পাকিস্তানে বর্তমান কয়েকটি চ্যালেঞ্জ হলো অস্থিতিশীলতা, গভীরতর অর্থনৈতিক সঙ্কট ও ব্যাপক সামাজিক অস্থিরতা। এই পটভূমিতে ধর্মীয় চরমপন্থা ও ব্লাসফেমি আইনের অপব্যবহারের সমস্যাটি ক্রমেই বেড়ে গিয়ে জীবনহানিসহ অন্যান্য ভয়কে দীর্ঘস্থায়ী করছে। এই উদাহরণগুলি দিয়ে রাজনৈতিক কর্মী ও মানবাধিকার রক্ষকরা পাকিস্তানকে “কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র” হিসেবে অভিযুক্ত করেছে।
কুরআনের প্রতি ব্লাসফেমির অভিযোগে শিয়ালকোটে গত ২০শে জুন একজন পর্যটককে পিটিয়ে হত্যা, একটি প্রকট প্রমাণ যে কিভাবে সহিংসতা ছড়িয়ে পরে৷ বিষয়টি এখনো পুরোপুরি তদন্ত করা না হলেও এ বিষয়ে একাধিক মতামত পাওয়া গেছে। পাঞ্জাব প্রদেশের এক স্থানয় পর্যটক উত্তর পাকিস্তানের সোয়াত উপত্যকায় ছুটি কাটানোর সময় তাকে ইসলামের পবিত্র গ্রন্থ পবিত্র কোরআন অবমাননার অভিযোগে একটি ক্ষুব্ধ জনতা পিটিয়ে হত্যা করে।
আরো পড়ুন: পাকিস্তানে ব্লাসফেমি অভিযোগের আরেকটি ঢেউ
স্থানীয় গণমাধ্যমের মতে, “সন্দেহভাজন পুলিশ হেফাজতে ব্লাসফেমির কথা অস্বীকার করলেও” তাকে “নিরাপদ” স্থানে স্থানান্তর করা হয়নি। পরে উত্তেজিত জনতা থানায় ধাওয়া করে তাকে মেরে তার লাশ পুড়িয়ে দেয়। কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত নীরব রয়েছেন এ বিষয়ে, পুলিশ শুধু একটি প্রাথমিক তথ্য প্রতিবেদন (এফআইআর) দায়ের করে হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত কথিত ২৩ সন্দেহভাজনকে একটি অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গেছে।
পাকিস্তানে মৃত্যুদন্ডযোগ্য বিবেচিত ব্লাসফেমির অভিযোগের পর হত্যাকাণ্ড বিরল নয়। এমনকি ভিত্তিহীন অভিযোগও কথিত অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও জনসহিংসতা উস্কে দিতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে মানবাধিকার সমালোচকরা যুক্তি দিয়ে আসছেন যে সংখ্যালঘুরা প্রায়শই এইসব অভিযোগের লক্ষ্যবস্তু হয়।
পাকিস্তানের জনসংখ্যার প্রায় ৯৬ শতাংশ মুসলমান। ইরান, ব্রুনাই এবং মৌরিতানিয়াসহ অন্যান্য দেশগুলিও ধর্ম অবমাননার জন্যে মৃত্যুদণ্ড দেয়।
নিবর্তনমূলক ব্লাসফেমি আইনের ইতিহাস
পাকিস্তানে ব্লাসফেমি আইন প্রথম প্রবর্তিত হয়েছিল ১৮৬০ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে (১৮৫৮-১৯৪৭)। মুসলমানদের পবিত্র নবীর প্রতি অবমাননাকর বলে বিবেচিত “রঙ্গিলা রসুল” বই প্রকাশের জন্যে মহাশে রাজপালকে ১৯২৭ সালে এক মুসলমান ছুতোর ইলম-উদ-দীন হত্যার বিখ্যাত ঘটনার পরে ভারতীয় দণ্ডবিধি ২৯৫ক এ ধর্মীয় অনুভূতি অবমাননার জন্যে কঠোর শাস্তির বিষয়টি যোগ করা হয়।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে স্বাধীনতা লাভের পর ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্ত হওয়ার পর থেকেই ব্লাসফেমির ঘটনা বেড়ে গেলেও জেনারেল জিয়া-উল-হকের সামরিক স্বৈরশাসনের সময় সেপ্টেম্বর ১৯৭৮ থেকে আগস্ট ১৯৮৮ পর্যন্ত এই ধরনের ঘটনার উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি দেখা যায়। তার শাসনামলে ব্লাসফেমি আইনে যুক্ত অতিরিক্ত ধারাগুলি সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলির জন্যে আরো ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে।
এসময় রাষ্ট্রে জিয়ার ইসলামীকরণের সংস্করণ চালু করা হয়। সেই সময়ে আফগানিস্তানে সোভিয়েত আক্রমণ হলে পাকিস্তানে চরমপন্থী বীজ লালনকারী রক্ষণশীল ইসলামী সংস্কার আন্দোলন ওয়াহাবিবাদের উত্থান দেখা যায়।
পাকিস্তানের ধর্মীয় সংখ্যালঘু – বিশেষ করে খ্রিস্টান, আহমেদি ও হিন্দুরা – ব্লাসফেমি আইনের অপব্যবহারের শিকার৷ এই সম্প্রদায়গুলি ভিত্তিহীনভাবে বা প্রমাণ ছাড়াই প্রায়শঃই ব্লাসফেমিতে অভিযুক্ত হয়। আদালতের যথাযথ প্রক্রিয়া ছাড়াই তারা প্রায়ই জনতার বিচারের সম্মুখীন হয়। পাকিস্তানের ব্লাসফেমি আইন সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলি ছাড়াও ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য বা স্বার্থ চরিতার্থে প্রায়শঃই মুসলমান সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়।
