প্রায় চার বছর বয়সে আমার পরিবার বিহারে আমাদের গ্রাম থেকে পূর্ব ভারতের ঝাড়খণ্ডের একটি শহরে চলে আসে। বড় হয়ে আমি পড়াশোনায় দুর্বলতা প্রকাশ করলেই আমার বাবা-মা গ্রামে ফিরে যাওয়ার কথা বলতেন। আমাকে অনুপ্রাণিত করার এই সম্ভাবনাটি নারীদের সীমাবদ্ধতার প্রতি আমার চোখ খুলে দেয়। আমি অপ্রাপ্ত বয়সে বিয়ে হওয়া নারীদের চলাফেরায় সীমাবদ্ধতা এবং বিদ্যুৎ ও জলের মতো মৌলিক সম্পদে অনিশ্চিত প্রবেশাধিকার লক্ষ্য করেছি। সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী নারীরা অন্য কোথাও যাওয়ার সুযোগ ছাড়াই কীভাবে এমন চ্যালেঞ্জিং পরিবেশে বসবাস করতে বাধ্য হন তা আমাকে অবাক করে দেয়।
ব্যক্তিগতভাবে নিজ সংস্কৃতিকে – বিশেষ করে নিজেদের অবস্থার প্রতি নারীদের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আমার কৌতূহল সম্পর্কে – নথিভুক্ত করাও এটিকে আরো ভালভাবে বোঝার একটি প্রয়াস। আমার মাতৃভাষা অঙ্গিকা সংস্কৃতি ও ভাষা সংরক্ষণে অবদান রাখতে আমি এর মৌখিক লোকসাহিত্য রেকর্ড করি এবং উইকিমিডিয়া কমন্স (গণমাধ্যম ভান্ডার) এবং উইকিসোর্স (ফ্রি ডিজিটাল লাইব্রেরি এবং ট্রান্সক্রিপশন মঞ্চ) এর মতো উন্মুক্ত জ্ঞান মঞ্চে আপলোড করি। লোকশিল্পীদের রেকর্ড ও ভিডিওগুলি আপলোড করার পরে গবেষণায় ও অনলাইনে আঙ্গিকার ডিজিটাল উপস্থিতি বাড়াতে সম্ভাব্যভাবে ব্যবহার করার জন্যে আমি উপাদানটি কপিও করি। সর্বোপরি, লোকগীতি, গল্প, মৌখিক ইতিহাস ও বাণীর মতো সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এর চর্চাকারীদের অনন্য জীবনধারা, পছন্দ, সংগ্রাম ও মূল্যবোধকে তুলে ধরে।
আমি ২০২৩-২০২৪ সালে ভাষা পূনর্জীবিতকরণ বৃদ্ধি- উইকিটাঙসের থেকে সমর্থন পেয়ে লোকসাহিত্যের ৭৫টি অতিরিক্ত অংশ নথিভুক্ত করতে পেরেছি। এই নিবন্ধে আমি ভারতের বিহারের বাঁকা জেলার নারীদের চর্চিত কিছু অঙ্গিকা লোকগীতি নিয়ে আলোচনা করছি। আমার সংস্কৃতির অধিকতর নথিভুক্ত করতে গিয়ে আমি কিছু পুনরাবৃত্ত থিম লক্ষ্য করেছি যা এর চর্চাকারীদের দৈনন্দিন জীবনে একটি আভাস দেয় – বিশেষ করে কীভাবে গান ও গল্পগুলি প্রচলিত সমাজের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ ও নিজেদের ব্যক্তিত্বের জানান দিতে একটি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
বিয়ে ব্যবস্থায় অবদান রাখতে না পারা
“বাবা, গ্রীষ্মকালে বিয়ে দিও না” একটি কন্যা ও তার পিতার মধ্যে একটি কথোপকথনমূলক গানে কন্যা বিয়ে না করার অজুহাত দিচ্ছে। সে তার বাবাকে জ্যৈষ্ঠ-বৈশাখের (বিহারের উষ্ণতম মাস) সময় তাকে বিয়ে না দেওয়ার জন্যে অনুরোধ করছে কারণ এই মাসে আবহাওয়া অসহনীয়। উত্তরে তিনি একটি চন্দন গাছ লাগানো এবং মণ্ডপে একটি টেবিল ফ্যানের ব্যবস্থা করার কথা বলেন। সে জানে যে তাকে বিয়ে করতেই হবে, তবুও সে তার বাবার সহানুভূতি কাজে লাগিয়ে এটি স্থগিতের যথাসাধ্য চেষ্টা করে। অনিচ্ছুক কনের দৃষ্টিকোণ থেকে আরেকটি গানের উদাহরণ হলো “নদীর কিনারে কন্যা কার জন্যে বাজনা বাজছে” যেখানে একজন বাবা তার কন্যাকে বারাত বা বরের শোভাযাত্রা আগমনের কথা জানালে সে তাকে তার জন্যে একটি সোনার খাঁচা তৈরি করতে বলে যেখানে সে লুকিয়ে থাকতে পারে। সাধারণত, একজন নারীকে পরিবারের উপর তার নিরাপত্তার চাপ এড়াতে বিয়ে করা হয়, তাই সে অপরিচিত কাউকে বিয়ে না করে তার বাড়িতে তার স্বাধীনতা হারানোর প্রস্তাব দিচ্ছে। গানের কথাগুলো এরকম:
