বিশ্ববিখ্যাত কাশ্মীরি মানবাধিকার সুরক্ষক খুররম পারভেজ ২১ নভেম্বর ভারতের সর্বাধিক-নিরাপত্তা সম্পন্ন জেলা কারাগার রোহিনীতে দুই বছর পূর্ণ করেছেন। পারভেজ ভারত-শাসিত কাশ্মীরে গণতান্ত্রিক ভিন্নমত ও মানবাধিকারের বিরুদ্ধে বড় আকারের দমনাভিযানের প্রতীক। কাশ্মীরে ভারতীয় দমনাভিযানের ধরনটি ২০১৪ সাল থেকে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) হিন্দু ডানপন্থী সংগঠনের রাজনৈতিক অঙ্গ ডানপন্থী ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) শাসনামলে দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে।
ভারত সরকার ২০১৯ সালে একতরফা ও সামরিকভাবে কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন প্রত্যাহার করে। ভারত সরকারের অবশিষ্ট মুক্ত স্থান ও মতপ্রকাশ বন্ধ ও হ্রাসের নীতি অসাধারণ গতিতে এগিয়েছে। এটি তার বসতি স্থাপনকারী-ঔপনিবেশিক নীতিমালাকে গতিশীল করতে বিভিন্ন আইন পাস করেছে।
আমাদের বিশেষ কভারেজ পড়ুন: কাশ্মীরের সংকটের অভ্যন্তরে
কাশ্মীর ভারতীয় সামরিক দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দমনের জন্যে ১৯৯১ সাল থেকে আরোপিত সশস্ত্র বাহিনী বিশেষ আইনের (এএফএসপিএ) অধীনে রয়েছে। সরকারি সংখ্যা ভিন্ন হলেও অতীতের প্রতিবেদনের হিসেব অনুসারে প্রায় ৭,০০,০০০ ভারতীয় সৈন্য এই অঞ্চলটি দখল করে রয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে ঘন সামরিক অঞ্চলের একটি এই কাশ্মীরকে প্রায়শই একটি উন্মুক্ত কারাগার বলা হয়। এএফএসপিএ’র কারণে ভারতীয় বাহিনীর কোনো সদস্যের বিচার করতে সরকারের পূর্বে “অনুমতি” প্রয়োজন। সকল ফৌজদারি অপরাধের বিচার থেকে ভারতীয় বাহিনীকে রক্ষার দায়মুক্তি ব্যবস্থা হিসেবে “অনুমতিগুলি” ব্যবহৃত হয়ে আসছে৷ গত তিন দশকে কাশ্মীরে নিয়োজিত ভারতীয় বাহিনীর একজন সদস্যকেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্যে বিচার করা হয়নি৷ এইভাবে দায়মুক্তিসহ নিয়োজিত ভারতীয় বাহিনী কাশ্মীরি নাগরিক ও মানবাধিকারের প্রতি সম্পূর্ণ অবজ্ঞা প্রদর্শন করেছে।
বিভিন্ন মানবাধিকার গোষ্ঠীর মতে স্থূল মানবাধিকার লঙ্ঘনের ফলে ৭০,০০০ এর বেশি যোদ্ধা ও বেসামরিক কাশ্মীরি নাগরিকদের হত্যা এবং আনুমানিক ৮,০০০ -১০,০০০ জনকে বলপূর্বক গুম করা হয়েছে; যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ধর্ষণ, রাজনৈতিক কারাবাস ও বিশ্বের প্রথম গণ-অন্ধকরণের মতো আঘাত করা হয়েছে।
আমাদের বিশেষ কভারেজ পড়ুন: কাশ্মীরি জনগণ বনাম ভারত রাষ্ট্র
খুররম পারভেজ গত দুই দশক ধরে জম্মু ও কাশ্মীর সুশীল সমাজ জোটের (জেকেসিসিএস) নেতৃত্ব দিয়েছেন। জেকেসিসিএস এই অঞ্চলে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন নথিভুক্ত করেছে এবং অসংখ্য তরুণ সক্রিয় কর্মী ও অধিকার রক্ষাকারীদের পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের স্বাধীন অধিকার-ভিত্তিক সংলাপ ও নথিভুক্তির সংস্কৃতি তৈরি করতে ২০০০ সালে সংগঠিত ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগুলির একটি তহবিলবিহীন স্বেচ্ছাসেবী নেটওয়ার্ক। পারভেজ ভারতীয় বাহিনীর জোরপূর্বক নিখোঁজ কাশ্মীরিদের জন্যে বিচারপ্রার্থী দুটি নিখোঁজ ব্যক্তিদের পিতামাতাদের সমিতির (এপিডিপি) একটি গ্রুপের প্রধান সমন্বয়কারী। উভয় এপিএডি ২০১৭ সালে মানবাধিকারের জন্যে রাফটো পুরস্কারে ভূষিত। নির্বাচন পর্যবেক্ষণের সময় পারভেজ ২০০৪ সালে একটি ভূমি-মাইন বিস্ফোরণে তার বাম পা ও দুই সহকর্মীকে হারান।
এমনকি কারাগারে থাকাকালেও ২০১৪ সাল থেকে নেতৃত্ব প্রদানকারী পারভেজ জোরপূর্বক নিখোঁজদের এশীয় ফেডারেশনের (এএফএডি) সভাপতি হিসেবে পুনঃনির্বাচিত হন। এপ্রিলে খুররম সর্বসম্মতিক্রমে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ফেডারেশনের (এফআইডিএইচ) উপ-মহাসচিব নির্বাচিত হন। তার মন্তব্যে পারভেজ ও মানবাধিকার কর্মের প্রতি তার অক্লান্ত আবেগের প্রতি সমর্থন ও প্রশংসা ব্যক্ত করেছেন এফআইডিএইচের সভাপতি অ্যালিস মোগওয়ে। অতীতের আন্তর্জাতিক পুরস্কারের পাশাপাশি এই বছর পারভেজ কাশ্মীরে মানবাধিকার কর্মের জন্যে মার্টিন এনালস মানবাধিকার সুরক্ষক পুরস্কার পেয়েছেন। জাতিসংঘের বিশেষ দূত, বিশ্ব শান্তি কর্মী ও লেখকবৃন্দসহ বিশিষ্ট মানবাধিকার পর্যবেক্ষক ও সমর্থকরা মানবাধিকার রক্ষায় খুররামের অবিচ্ছিন্ন সেবাকে তুলে ধরা অব্যহত রেখেছে। তারা তার সক্রিয়তার প্রতি প্রতিহিংসামূলক চলমান নির্বিচার আটকের তীব্র নিন্দা করেছে।
গত ৭৫ বছর ধরে ভারত রাষ্ট্রটি কাশ্মীরের সকল গণতান্ত্রিক ভিন্নমতকে ক্রমাগত অপরাধীকরণ করে যা এখন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে। রাষ্ট্রের আখ্যানকে চ্যালেঞ্জ করা ব্যক্তির বিরুদ্ধে কেবল সমালোচনামূলক কণ্ঠস্বরকে নীরব করার উদ্দেশ্যেই দ্রুত রাষ্ট্রদ্রোহ, সন্ত্রাসবাদ ও অন্যান্য নিপীড়নমূলক “আইনি” অভিযোগে মামলা করা হয়। ভারতের সবচেয়ে অপব্যবহৃত সন্ত্রাসবিরোধী আইন হিসেবে পরিচিত বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইনে (ইউএপিএ) পারভেজকেও অভিযুক্ত করা হয়েছে। ইউএপিএ কোনো ব্যক্তিকে নির্বিচারে “সন্ত্রাসী” আখ্যা দিয়ে নির্দোষ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত দোষী বোঝানোর জন্যে কুখ্যাত ও প্রায় জামিন অযোগ্য একটি নিবর্তনমূলক আইন। আন্তর্জাতিক অধিকার গোষ্ঠীগুলি একমত যে ভারত কাশ্মীর ও ভারত জুড়ে মানবাধিকার সুরক্ষকদের লক্ষ্যবস্তু করতে ইউপিএ’র মতো আইনী প্রক্রিয়ার অপব্যবহার করছে।
প্রতিবেদন অনুসারে কাশ্মীরে এমনকি সাংবাদিক ও লেখকরাও নিপীড়নের সম্মুখীন। একটি নতুন গণমাধ্যম নীতি আরোপ করা হয় ২০২০ সালে। কাশ্মীরে কঠোর সেন্সরের একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা থাকলেও এখন এটি সম্পূর্ণভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। সাংবাদিক, মানবাধিকার সুরক্ষক, লেখক ও মতামতের নেতারা সরেজমিন বাস্তবতা স্বাধীনভাবে প্রকাশ করতে অক্ষম। এমনকি সামাজিক গণমাধ্যম ব্যবহারকারীরাও নজরদারির আওতায় রয়েছে। উল্লেখ্য, সাংবাদিক আসিফ সুলতান ও সাজাদ গুলের বিরুদ্ধে নির্বিচার অভিযোগে মামলা করা হয়েছে। সাংবাদিকতা সুরক্ষা কমিশন বলেছে কাশ্মীরের গণমাধ্যম একটি ক্রান্তিলগ্নে রয়েছে। কাশ্মীরি সাংবাদিকদের পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করা, লেখা ও সংরক্ষণাগার হারিয়ে ফেলা, নিষেধাজ্ঞা ও তাদের ওয়েবসাইট অবরুদ্ধের সম্মুখীন হচ্ছে। অক্টোবরে ভারত সরকার কাশ্মীরি প্রাক্তন অধ্যাপক শেখ শওকত হুসেন এবং ১৯৯৭ সালের বুকার পুরস্কার বিজয়ী অরুন্ধতী রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের একটি ১০ বছর পুরানো মামলা পুনরায় চালু করেছে। রায় কাশ্মীরে ভারতীয় নীতির বিরুদ্ধে কথা বলার জন্যে ভারতের অন্যতম শক্তিশালী কণ্ঠ।
জেকেসিসিএসের ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের গবেষণা ও নথিভুক্তি অনবদ্যভাবে গবেষণা, অধ্যবসায়ের সাথে সংগৃহিত
এবং স্বাধীনভাবে যাচাই করা হয় অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো সুপরিচিত বিশ্ব মানবাধিকার পর্যবেক্ষণকারী সংস্থার মাধ্যমে, যা জেকেসিসিএস’র কাজকে বৈধতা দেয়। এমনকি ২০২০ সালে অভিযান চালানো এবং আর্থিক সম্পদ হিমায়িত করার পরে ভারতে অ্যামনেস্টির অফিসটি বন্ধ করতে হয়৷ অ্যামনেস্টি এটিকে “ডাইনী শিকার” এবং বিশেষভাবে কাশ্মীরে মানবাধিকার সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে একটি বড়সড় দমনাভিযানের অংশ অভিহিত করেছে৷ কাশ্মীরে মানবাধিকারের কাজ যেকোনো ধরনের প্রতিবাদ কার্যকরভাবে নিষিদ্ধ।
ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী ট্রাইব্যুনাল ৯ নভেম্বর ভারতীয় সেনা ক্যাপ্টেনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড স্থগিত করেছে। “সন্ত্রাসী” চিহ্নিত করে একটি সাজানো এনকাউন্টারে ২০২০ সালে তিন কাশ্মীরি যুবক হত্যার জন্যে উক্ত কর্মকর্তা দোষী প্রমাণিত হয়। কাশ্মীরিদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অপব্যবহার করে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাজানো এনকাউন্টারগুলিকে বিচার-বহির্ভূত পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
মানবাধিকার ও সুশীল সমাজের সক্রিয়তা কঠোরভাবে দমন-পীড়নের মধ্যে থাকায় পরিবারগুলো ক্ষুদ্ধ হলেও কোনো প্রকাশ্য প্রতিবাদ করা সম্ভব হয়নি। এখানেই মানবাধিকার সুরক্ষক ও সাংবাদিকরা কাশ্মীরে একটি গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক ভূমিকা পালন করছে। এখন ভারতীয় বর্ণনাকে চ্যালেঞ্জ করা মানবাধিকার রক্ষা বা অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার যেকোনো রূপকে হুমকি হিসেবে দেখা এবং “ভারত-বিরোধী” বলে চিহ্নিত করা হয়। কাশ্মীরে নীরবকরণের মাত্রা এতোটাই যে ভারত গাজায় চলমান গণহত্যার প্রেক্ষিতে, এমনকি ফিলিস্তিনপন্থী প্রতিবাদও নিষিদ্ধ করেছে। পুলিশ মসজিদগুলোকে গণহত্যার কথা উল্লেখ না করার নির্দেশ দিয়েছে এবং জনগণ ফিলিস্তিনের জন্যে প্রার্থনা করতে চাইলেও তারা কেবল আরবি ভাষায় প্রার্থনা করতে পারে, কাশ্মীরি ভাষাতে নয়।
পারভেজের কারাবাসের দ্বিতীয় বার্ষিকী উপলক্ষে বৈশ্বিক মানবাধিকার সংস্থাগুলি তার এবং তার সাবেক জেকেসিসিএস সহকর্মী ও সাংবাদিক ইরফান মেহরাজের অবিলম্বে ও নিঃশর্ত মুক্তির আবারো আহ্বান জানিয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ফেডারেশনের (এফআইডিএইচ) সভাপতি অ্যালিস মোগওয়ে বলেছেন:
খুররম পারভেজের মামলায় জাতিসংঘের রায়টি প্রামাণিকভাবে নিশ্চিত করে যে তার মানবাধিকার কর্মের জন্যে তাকে আটক করা প্রতিশোধমূলক কাজ এবং তাকে ও সামগ্রিকভাবে কাশ্মীরি নাগরিক সমাজকে নীরব করার একটি প্রচেষ্টা। ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে জাতিসংঘের সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে এবং অবিলম্বে খুররমকে মুক্তি দিতে হবে।”
ভারত সরকারকে খুররম পারভেজ, সাংবাদিক ইরফান মেরাজ ও আসিফ সুলতানকে মুক্ত করতে বলতে আমাদের সবচেয়ে বেশি দরকার শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ও বৈশ্বিক সংহতি। সকল কাশ্মীরি রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্ত করো!
জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখ উচ্চ আদালত ১১ ডিসেম্বর, ২০২৩ জননিরাপত্তা আইনে (পিএসএ) সাংবাদিক আসিফ সুলতানের আটকাদেশ বাতিল করেছে। কবে তাকে মুক্তি দেওয়া হবে তা এখনো স্পষ্ট নয়। সুলতানকে ২০২২ সালের এপ্রিলে জামিন দেওয়া হলেও নতুন অভিযোগে মামলা করে তাকে আটক রাখা হয়েছে।