মেক্সিকোতে ডিজিটাল নজরদারি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপচ্ছায়া

আমাদের সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতিগুলির একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) মূল শিল্পগুলিতে বিপ্লব ঘটাতে প্রস্তুত হলেও ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার সাথে প্রযুক্তিটির ব্যাপক ব্যবহার ও স্থাপনার সাথে সম্পর্কিত সম্ভাব্য ক্ষতি ও ঝুঁকিগুলির যাচাই বাড়ানো হয়েছে। জাতিসংঘ মানবাধিকার বিশেষ করে গোপনীয়তার অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা ও ন্যায্য বিচারের অধিকারের উপর অনিয়ন্ত্রিত এআই ব্যবহারের হুমকিকে স্বীকার করলেও এআই গ্রহণ আইন প্রণয়ন সুরক্ষাকে ছাড়িয়ে যাওয়ায় তা কলুষিত ক্রিয়াশীলদের কাছে জনগণকে ঝুঁকিপূর্ণ করে চলছে।

সার্বজনীন উদ্বেগের একটি বিষয় হলেও কাউন্টি-স্তরের গতিশীলতা ও স্বতন্ত্র মানবাধিকার রেকর্ডের অর্থ হলো ঝুঁকিতে পড়ার মাত্রা দেশ থেকে দেশে এমনকি অঞ্চল থেকে অঞ্চলেও পরিবর্তিত হয়। লাতিন আমেরিকায়, নজরদারি প্রযুক্তি বাড়ছে এবং স্বচ্ছতার অভাব ব্যক্তি ও সামাজিক উভয় স্তরেই বাস্তব-জগতে প্রভাব ফেলছে। মেক্সিকো একটি প্রধান উদাহরণ।

সাধারণত সাংবাদিক, সুশীল সমাজের কর্মী ও সক্রিয় কর্মীদের ফোন ও যন্ত্রপাতি নজরদারির জন্যে ব্যবহৃত সফ্টওয়্যার পেগাসাস গোয়েন্দা সরঞ্জামের প্রথম নথিভুক্ত সরকারি গ্রাহক ও সবচেয়ে ব্যাপক ব্যবহারকারী মেক্সিকো ২০১১ সাল থেকে প্রযুক্তিটির পেছনে ৮ কোটি ডলারেরও বেশি খরচ করেছে। স্পষ্টতই সন্ত্রাসবাদী ও মাদক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্যে কেনা হলেও সাংবাদিক, সক্রিয় কর্মী ও রাজ নৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে এর ব্যবহার প্রমাণিত

পূর্ববর্তী প্রশাসনের অধীনে ২০১৪ সালে ইগুয়ালা ছাত্র নিখোঁজ তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের নজরদারি ও ভয় দেখানো একটি আন্তর্জাতিক কেলেঙ্কারির জন্ম দিলেও বর্তমান রাষ্ট্রপতি লোপেজ ওব্রাডরের আমলেও পেগাসাসের অসাধু ব্যবহার অব্যাহত রয়েছে, যা কুখ্যাত গোয়েন্দা সরঞ্জামটি ব্যবহারের এবং নাগরিক অধিকার ও স্বাধীনতার প্রতি এর সাধারণ সম্মানের একটি পদ্ধতিগত সমস্যার ইঙ্গিত করে।

সমস্যাটি পেগাসাস প্রকল্পের বাইরেও বিস্তৃত। মেক্সিকো সিটিতে চালু করা আমেরিকার বৃহত্তম শহুরে নজরদারি ব্যবস্থাটি এল সেন্ত্রো দে কোমান্দো, কম্পুতো, কমুনিকাসিওনেস  ই কন্তাক্তো সিউদাদানো  (নির্দেশ, নিয়ন্ত্রণ, হিসেব, যোগাযোগ ও নাগরিক যোগাযোগ কেন্দ্র) বা এলসি৫ নামে বেশি পরিচিত।  ভয়ের বোতাম ও নির্দেশ কন্দ্রের সাথে যুক্ত নেটওয়ার্কটি ১,৪৮৫ কিলোমিটার বিস্তৃত সফ্টওয়্যারসহ স্বয়ংক্রিয়ভাবে লাইসেন্স প্লেট সনাক্তের জন্যে নকশা করা হয়েছে। এছাড়াও ২০১৮ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে চালু করা ক্যামেরার সংখ্যা ১.৮ কোটি থেকে বেড়ে ৬.৫ কোটিতে উন্নীত হয়েছে যাতে কমপক্ষে আরো ১.৬ কোটি অতিরিক্ত যোগ করার পরিকল্পনা রয়েছে। আপাত প্রাক-সুনাম সত্ত্বেও সি৫-এ ভুল সনাক্তকরণ থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত ডেটার ভুল ব্যবস্থাপনার সমস্যা পর্যন্ত দেখা দিয়েছে। ভিডিও নজরদারিকে অনুমিতভাবে বস্তুনিষ্ঠ ধারণা করার কারণে প্রযুক্তিগত ত্রুটিগুলিও ফৌজদারি মামলার ফলাফলকে প্রভাবিত করতে দেখা গেছে।

বিস্তৃত সি৫ ব্যবস্থাটি নাগরিক স্বাধীনতার জন্যে মাত্রা ও হুমকি উভয় দিক থেকে একটি সম্প্রসারিত বুদ্ধিমত্তা ও নিরাপত্তা ডাটাবেস টাইটানের চেয়ে শুধু একটু ছোট। আর্থিক, সরকারি ও টেলিযোগাযোগ ডেটাসহ অন্যান্য ব্যক্তিগত তথ্যের সাথে একত্রিত করে সারাদেশে ব্যক্তিদের বাস্তব সময়ের ভৌগলিক অবস্থান সনাক্ত করতে বেশ কয়েকটি মেক্সিকীয় রাজ্য সরকার সফ্টওয়্যারটি ব্যবহার করছে। ডাটাবেস ব্যবহার করে বিতর্কিতভাবে বরেণ্য ব্যক্তিদের লক্ষ্যবস্তু করার জন্যে সরকারি কর্মকর্তারা সমালোচিত হলেও আরো সমস্যাজনক একটি লুকানো বাজারের মাধ্যমে টাইটান-সক্ষম গোয়েন্দা তথ্যে প্রবেশাধিকার লাভ এটিকে আরো দায়বদ্ধ করে তোলে।

সি৫ ও টাইটানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কতোটা যুক্ত করা হয়েছে তা এখনো স্পষ্ট না হলেও নজরদারির বৃহৎ অপচ্ছায়া নতুন চৌকস প্রযুক্তির সংযোজনের সাথে সাথে আরো উদ্বেগের কারণ হতে চলেছে।

সীমান্তে, সমস্যাগুলি আরো স্পষ্ট। টেক্সাসের গভর্নর গ্রেগ অ্যাবট ও চিহুয়াহুয়া গভর্নর মারু ক্যাম্পোসের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) চিহুয়াহুয়াতে অবস্থিত তোরে সেন্টিনেলা (প্রহরী ভবন) নামে একটি ২০-তলা নজরদারি ভবনের পরিকল্পনার রূপরেখা দিয়েছে। প্রায় ২০ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয়ে দালানটি “এলাকার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাসিন্দাদের মালিকানাধীন ক্যামেরা থেকে সরাসরি তথ্য” এবং সজ্জিত অন্তর্ভুক্ত করার জন্যে সেট করা হয়েছে। মুখ সনাক্ত সমর্থনের জন্যে বায়োমেট্রিক ফিল্টারসহ “১,৭৯১টি স্বয়ংক্রিয় লাইসেন্স প্লেট রিডার, ৩,০৬৫টি প্যান-টিল্ট-জুম ক্যামেরা এবং ৭৪টি ড্রোন” সংযুক্ত করতে যাচ্ছে। এছাড়াও রেকর্ড সংরক্ষণ ও বিষয় সনাক্তকরণের সুবিধার্থে চিহুয়াহুয়া রাজ্যের চালকদের লাইসেন্স নিবন্ধের সাথে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তিও যুক্ত থাকবে।

সীমান্তের মার্কিন দিক থেকে মেক্সিকীয় বাসিন্দারাও এআই প্রযুক্তির শক্তিশালী একটি আক্রমণাত্মক নজরদারি অবকাঠামোর অধীন। মার্কিন সরকার আন্দুরিলএলবিট ব্যবস্থার মতো কোম্পানিগুলিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে বেড়ার উভয় পাশের মানুষ ও বস্তু সনাক্ত করতে বিধিনিষেধ, ড্রোন ও এমনকি ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (ভিআর) ব্যবহারের জন্যে চুক্তিবদ্ধ করেছে। মেক্সিকোতে সীমান্ত নিরাপত্তা ছাড়াও কিছু নির্দিষ্ট বিচারে সহায়তা করতে প্রমাণ-ভিত্তিক নীতি-নির্ধারণ এবং স্বাস্থ্যসেবা শিল্পে সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও ডেটা-চালিত রোগ-নির্ধারণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করা হয়েছে।

লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশের তুলনায় মেক্সিকো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি অধিগ্রহণ ও স্থাপনে পিছিয়ে থাকলেও বিশ্বজুড়ে উদীয়মান প্রযুক্তির ব্যবহার আরো ব্যাপক হওয়ায় ভবিষ্যতে এর পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা, অর্থ ও নিরাপত্তার মতো শিল্পে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সম্ভাব্য বৈপ্লবিক প্রভাব ইতোমধ্যে স্বীকৃত এবং দেশের কিছু নেতৃস্থানীয় রাজনীতিবিদের, অন্তত আগামী রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অগ্রগামী দেশের অপরাধ দমন কৌশলের অংশ হিসেবে মুখ সনাক্তকরণ প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রস্তাবক মার্সেলোইব্রার্ডের কাছ থেকে সোচ্চার সমর্থন পেয়েছে।

উচ্চাকাঙ্ক্ষা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তির ব্যবহার ও প্রয়োগ পরিচালনার উপযুক্ত আই্নি হাতিয়ার ও মানদণ্ডের বিকাশকে ছাড়িয়ে গেলেও কিছু ব্যবস্থা রয়েছে। মেক্সিকো ২০১৮ সালে একটি শাসন কাঠামোর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা একটি এআই কৌশল তৈরি ও গোপনীয়তার অধিকারের প্রতি উদীয়মান প্রযুক্তিগুলির সৃষ্ট চ্যালেঞ্জগুলির রূপরেখা প্রণয়ন করেছে। ডেটা সুরক্ষা আইন (লেই ফেদেরাল দে প্রোতেক্সিওন দে দেতোস পের্সোনালেস), ভোক্তা সুরক্ষা আইন (লেই ফেদেরাল দে প্রোতেক্সিওনাল কন্সুমিদর) এবং অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা আইন (লেই ফেদেরাল দে কম্পেতেন্সিয়া ইকোনোমিকা) সহ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের নির্দিষ্ট দিকগুলিকে নিয়ন্ত্রণের বিধানসম্পন্ন বেশ কয়েকটি আইন রয়েছে। এছাড়াও, মেক্সিকীয় সিনেট “মেক্সিকোতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বাস্তুতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে” ২০২৩ সালে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জন্যে জাতীয় জোট (আলিয়েঞ্জা নাসিওনাল দে ইন্তেলিজেন্সিয়া আর্তিফিসিয়া, বা আনিয়া) তৈরি করেছে।

এই উন্নয়ন এবং ১৮টি সক্রিয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-সম্পর্কিত উদ্যোগের অস্তিত্ব সত্ত্বেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্দিষ্ট আইনের অভাবেমেক্সিকীয় জনগণ হুমকির মুখে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অগ্রগতি অব্যাহত থাকায় নতুন প্রযুক্তির সাথে উদ্ভূত অনন্য সমস্যা ও চ্যালেঞ্জের সাথে সঙ্গতি রেখে আইন প্রণয়ন করতে হবে। সারাবিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম পরিস্থিতি হলেও বিশেষত অতিমাত্রায় রাষ্ট্রীয় নজরদারি ব্যবস্থা ও গোপনীয়তা-লঙ্ঘন প্রযুক্তির অস্তিত্বসম্পন্ন মেক্সিকোর মতো দেশে রাষ্ট্র ও ব্যক্তিগত উভয় প্রতিষ্ঠানের সম্প্রসারণশীল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গ্রহণের বিরূপ প্রভাব জনগণকে আরো ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .