বুরুন্ডি ও রুয়ান্ডার মধ্যে উত্তেজনা বেড়েছে

বুরুন্ডি-রুয়ান্ডা সীমান্ত। টিভি৫মঁদ ইউটিউব চ্যানেল থেকে গৃহীত পর্দাছবি

সাত বছরের সীমান্ত বন্ধ থাকার পর ২০২২ সালের অক্টোবরে বুরুন্ডি ও রুয়ান্ডার মধ্যে স্থল সীমান্ত পুনরায় খোলার ঠিক এক বছরের কিছুটা বেশি সময় পরে দুই পূর্ব আফ্রিকীয় দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক আবারো খারাপ হচ্ছে।

বুরুন্ডির প্রয়াত রাষ্ট্রপতি পিয়েরে ঙ্কুরুনজিজা (২০০৫-২০২০) ২০১৫ সালের মে মাসে জেনারেল গুদফ্রয় নিয়োম্বেখের নেতৃত্বে একটি অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার লক্ষ্যবস্তু হন। জেনারেল অসাংবিধানিক বিবেচনায় ঙ্কুকুরুনজিজার তৃতীয় মেয়াদে দায়িত্ব পালনের সমালোচনা করেন। অভ্যুত্থানটি ব্যর্থ হলেও বুরুন্ডি রুয়ান্ডার বিরুদ্ধে নিয়োম্বেখের প্রচেষ্টা সমর্থনের অভিযোগ উত্থাপন করে। তবে কিগালি অভিযোগটি দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করে। ঘটনাটি দুই দেশের মধ্যে একটি সংকটের সূত্রপাত করলে তাদের ৩৬০-কিলোমিটার পারস্পরিক সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়।

সাত বছর পর বুরুন্ডি ২০০০ সাল থেকে রাষ্ট্রপতি পল কাগামের নেতৃত্বে থাকা রুয়ান্ডার সাথে তার সীমান্ত আবার খুলে দেয়। বুরুন্ডির রাষ্ট্রপতি হিসেবে ২০২০ সালে এভারিস্ত ন্দাইশিমিয়ের নির্বাচনের মাধ্যমে এই সমঝোতা সহজতর হয়, যা রাষ্ট্র দুটির মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনকে চিহ্নিত করে।

সম্পর্ক উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হলে রুয়ান্ডার প্রধানমন্ত্রী এদুয়াখ এনগিখঁ  ১ জুলাই, ২০২১ সালে বুজুম্বুরাতে ৫৯তম স্বাধীনতা বার্ষিকী উদযাপনে যোগ দেন, যা পুনর্মিলনের দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপকে চিহ্নিত করে। এছাড়াও ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ রাষ্ট্রপতি কাগামে বুরুন্ডিতে অনুষ্ঠিত পূর্ব আফ্রিকীয় সম্প্রদায়ের শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিলে সম্পর্ক আরো উষ্ণ হয়।

সীমান্ত আবারো বন্ধ

তবে দুই দেশের মধ্যেকার মধুচন্দ্রিমা মাত্র এক বছর স্থায়ী হয়। ১১ জানুয়ারি, ২০২৪ বুরুন্ডি আবারো রুয়ান্ডার সাথে অনির্দিষ্টকালের জন্যে তার সীমান্ত বন্ধ করে দেয়।

বুরুন্ডির কর্মকর্তারা রুয়ান্ডাকে ২২ ডিসেম্বর, ২০২৩ তারিখে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কঙ্গো (ডিআরসি) সীমান্তের কাছে একটি হামলায় বুরুন্ডিতে আইনের শাসনের জন্যে প্রতিরোধ হিসেবে পরিচিত বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরইডি-তাবারাকে সমর্থন করার দায়ে অভিযুক্ত করে। আক্রমণের ফলে নারী ও শিশুসহ ২০টি প্রাণহানির ঘটনায় আফ্রিকীয় ইউনিয়ন ব্যাপক নিন্দা জানিয়েছে।

জনগণের বিভিন্ন অংশ ঙ্কুরুনজিজার শাসনের বিরুদ্ধে বিরোধিতা প্রকাশ করলে ২০১৫ সালের নির্বাচনী সংকটের পরে অস্থিরতা থেকে এই সশস্ত্র গোষ্ঠীটির উদ্ভব ঘটে।

সাম্প্রতিক সীমান্ত বন্ধের কারণ সম্পর্কে ফরাসি সংবাদপত্র লেমঁদে একটি সাক্ষাৎকারে বুরুন্ডিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মাখতঁ নিতেরে মন্তব্য করেছেন:

Nous avons fermé nos frontières avec le Rwanda, celui qui va tenter d’y aller ne passera pas. La décision a été prise. Après avoir constaté que nous avions un mauvais voisin, Paul Kagame (…), nous avons arrêté toute relation avec lui jusqu’à ce qu’il revienne à de meilleurs sentiments. Le voisin rwandais héberge les criminels qui nuisent aux Burundais. Les ressortissants rwandais, nous n’en voulons pas.

রুয়ান্ডার সাথে আমাদের সীমান্ত বন্ধ করা হয়েছে, এবং ভূখণ্ডে প্রবেশের যেকোনো প্রচেষ্টা ব্যর্থ করা হবে। এই অবস্থান আমাদের দৃঢ় সিদ্ধান্ত প্রতিফলিত করে। আমাদের প্রতিবেশী পল কাগামের প্রতিকূল বৈশিষ্ট্য চেনার পরে বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত আমরা তার সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্নের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। রুয়ান্ডা বুরুন্ডীয় নাগরিকদের ক্ষতিকারক ব্যক্তিদের একটি অভয়ারণ্যে পরিণত হওয়ায় আমরা রুয়ান্ডার নাগরিকদের প্রবেশাধিকার প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমে নিজেদের দূরত্ব বজায় রাখতে চাই।

প্রতিক্রিয়ায় কিগালিও বুরুন্ডিকে তার ভূখণ্ডে পরিচালিত রুয়ান্ডার বিদ্রোহীদের সমর্থনের অভিযোগ করেছে।

কিছু পর্যবেক্ষকের মতে দেশগুলির মধ্যে টানা-পোড়েনটি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কঙ্গোতে তাদের একটি বাহ্যিক বিরোধে জড়িত থাকার কারণে উদ্ভূত, যেখানে এম২৩ বিদ্রোহীরা দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর (এফএআরডিসি) সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়৷ উল্লেখ্য, ৫ মার্চ, ২০২৩ বুরুন্ডি জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুসারে রুয়ান্ডা সমর্থিত এম২৩ বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াই করার লক্ষ্যে কঙ্গোতে মাঠে নেমেছিল

অঞ্চলটিতে এর প্রভাব

রুয়ান্ডার সাথে বুরুন্ডির সীমান্ত বন্ধকে একটি কূটনৈতিক সঙ্কেত হিসেবে দেখা হলেও এর একটি বিস্তৃত পরিণতি রিয়েছে। বুরুন্ডিতে বসবাসকারী রুয়ান্ডার নাগরিকদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। বুরুন্ডীয় কর্মকর্তারা অবশ্য বহিষ্কৃতদের মোট সংখ্যা প্রকাশে অস্বীকৃতি জানিয়েছে

প্রতিক্রিয়ায় কিগালি প্রশাসন বুরুন্ডি ভ্রমণে তার নাগরিকদের সতর্ক করে রুয়ান্ডায় বুরুন্ডীয় বাসিন্দাদের নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছে। এসওএস মিডিয়া বুরুন্ডির একটি প্রতিবেদনে রুয়ান্ডা সরকারের উপ-মুখপাত্র অ্যালাইন মুকুলারিন্দাকে উদ্ধৃত করা হয়েছে:

En ce qui concerne les Burundais qui sont ici au Rwanda… Continuez à vaquer à vos activités quotidiennes, ne soyez nullement inquiétés, rien ne vous arrivera suite à la décision des autorités burundaises de fermer les frontières avec le Rwanda.

রুয়ান্ডায় বসবাসরত বুরুন্ডীয় নাগরিকবৃন্দ… আপনাদের দৈনন্দিন রুটিন চালিয়ে যান এবং চিন্তা করবেন না। বুরুন্ডির রুয়ান্ডার সাথে তার সীমান্ত বন্ধ করার সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও আপনাদের নিরাপত্তার সাথে আপস করা হয়নি।

এই সিদ্ধান্ত ও সরকারি ঘোষণার বাইরে উভয় দেশের ব্যবসায়ীদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যথেষ্ট বাধার সম্মুখীন হয়। বুরুন্ডির ম্যাগাজিন জিম্বেরের সাথে কথা বলার সময় একজন ব্যবসায়ী পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেছেন:

On venait de passer plus d’une année à se réjouir d’une reprise des échanges commerciaux entre nos deux pays, mais voilà tout d’un coup, le mauvais épisode recommence. (…) malheureusement, je ne parviens pas maintenant à vendre ne fut ce que la moitié de mes marchandises.

রুয়ান্ডার সাথে বাণিজ্য আবার শুরু হওয়ায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে আমরা খুব খুশি থাকলেও হঠাৎ করেই অসুবিধাগুলি সামনে এসেছে। (…) দুর্ভাগ্যবশত এখন আমার মালামালের অর্ধেকও বিক্রি করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

গণমাধ্যম সংস্থা ইয়াগা বুরুন্ডি এক্সের (পূর্বে টুইটারের) মাধ্যমে নিজস্ব বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছে:

অর্থনৈতিক দিক থেকে এই বন্ধ আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য ও পরিবহন খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

#রুহওয়া সীমান্ত ব্যবহার করে @সিবিটোকপ্রদেশের #রুগোম্বো বাজারে ফলমূল ও সবজি সরবরাহের অনুরোধকারী রুয়ান্ডার ব্যবসায়ীদের হাত এখন …

এই সীমান্ত বন্ধ উভয় দেশের অর্থনৈতিক খাতে নেতিবাচকভাবে প্রভাব ফেললেও বুরুন্ডির – বিশেষ করে এর অনানুষ্ঠানিক কর্মী ও আন্তঃসীমান্ত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হবে বেশি।

বুরুন্ডির খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ জাতিসংঘের মহাসচিবের প্রাক্তন প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ও বেসরকারি সংস্থা শান্তি ও সমৃদ্ধির অংশীদারের প্রতিষ্ঠাতা আদ্রেঁ নিকুইজিজ সীমান্ত বন্ধকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সিদ্ধান্ত বিবেচনা করে এর সম্ভাব্য ধ্বংসাত্মক অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়াসহ এক্সে লিখেছেন:

#বুরুন্ডির রুয়ান্ডার সাথে সীমান্ত বন্ধ করার যথেষ্ট অর্থনৈতিক পরিণতি রয়েছে। ২০১৮ ও ২০২০ সালের মধ্যে বুরুন্ডি রুয়ান্ডার সাথে তার বিনিময়ে ৫১ লক্ষ ডলার (প্রায় ৫৬ কোটি টাকা) হারিয়েছে। বুরুন্ডীয় কর্তৃপক্ষ এই নতুন অবরোধের অর্থনৈতিক প্রভাব মূল্যায়ন করেছে কি?

তিনি দুই দেশের মধ্যে দ্বন্দ্বের কেন্দ্রস্থলে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের বিকল্প কম সুনির্দিষ্ট উপায় আছে কিনা জানতে চেয়েছেন

এছাড়াও অনেক বুরুন্ডীয় স্বাস্থ্যসেবা চিকিৎসার জন্যে নিয়মিত রুয়ান্ডার সীমান্ত অতিক্রম করে থাকে।

আপাতবিরোধীভাবে বুরুন্ডি ও রুয়ান্ডার ক্রমবর্ধমান সঙ্কটে গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র নিজেকে জথেষ্ট জড়িয়ে ফেলছে। কঙ্গো ও রুয়ান্ডার মধ্যে সরাসরি স্থলভ্রমণের সাথে যুক্ত চ্যালেঞ্জের প্রেক্ষিতে এখন কঙ্গোর ব্যবসায়ী ও ভ্রমণকারীরা তাদের অভিপ্রেত গন্তব্যে পৌঁছানোর আগে রুয়ান্ডা দিয়ে ঘুরে যেতে বাধ্য হচ্ছে। তবে বর্তমান পরিস্থিতি এই ধরনের চলাফেরার অনুপযোগী, যেমন ভয়েস অব আমেরিকার এই ভিডিওটি দেখায়:

পুনরাবৃত্ত কূটনৈতিক ও নিরাপত্তা সংকট এই অঞ্চলের ২.৭ কোটি বাসিন্দার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের উপর একটি মূল্য চাপিয়ে দিয়েছে, বিশেষ করে ক্ষতি হচ্ছে যাদের জীবিকা প্রধানত আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্যের উপর নির্ভরশীল।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .