
ছবি: আরজু গেবুলায়েভা
ইস্তাম্বুলের একটি আদালত ১৩ সেপ্টেম্বর নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা নথিভুক্তকারী একটি জনপ্রিয় স্থানীয় অনলাইন মঞ্চ – আমরা নারীহত্যা বন্ধ করবো বন্ধের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে৷ “বেআইনি ও অনৈতিক কার্যক্রম করেছে” বলে অনলাইন মঞ্চটির বিরুদ্ধে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে প্রথম মামলা করা হয়। এটি অনলাইন অনুসরণকারী আনিতসায়াক অনুসারে শুধু ২০২৩ সালে সহিংসতায় ৩৬২ জন নিহত নারীর একটি দেশের নারী অধিকার কর্মীদের জন্যে একটি বিরল বিজয়।
মৃত্যুর এই উচ্চ সংখ্যা ২০২১ সালের মার্চ মাসে চুক্তিটিকে “সমকামিতার স্বাভাবিকীকরণ” অভিহিত করে দেশটিকে প্রত্যাহার করে নেওয়া ক্ষমতাসীন ন্যায়বিচার ও উন্নয়ন পার্টির (একেপি) ইস্তাম্বুল কনভেনশনে পুনরায় যোগদানের সিদ্ধান্তকে পরিবর্তন করেনি। অধিকন্তু, ২৫ নভেম্বর ইস্তাম্বুলের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতাকালে তুরস্কের রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান জোর দিয়ে বলেছিলেন কনভেনশন থেকে প্রত্যাহার নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না।
অতীতের মতোই একমত না থাকা ২৫ নভেম্বর নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা নির্মূলের আন্তর্জাতিক দিবসে তুরস্ক জুড়ে জড়ো হওয়া অসংখ্য নারী ও নারী অধিকার সংগঠনের কর্মীরা রাষ্ট্রকে মনে করিয়ে দিতে চায় নারীর প্রতি সহিংসতা একটি জরুরি সমস্যা।
বার্ষিক মিছিলে নিষেধাজ্ঞা
নারীদের ২৫ নভেম্বরে মিছিল থেকে বিরত রাখতে বেশ কয়েকটি গভর্নর অফিস পদক্ষেপ নেয়। ইস্তাম্বুলের গভর্নরের কার্যালয় পাতাল রেল স্টেশনগুলি বন্ধ করে দিলেও দিয়ারবাকিরে বিক্ষোভ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়। আগের বছরগুলিতে পুলিশ সহিংসভাবে বিক্ষোভকারীদের দমন করে। এবছরও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। প্রতিবেদন অনুসারে বিক্ষোভের দিন বেশ কয়েকটি প্রদেশে নারী অধিকার কর্মীদের আটক করা হয়।
সহিংসতাই তুরস্কে নারীদের একমাত্র সমস্যা নয়। তুরস্কের প্রথম নারী আন্তর্জাতিক মাস্টার, গ্র্যান্ডমাস্টার ও জাতীয় দাবা দলের সদস্য কুব্রা ওজতুর্ক ওরেনলির উপবৃত্তি স্থগিত করা হয় ২০২৩ সালের অক্টোবরে। গর্ভবতী হওয়ার পরে ফেডারেশন থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ওরেনলি তাকে সরিয়ে দেওয়ার কথা ভাগাভাগি করলে তুর্কি দাবা ফেডারেশন এটিকে একটি “ভুল বোঝাবুঝি” বলেছে।
এছাড়াও দেশটি বাল্যবিবাহের ক্রমবর্ধমান হারে ভুগছে। একটি অনলাইন সংবাদ মঞ্চ গেজেট ডুভারের প্রতিবেদন অনুসারে, গত দশ বছরে তুরস্কে ১,৩০,০০০রও বেশি কম বয়সী মেয়ের বিয়ে হয়েছে।
নারী শ্রমিকদের অধিকার সংক্রান্ত ২৫ নভেম্বর প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৩ সাল থেকে ১,৩৭৯ জন নারী তাদের কর্মক্ষেত্রে নিহত হয়েছে। প্রতিবেদনে নারীদের বেকারত্বকে অর্থনৈতিক সহিংসতার একটি রূপ হিসেবে তুলে ধরে স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাব, যৌন হয়রানি, বৈষম্য, এবং কর্মক্ষেত্রে সহিংসতার অন্যান্য রূপের মতো হতভাগ্য পরিস্থিতিগুলি নারীর প্রতি সহিংসতার বিভিন্ন রূপের প্রতি জোর দেওয়া হয়েছে।
অপ্রতুল সরকারি পদক্ষেপ
রাষ্ট্রপতি এরদোয়ান ২৫ নভেম্বর নারীর প্রতি সহিংসতা মোকাবেলায় ব্যবস্থা বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করে একটি বিজ্ঞপ্তিতে স্বাক্ষর করেন। মধ্যরাতে প্রকাশিত ১৭-দফা বিজ্ঞপ্তির আনুষ্ঠানিক গেজেটে “নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা পর্যবেক্ষণ কমিটি” পরিবর্তন করে “নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রতিরোধের সমন্বয় বোর্ড” করার কথা ঘোষণা করা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে ঘোষিত অন্যান্য পদক্ষেপগুলির মধ্যে লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধে কার্যকরভাবে আইন বাস্তবায়নের জন্যে আইনি ও প্রশাসনিক পদক্ষেপের ধারাবাহিকতা, বিচারে ভুক্তভোগীদের প্রবেশাধিকারের সুবিধার্থে সংস্থান এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগুলির সরকারি কর্মীদের মধ্যে লিঙ্গ-সম্পর্কিত সহিংসতার জ্ঞান ও সচেতনতা বৃদ্ধি নিশ্চিতের বিভিন্ন পদক্ষেপের অন্তর্ভুক্তি রয়েছে।
ইস্তাম্বুলের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এরদোয়ান বলেছেন, “আমাদের বিশ্বাস নতুন বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আমাদের প্রতিষ্ঠিত সমন্বয় বোর্ডটি নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা মোকাবেলায় তুরস্কে শতাব্দীর সেরা কাজ করবে।”
সমালোচকরা অবশ্য বিজ্ঞপ্তিটিকে সাময়িক সমাধান হিসেবে দেখেছে। উদাহরণস্বরূপ, তুরস্কে সহিংসতার ভুক্তভোগীদের জন্যে সংযত আদেশ ও সুরক্ষা ব্যবস্থা পর্যাপ্তভাবে প্রক্রিয়াকরণ হয় না বলে বিজ্ঞপ্তির “সহিংসতার প্রতি শূন্য সহনশীলতা”র প্রতিশ্রুতি ফাঁকা বিবেচিত।
“বিজ্ঞপ্তিগুলি সহিংসতার সমাধান নয়,” বলেছেন নারীদের অধিকার নিয়ে কর্মরত আইনজীবী ইল্কে ইস্ক৷ এদিকে ইস্তাম্বুল আইনজীবী সমিতির সভাপতি ফিলিজ সারাক বিজ্ঞপ্তিটির প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন এটি নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার বিরুদ্ধে লড়াইটা কী রাষ্ট্রের তা বুঝতে না পারার একটি ইঙ্গিত:
আমাদের দেশে নারীর প্রতি সহিংসতা ও নারীহত্যার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। নারীর প্রতি সহিংসতা লিঙ্গ বৈষম্য ও নারীর প্রতি বৈষম্য থেকে উদ্ভূত। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সহিংসতা প্রতিরোধে প্রণীত আইন ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা কার্যকর নয় বলে কোনো আইন, প্রবিধান বা বিজ্ঞপ্তি নারীহত্যার ক্রমবর্ধমান সংখ্যা রোধ করতে পারে না।
তুরস্কের প্রধান বিরোধী দল প্রজাতন্ত্রী জনদলের সহ-সভাপতি আইলিন নাজলিয়াকা বলেছেন, বিজ্ঞপ্তিটি “তিন থেকে পাঁচটি ভাল আইটেম দিয়ে আমাদের প্রতারণা করতে পারে না।” পরিবর্তে নাজলিয়াকা রাষ্ট্রকে দেরি না করে ইস্তাম্বুল কনভেনশনে পুনঃস্বাক্ষরের আহ্বান জানিয়েছেন।
ইস্তাম্বুলে ২৫ নভেম্বর একটি বিক্ষোভে বক্তৃতায় আমরা নারীহত্যা বন্ধ করবো মঞ্চের মহাসচিব ফিদান আতাসেলিম বলেন, “নারীহত্যা বাড়ছে। নারীরা প্রতিদিনই পুরুষদের হাতে খুন হচ্ছে। দুর্ভাগ্যবশত, তাদের আর শুধু হত্যা করা হয় না। আত্মহত্যার রূপ দিয়ে তাদের ঢেকে রাখা হয়। নারীদের প্রতিনিয়ত জানালা ও বারান্দা থেকে ছুড়ে ফেলা হচ্ছে। কোনো কার্যকর তদন্ত করা হচ্ছে না। অন্য কথায়, তারা নারীদের শুধু মাটির নিচে কবর দেয় না, তারা নারীদের সাথে সত্যকেও কবর দেয়। আমরা আবার তাদের আলোচ্যতে সন্দেহজনক মৃত্যু রাখবো। আমরা কখনোই তথাকথিত আত্মহত্যাকে সন্দেহজনক হিসেবে ছাড়বো না। আমরা নারীহত্যা বন্ধ করবো।”
এছাড়াও আতাসেলিম রাষ্ট্রপতির মন্তব্যের সমালোচনা করে বলেছেন কনভেনশন থেকে প্রত্যাহার তুরস্কে নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতার উপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলেনি:
ইস্তাম্বুল কনভেনশন আর নেই বলে থানা থেকে নারীদের ফেরত পাঠানোর এই মানসিকতার জন্যে লজ্জিত হওয়া উচিত। তাদের ‘কনভেনশন আর নেই’ এবং ৬২৮৪ আইন কার্যকর নয় বলে অরক্ষিত ও হত্যার শিকার সকল নারীদের জন্যে লজ্জিত হওয়া উচিৎ।”
নারীদের গার্হস্থ্য সহিংসতার বিরুদ্ধে সুরক্ষা দিতে ২০১২ সালে গৃহীত ৬২৮৪ নং আইন তুলে নেওয়াসহ দেশে নারীদের অধিকার খর্ব করতে মে ২০২৩ এর সাধারণ নির্বাচনের আগে একেপি ও এর নেতা অনেক দলের সাথে জোট করেছে।
একেপি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লিঙ্গ সমতার বিরুদ্ধে বেশ কিছু বিতর্কিত অবস্থান নিয়েছে। ক্ষমতাসীন দলটি গর্ভপাতের অধিকার, সহবাসোত্তর গর্ভরোধক বড়ি এবং অস্ত্রপচারের মাধ্যমে প্রসব সীমিতকরণের প্রস্তাব করে। এরদোগান নিজেই একবার বলেছেন নারীরা পুরুষের সমান হতে পারে না, নারীদের অবশ্যই মা হতে হবে এবং পরিবারে ন্যূনতম তিনটি সন্তান থাকতে হবে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এরদোয়ান ২০১২ সালে গর্ভপাতকে হত্যার সমতুল্য বলেছিলেন।
এদিকে তুরস্কে এখনো ১০ম সপ্তাহ পর্যন্ত এবং চিকিৎসা ঝুঁকির ক্ষেত্রে ২০তম পর্যন্ত গর্ভাবস্থার অবসান বৈধ হলেও তা করার মতো হাসপাতাল খুঁজে পাওয়া কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এরদোগান ২০১৪ সালে নারীবাদীদের মাতৃত্ব বুঝতে না পারায় অভিযুক্ত করেছিলেন। ইস্তাম্বুলে এক শীর্ষ সম্মেলনে বক্তৃতার সময় তিনি বলেন বলে কথিত যে, “কিছু লোক এটি বুঝলেও অন্যেরা তা পারে না। নারীবাদীরা মাতৃত্বের ধারণায় বিশ্বাসী নয় বলে আপনি তাদের কাছে এটি ব্যাখ্যা করতে পারবেন না।” তিনি আরো বলেন লিঙ্গ সমতা “মানবপ্রকৃতি বিরুদ্ধ” এবং কর্মজীবী নারীদের “ঘাটতি” রয়েছে। অতি সম্প্রতি ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে অতীতে নারীদের লক্ষ্যবস্তু করা তুরস্কের রাষ্ট্রীয় ধর্মীয় সংস্থা নারীদের একা ভ্রমণ করতে না পারার কথা বলেছিল।
সামগ্রিক পশ্চাদপসরণ বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বৈশ্বিক লিঙ্গ বিচ্যুতি সূচকের প্রতিবেদনেও প্রতিফলিত হয়েছে। ফোরামের ২০২৩ সালের সবচেয়ে সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে, গবেষণায় থাকা ১৪৬টি দেশের মধ্যে তুরস্কের স্থান ১২৯তম।