গবেষণা ও নিরাপত্তা পাঠ কেন্দ্রের (সিআরএসএস) একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ১৯৪৭ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ব্লাসফেমিতে অভিযুক্ত ৯৫ জনকে জনতা বা অন্যান্য বিচারবহির্ভূত উপায়ে হত্যা করা হয়েছে। গত তিন দশকে ১,৫০০ জনেরও বেশি লোকের বিরুদ্ধে ব্লাসফেমির অভিযোগ আনা হয়েছে।
রাজনৈতিক-ধর্মীয় ধাঁধাঁ
ব্লাসফেমিকে অপরাধ গণ্য করা ৭১টি দেশের মধ্যে ৩২টি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ, যদিও এই আইনগুলির শাস্তি ও প্রয়োগ ভিন্ন। ইরান, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ব্রুনাই, মৌরিতানিয়া ও সৌদি আরবে ব্লাসফেমির শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। অমুসলমান-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলির মধ্যে কঠোরতম ইতালির ব্লাসফেমি আইনে অপরাধটির সর্বোচ্চ শাস্তি তিন বছরের কারাদণ্ড।
ব্লাসফেমি অপরাধযোগ্য রাষ্ট্রসমূহে সরাসরি রাষ্ট্র আইনগুলি নিয়ন্ত্রণ ও প্রয়োগ করলেও পাকিস্তানি দৃশ্যপট ভিন্ন, যেখানে সামরিক স্থাপনা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী ও প্রভাবশালী দু’টি শক্তি। রক্ষণশীল উলামায়ে কেরাম – ইসলামী ধর্মতত্ত্বের বিশেষজ্ঞ জ্ঞানসম্পন্ন মুসলমান পণ্ডিতদের সংগঠন – ব্লাসফেমি ও ধর্মত্যাগের আইনের প্রতি তাদের সমর্থন এবং প্রাথমিকভাবে “যে তার ধর্ম পরিবর্তন করে, তাকে হত্যা কর” নবী কথিত উক্তি বা হাদিস ভিত্তিক।
এই অঞ্চলে ইসলামিকরণের প্রভাব ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে, এই দুটি শক্তি দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দৃশ্যপট রূপান্তরে সাহায্য করে, যা ধর্মীয় প্রভাবকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রবেশ করতে দেয়। ফলে শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের বিবাদে বিরোধীদের চাপ দেওয়ার জন্যে প্রায়ই বানোয়াট ব্লাসফেমির অভিযোগগুলি ব্যবহৃত হয়। উদাহরণস্বরূপ, অনেকেই পাঞ্জাবের প্রাক্তন গভর্নর সালমান তাসিরের হত্যাকারীর প্রশংসা করলে হত্যাকাণ্ডের পরে ব্যাপক সমর্থনসহ ধর্ম অবমাননাকারীদের শিরশ্ছেদ সমর্থনকারী অতি-ডান দল তেহরিক-ই-লাব্বাইক পাকিস্তানের (টিএলপি) উত্থান ঘটে।
টিএলপি ২০২১ সালে নিষিদ্ধ হলেও সরকারি সূত্র অনুসারে গ্রুপটির কিছু সদস্য সাম্প্রতিক সহিংসতায় জড়িত। তবে টিএলপি এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
মার্কিন ধর্মীয় স্বাধীনতা কমিশনের ২০২৩ সালে সংকলিত তথ্য অনুসারে, ব্লাসফেমির অভিযোগে পাকিস্তানে কমপক্ষে ৫৩ জন কারাগারে হেফাজতে রয়েছে।
অপরাধীদের জবাবদিহি করানো যাবে কি?
শুধু প্রাণঘাতী শক্তি নির্ভর পদক্ষেপ নিয়ে রাষ্ট্র প্রায়শই সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদকে উপেক্ষা করেছে। এটি ইসলামি পন্ডিত ও তাদের সহানুভূতিশীলদের নিযুক্ত বিভিন্ন হাইব্রিড কৌশলের প্রতিক্রিয়া হিসেবে বানোয়াট আইন পাস করতে চায়।
সাম্প্রদায়িক বিবাদ পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্যে একটি চ্যালেঞ্জ এবং নাগরিকদের জন্যে একটি বিপদ। ১৯৮০ ও ১৯৯০ এর দশকে হাজার হাজার লোক হত্যা করা বৃহদাকার সাম্প্রদায়িক হামলা এখন কম দেখা গেলেও সেগুলি এখন আরো বৈচিত্র্যময় ও জটিল রূপ ধারণ করেছে। তার ওপর দেশের প্রধান ইসলামী সম্প্রদায়গুলি আধুনিক যুগে একত্রিত হয়ে এই অঞ্চলে ব্লাসফেমির বিষয়ে একই অবস্থান প্রচার করছে।
পাকিস্তানে তরুণরা প্রায়ই ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা করে। একটি ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, “আমাদের মধ্যে বেশিরভাগই একজন ধর্মীয় নেতার মাধ্যমে স্থানীয় খ্রিস্টানদের কুরআন অবমাননা করার ভুল কথা শুনে তাদের পিটিয়ে হত্যা করে। এটি একটি সামাজিক সমস্যা। পাকিস্তানে চরমপন্থা ব্যাপক অর্থে গ্যাংগ্রিনের মতো।