
মালোরানেং গ্রাম। কলোনিস্ট প্রতিবেদনের ছবি, অনুমতিসহ ব্যবহৃত।
আট মাস ধরে এলফ্রেদাহ কেভিন-আলেরেচি, সেচাবা মোখেথি এবং সিন্ডি সিপুলা যুক্তরাজ্যের একটি হীরা খনির কোম্পানি সংলগ্ন বাসিন্দাদের বছরের পর বছর ক্ষোভের তদন্ত করেছে। কলোনিস্ট প্রতিবেদনে প্রথমবার প্রকাশিত তাদের তদন্ত প্রতিবেদনটি একটি বিষয়বস্তু ভাগাভাগি চুক্তির অংশ হিসেবে গ্লোবাল ভয়েসেসে এর একটি সংক্ষিপ্ত সংস্করণ পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে।
স্থানীয় সম্প্রদায়ের বিশুদ্ধ জলের প্রবেশযোগ্যতা উন্নত করার জন্যে পুরষ্কারপ্রাপ্ত যুক্তরাজ্য ভিত্তিক একটি হীরা খনির কোম্পানী জেম ডায়মন্ডস লিমিটেড দক্ষিণ আফ্রিকার লেসোথোতে তিনটি গ্রামে পানীয় জলকে দূষিত করার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে৷
কলোনিস্ট প্রতিবেদন ২০২৩ সালের ৩১ অক্টোবর লেসোথোর মালুতি পর্বতমালার তিনটি গ্রাম — মালোরানেং, প্যাটিসিং এবং লিথাকং পরিদর্শন করে। আমাদের সাক্ষাৎকার গৃহীত সম্প্রদায়ের বাসিন্দাদের সবাই তাদের পানীয়, রান্না, ধোয়া ও মাছ ধরার জলের প্রধান উৎস নদীটিতে বর্জ্য জল প্রবাহিত করার জন্যে জেম ডায়মন্ডসের একটি সহযোগী সংস্থা লেটসেং ডায়মন্ডসকে দায়ী করেছে।
আমাদের সাক্ষাৎকার নেওয়া আদিবাসীদের অভিযোগ অনুসারে জলের দূষণ প্রাণীদের মৃত্যু, মাছের বিলুপ্তি, স্থানীয়দের অসুস্থতা এবং একটি শিশুর মৃত্যুর কারণ হয়েছে।
একটি উপগ্রহ গৃহীত ছবিতে কোম্পানির স্থাপনা থেকে ফিয়ান সম্প্রদায়ের নদীতে যুক্ত একটি সন্দেহভাজন পাইপের মতো দেখা যাচ্ছে।
আমরা ২৪ জানুয়ারি লেটসেং ডায়মন্ডস বর্জ্য জলের পাইপ থেকে সম্প্রদায়ের নদীতে প্রবেশ করার আগে প্রবাহিত জলের নমুনা সংগ্রহ করেছি। অতিরিক্ত পানির নমুনা ফিয়েন নদীসহ (কোম্পানীর ঘেরের বেড়া থেকে ৫০ মিটার দূরে) প্যাটিসিং ও মালোরানেং নদীর প্রবাহ থেকে নেওয়া হয়।
আমরা পরীক্ষার জন্যে প্রতিবেশী দক্ষিণ আফ্রিকার একটি পরীক্ষাগারে পানির নমুনা পাঠিয়েছি। পরীক্ষার ফলাফলে উচ্চ মাত্রার এসচেরেচিয়া কোলাই (ই কোলাই) ১২ এমপিএন/১০০মিলিলিটার যা ১ এমপিএন/১০০মিলিলিটারের সীমা এবং ৩০ মিলিগ্রাম/লিটার নাইট্রেটের উপস্থিতি ১১মিলিগ্রামের গ্রহণযোগ্য ঊর্ধ্বসীমা অতিক্রম করেছে। নাইট্রেট এবং ই. কোলাই উভয় স্তরই মানব স্বাস্থ্য ও প্রাণীদের জন্যে ক্ষতিকর।
মার্কিন জাতীয় জৈবপ্রযুক্তি তথ্যকেন্দ্র অনুসারে, ই. কোলাই দূষিত পানি পান করার ফলে ডায়রিয়া, পেটে ব্যথা, বমি বমি ভাব ও অন্ত্র সংক্রমণের মতো অসুখ হতে পারে। নাইট্রেট গর্ভবতী মহিলাদের জন্যেও ক্ষতিকর হতে পারে। ই. কোলাই হলো পয়ঃনিষ্কাশন বা পশু দূষণের একটি স্পষ্ট সূচক।
সম্প্রদায়ের সংগ্রাম
জেম ডায়মন্ডস যে নদীতে বর্জ্য ফেলতো ২০১৫ সালে মালিনিও মোয়াহির নয় বছর বয়সী নাতনী তার জল পান করে অসুস্থ হয়ে মারা গেছে বলে জানা যায়।
মোয়াহি আমাদের বলেছেন তার নাতনির ফুসকুড়ি ও শ্বাসকষ্টের সাথে পেটে ব্যথা হলে তিনি তাকে স্থানীয় ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তার গ্রামে কোনো হাসপাতাল বা সাধারণ পরিবহণ না থাকায়, তিনি তার নাতনিকে তার পিঠে নিয়ে উচ্চ পাহাড়ের মধ্য দিয়ে তিন ঘন্টা হেঁটে মাফোলানেং ক্লিনিকে নিতে চেষ্টা করেন। “আমার পিঠে বাচ্চা মারা যাওয়ায় আমাকে অর্ধেক পথ ফিরে আসতে হয়।”
মোয়াহি আরো জানান, “আমাদের কথা বলার সময়ও স্থানীয় শিশুরা পেটে ব্যথায় কাতরাচ্ছে। খরার সময় পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়; জল খুব নোনতা হয়ে যায় এবং শিশুরা তা পান করে অসুস্থ হয়ে পড়ে।”
তার মতে, নদীর পানিতে গোসল করলে মুখে ফুসকুড়ি, ত্বকে চুলকানি, আর পেটে ব্যথা হয়। ” একই সময়ে না হলেও আমার আটটি সন্তানের সবার এই লক্ষণগুলি ছিল।”
মোয়াহির মতে, কোম্পানিটি কখনো কখনো বাঁধে জল ছেড়ে দিলে বর্জ্য গাদ স্লাইম বাঁধের জলের সাথে লবণাক্ত ও সাদা পদার্থের নিয়ে নেমে আসে।

ছবিতে লেটসেং হীরার খনি থেকে আসা জলে একটি সাদা পদার্থ দেখা যাচ্ছে৷ কলোনিস্ট প্রতিবেদনের ছবি, অনুমতিসহ ব্যবহৃত।
“খনি-দূষিত পানি পান করে কোনো প্রাণী অসুস্থ হয়ে মারা গেলে প্রাণীটির পেট কেটে আমরা সাদা লবণের পদার্থ দেখতে পাই,” মোয়াহি বলেন।
মাতোকেলো মোয়াহি নামে একজন ৪০ বছর বয়সী নারী বলেন, তার নয় মাস বয়সী নাতি দূষিত স্রোতের পানি দিয়ে স্নান করলে এবং এতে তার ন্যাপি ধুয়ে দিলে সাধারণত তার ত্বকে ফুসকুড়ি হয়।

মাতোকেলো তার গ্রামে মোয়াহি। কলোনিস্ট প্রতিবেদনের ছবি, অনুমতিসহ ব্যবহৃত।
একটি নির্ভরযোগ্য জলের কলে যাওয়া, কিন্তু খরার সময়, “আমরা নদীর আশ্রয় নিই,” তিনি বলেন।
প্যাটিসিং নদীর রাস্তাটি শুধু কোম্পানির ভেতর দিয়ে প্রবেশযোগ্য এবং ২০২৩ সালের ২৪ জানুয়ারি কলোনিস্ট প্রতিবেদনের সহযোগী অংশীদার অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার এমএনএন কেন্দ্র প্রবাহটির কাছে গিয়ে খনি থেকে কোম্পানির বর্জ্য জলের পাইপ থেকে স্রোতের ওপর খুববেলু নদীর সাথে মিলিত ফিয়ান স্রোতে প্রবাহিত হয়ে উচ্চ চাপে জল বেরিয়ে আসতে দেখেছে।
এদিকে জেলেরা আমাদের বলেছিল গাদের জন্যে বাঁধ তৈরি করার ফলে তারা আর মাছ ধরতে পারবে না। গ্রামবাসীরা এই বিষয়ে খনির বিরুদ্ধে মামলা করেছে যা লেসোথো উচ্চ আদালতে বিচারাধীন।
লেটসেং ডায়মন্ডস আসার আগে পরিস্থিতি ভিন্ন ছিল: “একটা ছোট মাছ ধরা পড়লে আমি এটাকে আবার জলে ফেলে দিতাম যাতে পরে একটা বড় মাছ ধরতে পারি, কিন্তু এখন, আমি এটা নিয়ে নিই কারণ মাছই তো নেই।” লাইকি লেমান্টলা নামে এক জেলে তার ছোট আকারের মাছটি দেখিয়ে বলেন, তিনি ১০ মিনিটেরও বেশি সময় পর এই মাছটি ধরতে পেরেছেন।

খুবেলু নদীর তীরে লাইকি লেমান্টলা মাছ ধরছেন। কলোনিস্ট প্রতিবেদনের ছবি, অনুমতিসহ ব্যবহৃত।
এই ৪২ বছর বয়সী জেলে দুই দশক ধরে মাছ ধরছেন। তার দুটি ছোট সন্তান ও একজন স্ত্রী আছে, যারা বেঁচে থাকার জন্যে তার উপর নির্ভর করে। তিনি বলেন, কিছু মাছ আশেপাশের গ্রামবাসীদের কাছে বিক্রি করার পর বাকিটা তিনি পরিবার মিলে খেতেন। “তবে নদীতে পর্যাপ্ত মাছ না পাওয়ায় এখন আমি কোনো বিক্রি করতে পারি না।”
কোম্পানির প্রতিক্রিয়া
জেম ডায়মন্ডস সম্প্রদায়ের জল নষ্ট করার কথা অস্বীকার করে পরিবর্তে জল সরবরাহ করে সম্প্রদায়কে সাহায্য করার দাবি করেছে৷
একটি ইমেলে জেম ডায়মন্ডের গণমাধ্যম কর্মকর্তা মার্ক এন্টেলমে বলেছেন সংস্থাটি সম্প্রদায়ের পরিবেশ সম্পর্কে খুব উদ্বিগ্ন এবং তাদের কার্যকলাপের প্রভাব কমাতে পদক্ষেপ নিয়েছে:
“আমরা উচ্চ স্তরের নাইট্রেট সম্পর্কে সচেতন যেগুলি আমাদের ফেলে দেওয়া বর্জ্য পাথর থেকে বের হয় এবং কিছুটা বের হয় আমাদের মোটা টেইলিং ডাম্প থেকেও।” তিনি জানান কোম্পানি “খনি লিজ এলাকা ছাড়ার আগে নাইট্রেটের মাত্রা এবং পরিবেশের উপর এর প্রভাব কমাতে” ব্যবস্থা স্থাপন করেছে।
অ্যান্টেলমে উল্লেখ করেছেন ব্যবস্থাগুলির মধ্যে বহনযোগ্য জল ধরে রাখার বাঁধ এবং এই অঞ্চলগুলি থেকে জলের নিঃসরণকে আটকে এবং পাতলা করার জন্যে একটি জলাভূমি রয়েছে।, তিনি সম্প্রতি সক্রিয় বর্জ্য পাথর ডাম্প থেকে পানিতে নাইট্রেটের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করার একটি বায়োরিমিডিয়েশন প্ল্যান্ট প্রস্তুত করার কথাও উল্লেখ করেছেন।
এমএনএন লেসোথোর একটি গোপনীয় প্রতিবেদনে কোম্পানিটিকে এই জলের উৎসগুলিকে দূষিত করার কথা স্বীকার করতে দেখা গেছে ৷
জেম ডায়মন্ডসের লেসোথোসহ সকল দেশের কার্যক্রম থেকে লাভবান হয়েছে। ২০২৩ সালে কোম্পানির সারাবছরে ১৬ লক্ষ ডলারসহ আয় ১৪.০৩ কোটি ডলার, অথচ তুলনামূলকভাবে ২০২২ সালে যার ১৮.৮৯ কোটি ডলার আয় থেকে ২.০২ কোটি ডলার লাভ।
জেম ডায়মন্ডস ২০১৭ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত মোট ১৩০ কোটি ডলার রাজস্ব এবং ২৫.৯ কোটি ডলার কর-পরবর্তী মুনাফাসহ লেটসেং খনি থেকে তার বেশিরভাগ মুনাফা করেছে।
জেম ডায়মন্ডস লিমিটেড জুলাই ২০০৬ সালে খনিটির ৭০ শতাংশ শেয়ার কেনার সময় লেসোথো সরকার লেটসেং হীরা খনির ৩০ শতাংশের মালিক। ডি বিয়ার্স ১৯৭৭ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত খনিটি পরিচালনা করার পর জেম ডায়মন্ডস কোম্পানিটির জন্যে ১১.৮৫ কোটি মার্কিন ডলার প্রদান করেছে বলে জানা গেছে।
কোম্পানীর মতে, লেটসেং খনি উচ্চ মানের রত্ন হীরা উৎপন্ন করে, যা ক্রমাগতভাবে বিশ্বের যেকোনো কিম্বারলি খনির ক্যারেট প্রতি সর্বোচ্চ মূল্য অর্জন করে। জেম ডায়মন্ডস ২০০৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত রেকর্ডকৃত ২০টি বৃহত্তম সাদা হীরার মধ্যে তিনটি তৈরি করেছে।
এই গল্পটি সাংবাদিকতা তহবিল ইউরোপের সহায়তায় তৈরি করা হয়েছে।