয় করে যা এই জাতীয় সরঞ্জামাদিতে সমান প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে জাতীয় নীতিমালার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেয়৷ দহন-ভিত্তিক যানবাহনের তুলনায় ইভি’র উৎপাদন খরচ ১০ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশ বেশি হওয়ার কারণে, তারা কেবল ব্রাজিলীয় উচ্চ আর্থ-সামাজিক শ্রেণীর কাছে প্রবেশযোগ্য।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .