দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে ২০২৪ সাল গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের একটি বছর হলেও নির্বাচন অনুষ্ঠিত দেশগুলিতে রাজনৈতিক বাস্তবতা পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই। পাকিস্তানের ৮ ফেব্রুয়ারির সাধারণ নির্বাচনও ভিন্ন কিছু নয়। বেশ কয়েকটি নিরাপত্তা উদ্বেগ এবং একাধিক অভিযোগে কারাবন্দী রেখে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) পার্টির সভাপতি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ধ্বংস প্রচেষ্টার কারণে এই নির্বাচনটি ক্ষতিগ্রস্ত। রাজনৈতিক ভাষ্যকার নাদিম এফ. পারাচা একে “প্রাক-নির্বাচন কারচুপি” বা একটি নির্দিষ্ট দলের পক্ষপাতিত্বের কারসাজি বলে অভিহিত করেছেন।
সংসদ ভেঙে দেওয়ার পর ৯ আগস্ট, ২০২৩ থেকে বর্তমানে দেশটি একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্বে রয়েছে। ভেঙ্গে যাওয়ার আগে শেহবাজ শরীফ সরকার তাড়াহুড়ো করে জনগণের কণ্ঠস্বর ও সমালোচনা দমনকারী ও নাগরিক স্বাধীনতা খর্বকারী বেশ কয়েকটি আইন পাস করেছে।
নির্বাচনের সংখ্যা
দেশটিতে ২৩.৪ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ১২.৮ কোটিরও বেশি নিবন্ধিত ভোটার এবং ১৮,০০০ এর বেশি প্রার্থী রয়েছে। পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশনের (ইসিপি) তথ্য অনুসারে, মোট ৯০,৬৭৫টি ভোট কেন্দ্রের মধ্যে ২৫,৩২০টি পুরুষ, ২৩,৯৫২টি নারী এবং ৪১,৪০৩টি উভয় ভোটারের জন্যে মনোনীত করা হয়েছে।
দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পাকিস্তানের জাতীয় সংসদের নিম্নকক্ষে মোট ৩৩৬টি আসন রয়েছে যার মধ্যে ২৬৬টি সাধারণ ভোটে সরাসরি নির্বাচিত হয়। নির্বাচনী ব্যবস্থায় বাকি ৭০টি বিশেষ আসন – ৬০টি নারীদের এবং ১০টি সংখ্যালঘুদের জন্যে মনোনীত। একটি দল ১৩৪টি আসন পেলে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। এছাড়াও ভোটের জন্যে প্রাদেশিক পরিষদের ৭৪৯টি আসন রয়েছে।
সাংবাদিক ওয়াজাহাত কাজমি এক্সে (পূর্বে টুইটার) জানিয়েছেন:
Pakistan Army has been deployed across the country for assistance in holding elections according to Article 245 of the constitution. Police will have the top responsibility followed by Civil Armed Forces, Rangers and Frontier Corps. The Army will be at the third tier. pic.twitter.com/YUzHTMYRG4
— Wajahat Kazmi (@KazmiWajahat) February 3, 2024
সংবিধানের ২৪৫ ধারা অনুসারে নির্বাচন আয়োজনে সহায়তার জন্যে সারাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে মোতায়েন করা হয়েছে। নাগরিক সেনাবাহিনী, রেঞ্জার ও সীমান্ত কোরের পরে পুলিশের উপরে দায়িত্ব থাকবে। সেনাবাহিনী থাকবে তৃতীয় স্তরে।
নির্বাচনী আইন অনুসারে পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচনের ১৪ দিনের মধ্যে আনুষ্ঠানিক ফলাফল প্রকাশ করতে হয়।
প্রতিযোগীরা
পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলো নানা ধরনের মতাদর্শ ধারণ করে। পাকিস্তানের ২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে ইমরান খানের মধ্যপন্থী পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) দল জাতীয় পরিষদের বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। দলটি পরবর্তীতে কয়েকটি ছোট দল নিয়ে জোট সরকার গঠন করে। পিটিআইয়ের মতাদর্শ জনপ্রিয়তাবাদ, কল্যাণবাদ, সমতাবাদ ও ইসলামী গণতন্ত্র কেন্দ্রিক।
ইমরান খান ২০২২ সালের এপ্রিলে অনাস্থা ভোটে হেরে মেয়াদ পূর্ণ করতে না পারায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়। পরে সেই বছরই সরকারের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ মিছিলের সময় ইমরান একটি হত্যা প্রচেষ্টার লক্ষ্যবস্তু হন।
নির্বাচনের ঠিক আগে ১০ বছরের কারাদণ্ডের কারণে কেন্দ্রবাদী দল পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) এর প্রধান তিনবারের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ ২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেননি। এপ্রিল ২০২২-এ ইমরান খানের অভিশংসনের পরে পিএমএল-এন সরকারের নিয়ন্ত্রণ নিলে নওয়াজের ছোট ভাই শেহবাজ শরীফ প্রধানমন্ত্রী হন। আসন্ন নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে তিনি ১৬ মাসের মেয়াদে পিটিআইয়ের নেতৃত্বে অতি-মূল্যস্ফীতি ও ব্যাপক বিক্ষোভের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন।
অন্য প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) নেতৃত্বে রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো ও সাবেক রাষ্ট্রপতি আসিফ আলী জারদারির পুত্র তরুণ সভাপতি বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি। দলটির আদর্শ ইসলামী গণতন্ত্র, সামাজিক গণতন্ত্র ও প্রগতিবাদ কেন্দ্রিক।
অন্যান্য ছোট দলগুলির মধ্যে রয়েছে মধ্য-বাম, আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টি (এএনপি); সামাজিক উদারপন্থী, মুহাজির জাতীয়তাবাদী, এবং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী রাজনৈতিক দল মুত্তাহিদা কওমি আন্দোলন পাকিস্তান (এমকিউএম-পি); ডানপন্থী ধর্মীয় জামাত-ই-ইসলামী (জেআই) দল এবং ডানপন্থী ইসলামী মৌলবাদী জমিয়ত-ই-উলামা ইসলাম (জেইউআই-এফ) দল।
এদিকে বেলুচিস্তান প্রদেশের একটি জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক সংগঠন বেলুচ জাতীয় আন্দোলন বেলুচ জনগণকে নির্বাচন বয়কট করতে বলেছে:
The Baloch National Movement has urged the Baloch people to boycott the upcoming elections in Pakistan.
“Your vote would betray the thousands of Baloch mothers who have lost young sons to the cruel and oppressive state,” the party said in a pamphlet on Friday.
The @BNMovement_… pic.twitter.com/3wA6gEhV1c
— Balochistan Times (@BaluchistanTime) February 2, 2024
পাকিস্তানের আসন্ন নির্বাচন বয়কটের জন্যে বেলুচ জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বেলুচ জাতীয় আন্দোলন।
“আপনার ভোট নিষ্ঠুর ও নিপীড়ক রাষ্ট্রের কাছে যুবক পুত্রদের হারানো হাজার হাজার বেলুচ মায়েদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে,” শুক্রবার একটি প্রচারপত্রে দলটি বলেছে।
পিটিআই বিরোধী নিপীড়ন ও বিচারিক হয়রানি
ইউটিউবে স্বাধীন বিভিন্ন জরিপ পাকিস্তানে ইমরান খানের প্রতি জোরালো সমর্থন এবং পিটিআইয়ের সম্ভাব্য বড় জয়ের ইঙ্গিত দিয়েছে। সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতাসহ তার ফিরে আসার ভয়ে পিটিআই গণতান্ত্রিকভাবে দলীয় নির্বাচন পরিচালনা করেনি এমন অভিযোগে আদালত তার নির্বাচনী প্রতীক – ক্রিকেট ব্যাট – নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে সকল পিটিআই প্রার্থীকে এখন বেগুন, মুত্রাধার ও বিছানার মতো হাস্যকর নির্বাচনী প্রতীক ব্যবহার করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়তে হবে।
ন্যায়বিচারকে উপহাস করে ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ইসলামী বিবাহ আইন লঙ্ঘনের জন্যে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ও তার স্ত্রীকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তাকে ক্ষমতার দৌড় থেকে সরানোর এই নজিরবিহীন পদক্ষেপ পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিক হাসির পাত্রে পরিণত করেছে।
শিক্ষাবিদ ও মানবাধিকার পর্যবেক্ষকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক কেনেথ রথ বলেছেন:
Illustrating the Pakistani military's determination to sideline Imran Khan on whatever absurd ground that it can, he and his wife are given seven-year prison sentences on the pretext that they didn't get married the right way. https://t.co/V4eeALLejw
— Kenneth Roth (@KenRoth) February 4, 2024
সঠিকভাবে বিয়ে না করার জন্যে ইমরান খান ও তার স্ত্রীকে সাত বছরের কারাদণ্ড প্রদানের অজুহাত, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর যেকোনো অযৌক্তিক ভিত্তিতে ইমরান খানকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার দৃঢ় সংকল্পের চিত্র তুলে ধরে।
সন্ত্রাসবাদ, দেউলিয়াত্বের সম্ভাবনা ও অর্থনৈতিক মন্দায় হাবুডুবু খাওয়া দেশটির জনপ্রিয় নেতাদের এমনভাবে লক্ষ্যবস্তু করার ইচ্ছে বিশেষ করে এধরনের চালাকির ইতিহাস থাকার কারণে বেশি লোককে অবাক করে না।
শেহবাজ শরীফ সরকার ২০২৩ সালের গোড়ার দিকে ক্ষমতায় ফিরে আসার উপায় হিসেবে আগাম নির্বাচনের পক্ষে কথা বলা ইমরান খান ও পিটিআই দলের নেতাদের বিরুদ্ধে একটি দমনাভিযান শুরু করে। দুর্নীতির অভিযোগে ইমরানকে গ্রেপ্তারের কারণে ২০২৩ সালের মে মাসে দেশটি ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে পড়ে যথেষ্ট অস্থিতিশীলতার দিকে ধাবিত হয়।
ইসলামাবাদ উচ্চ আদালত ৫ আগস্ট, ২০২৩ ইমরান খানকে দুর্নীতির অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করার পর তাকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়। এই উচ্চ আদালত বিচার স্থগিত করে ২০২৩ সালের আগস্টে মুক্তির আদেশ দিলেও অন্যান্য বিভিন্ন অভিযোগে ইমরান আটক রয়েছেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ইন্টারনেট বন্ধ
টিভিতে পিটিআইয়ের নির্বাচনী প্রচার চালানো এবং পাকিস্তানে ইমরান খানের নাম উল্লেখ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই বিধিনিষেধ সত্ত্বেও শক্তিশালী উপস্থিতিসহ পিটিআই সামজিক গণমাধ্যম সমাবেশের আয়োজন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি ব্যবহারের মতো প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। পিটিআইয়ের প্রতি সহানুভূতিশীল অনেক মধ্যবিত্ত ব্যক্তি গান তৈরি এবং টিকটক, ফেসবুক ও টুইটারের মতো মঞ্চে নির্বাচনী প্রচারণা সমর্থনের জন্যে তহবিল দান করছে।
পিটিআইয়ের “ভার্চুয়াল” নির্বাচনী সমাবেশের সময় ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে বেশ কয়েকবার, ইন্টারনেট বন্ধের কারণে লক্ষ লক্ষ পাকিস্তানি ইউটিউব, ফেসবুক, এক্স, ইনস্টাগ্রাম ও অন্যান্য সামজিক গণমাধ্যমের অ্যাপগুলিতে ঢুকতে পারেনি, যাকে সরকার প্রযুক্তিগত ত্রুটি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। পাকিস্তানের মানবাধিকার পর্ষদ এই পদক্ষেপের নিন্দা করেছে:
Such a ban on social media is tantamount to restricting freedom of expression. We strongly condemn this move
Human rights council pakistan #hrc_Pakistan #Election2024 #HumanRights #FreedomOfSpeech #socialmedia @UNinPak @InternationalOb @_FAFEN @ECP_Pakistan https://t.co/pmCXNFKsxl— Human Rights Council of Pakistan (@HRCPakistan) January 20, 2024
সামজিক গণমাধ্যমে এধরনের নিষেধাজ্ঞা বাকস্বাধীনতা সীমিত করার সামিল। আমরা এই পদক্ষেপের তীব্র নিন্দা জানাই
পাকিস্তানে আতঙ্ক ও বিশৃঙ্খলা ছড়ানো ও তথ্যের প্রবাহ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে ২০২৪ সালের ৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারি সম্ভাব্য ইন্টারনেট বন্ধের খবর পাওয়া গেছে। সরকার আবারো অস্বীকার করলেও সাম্প্রতিক ইন্টারনেট অবরোধটি ইতোমধ্যে দেশের বিশাল অর্থনৈতিক ক্ষতি করেছে।
ব্যক্তিদের নিজ নির্বাচনী এলাকা নির্ধারণ করতে পারার জন্যে পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশনএকটি পাঠ্য বার্তা পরিষেবা শুরু করেছে। দ্রুত নাগরিকদের নির্বাচন সংক্রান্ত অভিযোগ নথিভুক্ত করতে তারা একটি সক্রিয় হোয়াটসঅ্যাপ হেল্পলাইনও প্রতিষ্ঠা করেছে।
সাম্প্রতিক একটি সাক্ষাৎকারে ইমরান পাকিস্তানে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে ভোটারদের সমর্থন চেয়েছেন।
If Pakistan’s elections are held under the current circumstances, “they would be a disaster,” the former prime minister warns. “The only viable way forward for Pakistan is fair and free elections,” he argues in a guest essay https://t.co/rflLNeAodb
— The Economist (@TheEconomist) January 30, 2024
বর্তমান পরিস্থিতিতে পাকিস্তানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে “সেগুলি বিপর্যয়কর হবে,” সাবেক প্রধানমন্ত্রী সতর্ক করেছেন। “পাকিস্তানের এগিয়ে যাওয়ার একমাত্র কার্যকর উপায় হলো সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন,” একটি অতিথি প্রবন্ধে তিনি যুক্তি দিয়েছেন৷