২০২৩ সালে বাংলাদেশ চায়ে একটা রেকর্ড গড়েছে। প্রথমবারের মতো ১০ কোটি ২৯ লাখ কেজি চায়ের উৎপাদন হয়েছে। ১৮৪০ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদিদের দ্বারা প্রথম পরীক্ষামূলক চা চাষ শুরুর পর ১৮৪ বছরের ইতিহাসে এবারই প্রথম উৎপাদন ১০ কোটি কেজি ছাড়িয়েছে। উৎপাদিত চায়ের বেশিরভাগই দেশের চাহিদা পূরণ করে থাকে। এতে থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশ কতোটা চা-প্রেমী দেশ।
আসলেই তাই – চায়ের প্রতি বাংলাদেশীদের ভালোবাসা লক্ষণীয়। আমরা মন ভালো থাকলেও যেমন চা খাই। আবার মন খারাপ থাকলেও চা খাই। কেউ আবার দিন শুরু করে চা দিয়ে। কেউ আবার দিন শেষে ক্লান্তি তাড়ায় এক কাপ চায়ে। কেউ আবার ’এক কাপ চায়ে তোমাকে চাই’ এর সুরে প্রেম নিবেদন করে। আর এসব মিলিয়েই বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় চা ব্র্যান্ড তাদের ট্যাগলাইন করেছে- চা মানে লাইফটা ভরপুর।
তবে, যেইসব চা শ্রমিক আমাদের প্রতিদিনের চায়ের চাহিদা মেটান, তাদের কাছে চা মানে লাইফটা ভরপুর নয়। অভাবের তাড়নায় চা পাতা দিয়েই তারা মধ্যাহ্ন ভোজ সারেন। কারণ, চা বাগানে কাজ করে তারা যে মজুরি পান, সেটা দিয়ে নিয়মিত মাছ, মাংস, সবজির সংস্থান করতে পারেন না। বাধ্য হয়েই তারা চা পাতা ভর্তা করে, তাই দিয়েই খাবার খেয়ে থাকেন। চা পাতার এই ভর্তার নাম পাতিচখা। চা বাগানে ভ্রমণ করতে আসা লোকদের জন্যে ফেরিওয়ালারা এটি বেঁচে – কারো কাছে পাতিচখা খেতে ভালো লাগে, আবার কারো কাছে তেমন মজা লাগে না।
পাতিচখা খাবারটি কেমন?
বাংলাদেশে একজন চা শ্রমিকের দৈনিক মজুরি ১৭০ টাকা যদি তাড়া ন্যুনতম ২৫ কেজি চা পাতা তুলতে পারে। বর্তমানে বাজারে সবকিছুর দাম বেশি। মুদ্রাস্ফীতি ১০ শতাংশের কাছাকাছি। দিনে ১৭০ টাকা আয় করা একজন চা শ্রমিক ভাত-মাছ, মাংস খাওয়ার খরচ করতে পারেন না। তাছাড়া, তারা চা পাতা তোলার কাজে আসেন খুব ভোরে। যে চাল দিয়ে ভাত রান্না করেন, সেটি দীর্ঘ সময় ভালো থাকে না। গন্ধ হয়ে যায়। তাই চা পাতার ভর্তা বা পাতিচখা দিয়ে ভাত বা রুটি খাওয়াই নিরাপদ। আবার চায়ের কচি পাতার ভর্তা, কাজের ক্লান্তি দূর করতেও কাজ দেয়। তবে বিশেষজ্ঞরা বলেন যে দিনের পর দিন চায়ের কচি পাতা খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে হানিকর।
চা পাতা ভর্তা করে খাওয়ার চল কবে থেকে শুরু তার সঠিক সময়ের উল্লেখ কোথাও নাই। এটা তাদের বংশপরম্পরায় বহু প্রজন্মের অভ্যাস বলে জানা যায়।
পাতিচখা’র রেসিপি কঠিন কিছু নয়। এটা বানানো হয় চা পাতা হাতের তালুতে ডলে। প্রয়োজন হয় চায়ের কচি পাতা। সাথে লাগে পোড়া আলু, পেঁয়াজ, চানাচুর আর মরিচ। সবশেষে মুড়ি দিয়ে সবকিছু মিশিয়ে মাখানো হয়।
রন্ধনশিল্পী শিখা পাল হোমকুকদের প্লাটফর্ম কুকপ্যাডে পাতিচখা’র একটি রেসিপি শেয়ার করেছেন। সেখানে তিনি দুইজনের পাতিচখা করতে ২ টেবিল চামচ কচি চা পাতা, ১টি আলু সেদ্ধ, আধখানা টমেটো কুচি, আধা কাপ চানাচুর. ১টি পেঁয়াজ কুচি, আধা চা চামচ আদা কুচি, আধা চা চামচ লবণ, আধা চা চামচ নাগা মরিচ কুচি, ১ টেবিল চামচ ধনেপাতা কুচি, ১ চা চামচ সরিষার তেল লাগবে বলে জানিয়েছেন।
এরপর কচি চা পাতা, পেঁয়াজ, মরিচ, ধনেপাতা, আলু, আদা কুচি করে কেটে নিয়ে সব উপকরণ একটা পাত্রে একসাথে মিলিয়ে নিলেই তৈরি হবে চা পাতা ভর্তা বা পাতিচখা।
লিংকডইনে আবদুল হান্নান নামের চা পাতা ভর্তা খাওয়ার অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে লিখেছেন:
আমি খেয়েছি, খুব একটা সুস্বাদু কিছু না। অথচ তারা বলতে গেলে প্রতিবেলায় খায়। তবে প্রতিবেলায় মাখানোর জন্য সরিষার তেল আর চানাচুর পাওয়া যায় না। তবুও তারা খায় কারণ দুইশো টাকা কেজি ব্রয়লার মুরগীর এই বেহেশতে একদিনে তাদের বেতন ১২০ টাকা [এখন ১৭০ টাকা]। এক আঁটি শাক কিংবা এক কেজি সবজি কেনার চেয়ে চা পাতার ভর্তা দিয়ে দু'মুঠো ভাত খেয়ে ফেলাই তাদের জন্য সহজ।
বাংলাদেশের চা শিল্প
বাংলাদেশে চা চাষ শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ শাসনামলে। ১৮৪০ সালে বন্দর নগরী চট্টগ্রামে প্রথম চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে, বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু হয় সিলেটে। ১৮৫৭ সালে। বর্তমানে দেশে চা বাগান রয়েছে ১৬৭টির ও বেশি। এর বড় অংশটি সিলেট, হবিগঞ্জ এবং মৌলভীবাজার এলাকায় অবস্থিত। সব বাগানে শ্রমিক রয়েছে এক লাখ চল্লিশ হাজারের মতো যার মধ্যে নারীর সংখ্যা ৭৫%। এই চা-শ্রমিকদের অনেকেই বংশ পরম্পরায় এসব বাগানে কাজ করছেন।
১৮৬০-৭০ সালের দিকে আসাম ও সিলেট অঞ্চলে চা বাগানে বাণিজ্যিক সাফল্য দেখা দেয়ায় অনেক বিদেশি কোম্পানি বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে ওঠে। ফলে চা বাগান বাড়তে শুরু করে। সেই সঙ্গে আরও বেশি শ্রমিকদের চাহিদা দেখা দেয়। ভালো চাকরির লোভ দেখিয়ে চা-শ্রমিকদের ভারতের বিভিন্ন দারিদ্রপিড়িত স্থান থেকে আনা হয়েছিল।
ভাগ্য বদলাতে চা বাগানে কাজ করতে এলেও তাদের অবস্থার বদল হয়নি। ’হিস্টরি অব টি গার্ডেনস অ্যান্ড টি ওয়ার্কার্স অফ বাংলাদেশ’ বইয়ে রিয়াদ মাহমুদ ও আলিদা বিনতে সাকি লিখেছেন:
বাগান মালিকরা তাদের সম্পত্তি বলে মনে করতেন, মালিকরাই তাদের স্বাধীনতা নির্ধারণ করতেন, তাদের বিভিন্ন বাগানে আনা-নেয়া করা হতো। তাদের এমনকি বাগানের বাইরে যেতে দেয়া হতো না। তারা এখানে এসেছিলেন উন্নত জীবনের আশায়, কিন্তু এখানে এসে সারাজীবনের জন্য বন্দী হয়ে পড়েন। তাদের হয়তো কারাগারে আটকে রাখা হয়নি, কিন্তু দাসের চেয়ে তাদের অবস্থা ভালো ছিল না।
স্বাদে হোক, গন্ধে হোক, উষ্ণতায়ই হোক; আমাদের প্রতিদিনের মুহূর্তগুলো ভরপুর করতে এককাপ ধোঁয়া-ওঠা চায়ের জুড়ি নেই! অথচ চা শ্রমিকদের লাইফটা ভরপুর করার কোনো খবরও খুব একটা পাওয়া যায় না। চা পাতা ভর্তা খেয়েই তারা কাটিয়ে দিচ্ছেন একটা জীবন।