नदिया किनारे गे बेटी तोहर बाजा बाजे छे
हमरा सें मांगे छे बियाह
बनाबो बनाबो हो पापा सोने के पिंजरा
वेहे पिंजरा रहबे छपाय
আমার মেয়ে, তোমার জন্যে নদীর কিনারে বাজনা বাজছে
তারা আমার কাছে বিয়ের জন্যে তোমার হাত চায়
বাবা আমাকে একটা সোনার খাঁচা বানিয়ে দাও
আমি তাতে লুকিয়ে থাকবো
এই গানগুলি সেই নারী ও লোকশিল্প চর্চাকারীদের দৈনন্দিন বাস্তবতাকে চিত্রিত করে যাদের বিয়ের সিদ্ধান্ত ও সঙ্গী নির্বাচনে খুব কমই বলার আছে।
বিয়ে ছাড়াও উৎসব ও কৃষি চক্রের সময়ও গান গাওয়া হয়।
বিয়ের পর নারীর পরাধীন অবস্থান নিয়ে গান
একজন নারী বিয়ের পরে তার শ্বশুর বাড়িতে তার কর্তৃত্ব আরো কমে যায়। উদাহরণস্বরূপ, “খালে সাবান হারালে স্বামীর হাতে পিটুনির সম্ভাবনা” গানটি একটি ভগ্নিপতির উদ্দেশ্যে একটি স্বগতঃ সংলাপ। গায়িকা (স্ত্রী) পানিতে তার সাবান হারিয়ে ননদকে তার স্বামীর হাতে প্রহৃত হওয়ার ভয়ের কথা বলে; এতে তার বাবা-মায়ের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হতে পারে। এই গানটি একজন বিবাহিত নারীর তার স্বামীর বাড়িতে সমর্থনের অভাব ও সহিংসতার হুমকির কথা তুলে ধরে।
বেআইনি হলেও বিয়ের আলোচনার সময় যৌতুকের দাবি করা হয় এবং প্রায়ই বিয়ের পরেও কনেকে এনিয়ে হয়রানি করা হয়। “সে খুব আনন্দের সাথে যৌতুক চায়” গানটি একটি বিয়ের সময় প্রবল বৃষ্টির বর্ণনার দৃশ্যপটে শুরু হয়। বৃষ্টি বিয়ের পরিকল্পনা, স্যাঁতসেঁতে তাঁবু, বসার ব্যবস্থা ও মেজাজ ব্যাহত করতে পারে। তারপর গানটি রূপকভাবে বর্ণনা করতে বৃষ্টি ব্যবহার করে দহেজের (মালামাল, অর্থ, সম্পত্তি ইত্যাদি, কনের পরিবার বিয়ের শর্ত হিসেবে বরের পরিবারকে দেওয়া যৌতুক) দাবিকে কনের বাবা-মায়ের ওপর বজ্রপাতের তুলনা করা হয়েছে। সম্প্রতি বেশিরভাগ ভারতীয় নারীকে উত্তরাধিকারের সমান অংশ দেওয়া হলেও এখনো সামাজিকভাবে পৈতৃক সম্পত্তিতে বিয়ের পর তাদের অংশ ছেড়ে দেওয়ার আশা করায় তাদের যৌতুক “উপহার” বা গয়না আকারে তাদের একমাত্র সম্পত্তি থেকে যায়। এই নির্ভরতার চক্রে – প্রথমে তার জন্মগত বাড়িতে এবং তারপরে তার শ্বশুরবাড়িতে – নারী সাধারণত অধীনস্থ হয়।
অর্থগৃধু শ্বশুরবাড়িকে ভর্ৎসনা করে গান
গারি গানগুলি সাধারণত কনের বাড়িতে বিয়ের ভোজের সময় নারীরা নতুন শ্বশুরবাড়ির জন্যে গেয়ে থাকেন। বয়স্ক – সম্ভবত সম্মানিত পুরুষরা তাদের রাতের খাবারের টেবিল থেকে উঠতে শুরু করলে নারীরা “চোর” এবং “ত্যাগকারী” এর মতো মৃদু অপমানজনক শব্দগুলিসহ গান গেয়ে অন্যদেরকে তাদের মারধর করার আহ্বান জানায়:
जों जों समधी होलो पराय
हांथ गोड़ बांधी दिहो डेंगाय
पकड़िहो लोगो चोरवा भागल जाय
শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গী-সাথীরা সরে গেছে,
এবার হাতগুলি বেঁধে মারধর কর,
ধর ব্যাটাকে, চোর যেন পালিয়ে না যায়।
এখানে গানের সময়টা গুরুত্বপূর্ণ। পুরুষরা তাদের খাবার টেবিল থেকে উটে গেলেই কেবল গাওয়া হয়। খাওয়াকে অন্যান্য ধরনের জীবনধারণ বা কনের পরিবার থেকে প্রাপ্ত যৌতুকের মতো সম্পদের ব্যবহারের প্রতীকী হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয় বলেই এটি নিয়ে উপহাস করা হয়।
আরো বেশ কিছু গানের মধ্যে যৌতুক চাওয়া স্বামীর উদ্দেশ্যে গালিগালাজ রয়েছে। “ঘরা পিচুওয়ারিয়া”-তে মোটা যৌতুক নিয়েও সম্ভবত আরো যৌতুকের আশায় শাশুড়ির প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয় এমন বরের জন্যে স্পষ্ট গালাগালি রয়েছে। “পাহিরুন পাহিরুন”-এ এমন একজন মাকে দেখানো হয়েছে যার যৌতুক দেওয়ার পর মূল্যবান কিছুই অবশিষ্ট নেই, তবুও শাশুড়িটি সোনার থালা খুঁজে চলছে।
বিদ্রোহের অধিকার
কাকে ভালবাসতে হবে তা বেছে নেওয়ার অধিকারের জন্যে লড়াই করতে যে কেউ জোর করে বিদ্রোহ করতে পারে এই ধারণাটি গডনা গানে উচ্চারিত হয়েছে। গায়িকারা স্বচ্ছন্দ হলে উদযাপনের ভঙ্গীতে হাততালি দিতে ও হাসার পাশাপাশি সমাজের প্রতি কটাক্ষ চালিয়ে যেতে থাকে। গানটি তার প্রেমিকা বেছে নেওয়ার অধিকার খর্ব করার বিরুদ্ধে একজন যুবতীর প্রতিরোধের বর্ণনা দেয়। এটি একজন শুভাকাঙ্ক্ষী (সম্ভবত মা বা বন্ধু) এবং প্রেমে পড়া মেয়ে লিলিয়ার মধ্যে একটি কথোপকথন। লিলিয়া তার সৌন্দর্যের জন্যে প্রশংসিত, ঐতিহ্যগত উল্কি গডনা সজ্জিত। আমি এই গানটির দুটি সংস্করণ নথিভুক্ত করতে পেরেছি, প্রথম সংস্করণটি রেডিওতে পরিবেশনকারী একজন লোকশিল্পী গেয়েছেন। দ্বিতীয় সংস্করণটি গানটির নিয়মিত চর্চাকারী নারীরা গেয়েছে যেটিতে লিলিয়ার তীব্র প্রতিরোধ সম্পর্কে অতিরিক্ত গান রয়েছে। যে ছেলেটিকে সে ভালোবাসে সেই মোহনকে ছেড়ে দেওয়ার তীব্র ও সতর্ক বিরোধিতা করে সে ঘোষণা করেছে তাদের চ্যালেঞ্জকারী গ্রামের প্রধান বা স্থানীয় আদালতের আইনজীবীই হোক না কেন সে তার মুখোমুখি হতে প্রস্তুত।
जान नाहिर छोढ़बे मोहना तोरा संगतियो रे जान
किए करते मुखिया, सरपंचा
किए करते दरोगा पुलिसवा रे जान
আমি মোহনকে ছাড়বো না
দেখা যাক গ্রামপ্রধান ও পঞ্চায়েত প্রধান কী করে
দেখা যাক কনস্টেবল আর পুলিশ কি করতে পারে
এই গানটি ঝুমতা বা ঝুমারের সময় গাওয়া গানের বিভাগে পড়ে, একটি লোকনৃত্য যেখানে নারীরা গান গাওয়ার সময় একসঙ্গে নাচে। এই গানগুলি বিয়ের মতো আনন্দের অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয়, যেখানে নারীরা দলে দলে উৎসাহের সাথে নাচে, হাততালি দেয় এবং তালে তালে গান করে। অঙ্গিক-ভাষী নারীদের এই গানটি গ্রহণ তাদের স্বাধীনতা খর্ব করার বিরুদ্ধে তাদের বিদ্রোহকে প্রতিফলিত করে।
এমনকি এসব নির্দিষ্ট অনুষ্ঠানের বাইরেও ডকুমেন্টেশনের উদ্দেশ্যে রেকর্ড করার সময়, তারা রাগ উথাও (“গান শুরু করার” একটি অঙ্গিকা শব্দ) পছন্দ করে এবং একসাথে গান গাইতে পছন্দ করে। খুব কম সময়ই একা গাওয়া হয়। একটি দল হিসেবে, নারীরা তাদের অভিজ্ঞতা ও প্রত্যাশাগুলি ভাগ করে নিতে এই গানগুলি গায়। এই লোকগানগুলি গ্রামীণ ভারতের এই বিশেষ অংশে নারীবাদের সৃজনশীল শক্তি গ্রহণ প্রদর্শন করে।