ভারতের ক্রমবর্ধমান অনলাইন প্রতারণা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহারের জন্যে হুমকি

Photo by Sora Shimazaki via Pexels

সোরা শিমাজাকির ছবিপেক্সেল অনুমতির আওতায় ব্যবহৃত।

২০১৫ সালে ডিজিটাল ভারত কর্মসূচী চালু করলে তা ক্রমশঃ একটি ডিজিটাল বিপ্লবের সূচনা করে যা ভারতের আর্থ-সামাজিক পরিবেশকে গভীরভাবে পরিবর্তন করেছে। অনলাইন ক্লাসরুমে স্থানান্তর থেকে শুরু করে দৈনন্দিন কেনাকাটায় ব্যাপকভাবে ডিজিটাল লেনদেন গ্রহণের ফলে অনেক ভারতীয় এখন ডিজিটাল পরিশোধের সুবিধার পক্ষে। অনলাইন লেনদেনেও ভারত ২০২২ সালের তথ্য অনুসারে এগিয়ে আছে।

তবে এই রূপান্তরটি এসেছে একটি মূল্য চুকিয়ে, কারণ আর্থিক সাইবার অপরাধের বৃদ্ধি প্রতিদিন প্রায় ১০০ কোটি রুপির (১৩২ কোটি টাকার বেশি) অর্থনৈতিক ক্ষতি ঘটাচ্ছে৷

নিউজ চ্যানেল এনডিটিভি ভারত ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে “ওটিপি মাফিয়া” শিরোনামে একটি অনুসন্ধানী তথ্যচিত্র প্রকাশ করে, যা উত্তরের রাজ্য হরিয়ানার নুহ জেলায় পরিচালিত ব্যাপক সাইবার অপরাধকে প্রকাশ করেছে।

সাইবার নিরাপত্তা হুমকি

ভারতের ১৪৩ কোটি জনগণের মধ্যে ১১০ কোটিরও বেশি মোবাইল ফোন ও ৬৯.২ কোটিরও বেশি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রয়েছে যারা বিভিন্ন ডিজিটাল হুমকির জন্যে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।

ভারতে সংঘটিত আর্থিক সাইবার অপরাধ সর্বমোট সাইবার অপরাধের ৭৫ শতাংশেরও বেশি, যার মধ্যে রয়েছে ফিশিং কেলেংকারি, যৌনশোষণ, ওটিপি কেলেংকারি, ডেবিট কার্ড কেলেংকারি, কল সেন্টার কেলেংকারি এবং সংযুক্ত পরিশোধ ইন্টারফেস (ইউপিআই) অ্যাপ ব্যবহার করে প্রতারণামূলক কার্যকলাপের একটি পরিসর। সাম্প্রতিক মাসগুলিতে উচ্চ দারিদ্র্য ও বেকারত্বের জন্যে পরিচিত ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের নুহ জেলা সাইবার অপরাধীদের অকুস্থল হিসেবে কুখ্যাতি অর্জন করে সংবাদপত্রের শিরোনামে এসেছে৷

অনেক লোককে চাকরি ও আয়ের উৎসহীন করে ফেলা কোভিড-১৯ মহামারীর পরিপ্রেক্ষিতে নুহতে সাইবার অপরাধ তীব্রভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। রাতারাতি প্রভুত পরিমাণ অর্জনের একটি অন্যতম সহজ উপায় হিসেবে আবির্ভূত হওয়ায় আর্থিক জালিয়াতি শিক্ষিত যুবক-যুবতীদের প্রয়োজন মেটানোর উপায় অন্বেষণের দিকে ধাবিত করেছে। পুলিশের বিশ্লেষণ অনুসারে নুহ প্রতারকদের হাতে ভারতের ৩৫টি রাজ্যের ২৮,০০০ লোক ১০০ কোটি রুপি (প্রায় ১৩২ কোটি টাকা)-রও বেশি প্রতারণার শিকার হয়েছে৷

এটা কীভাবে কাজ করে?

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই প্রতারকরা নেতৃস্থানীয় ভারতীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের ছদ্মবেশ নিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সমস্যা থাকার কথা বলে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে বলে। প্রায়শই বড় পরিমাণে করা এই প্রতারণামূলক কলগুলিতে সন্দেহ না করা গ্রাহকরা শিকার হিসেবে ফাঁদে পড়ে।

সফলভাবে এই কেলেংকারিগুলি চালাতে প্রতারকরা বিভিন্ন টেলিযোগাযোগ অপারেটরের একাধিক সিম কার্ড ব্যবহার করে৷ সিম কার্ড পাওয়ার জন্যে জাল শনাক্তকরণ কার্ড ব্যবহার করে বা দরিদ্র লোকদের তাদের নথি সরবরাহে প্রলুব্ধ করা এবং এমনকি হয়তো বিদেশে বসবাসকারী প্রতারকদের কাছে বিক্রি করা এই সিম কার্ডগুলি প্রায়শই প্রতারণামূলক উপায়ে লাভ করা হয়।

দিল্লি পুলিশ ২০২৩ সালের এপ্রিলে পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রতারকদের কাছে প্রচুর পরিমাণে সিম কার্ডের বেআইনি ক্রয় এবং বিক্রয়ের সাথে জড়িত ৩১ জনকে গ্রেপ্তার করে। পুলিশ ঝাড়খণ্ডের জামতারা থেকে পরিচালিত একটি অপরাধী সিন্ডিকেটের কাছে বিক্রি করা প্রায় ২২,০০০ সিম কার্ড জব্দ করে।

জামতারার প্রতারণা কেন্দ্রটির কুখ্যাতি “জামতারা: সবকা নম্বর আয়েগা” (জামতারা: সবার সময় আসবে) শিরোনামের একটি ২০২০ সালে নেটফ্লিক্স ওয়েব ধারাবাহিককে অনুপ্রাণিত করে। ধারাবাহিকটি কীভাবে কিশোর-কিশোরীরা বহু সিম কার্ড, মোবাইল ডিভাইস এবং জাল পরিচয় ব্যবহার করে এই কার্যকলাপের সাথে জড়িত হয় তা তুলে ধরে জামতারায় পরিচালিত কেলেংকারিগুলিকে তার আসল রূপকে চিত্রিত করেছে।

দিল্লির গবেষক প্রিয়াংশু রত্নাকর এক্সে (পূর্বে টুইটারে) বলেছেন:

ভারতে ৫ম-প্রজন্ম চালুর পর সাইবার অপরাধীরা একটি নতুন কেলেংকারী প্রচার শুরু করেছে। আপনার সিম ৫ম-প্রজন্মে উন্নীত করার জন্যে আপনি ক্ষুদেবার্তা বা হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা পেতে পারেন।

উল্লিখিত যেকোন পদক্ষেপ অনুসরণ এড়িয়ে চলুন, এটি সিম সোয়াপ/ফরওয়ার্ড বা প্রতারণার কারণ উপায় হতে পারে।

বেঙ্গালুরুর তথ্যপ্রযুক্তি পেশাদার প্রিয়াঙ্ক আগরওয়াল এক্সে পরামর্শ দিয়েছেন:

ভারতে কেলেংকারীর বৈচিত্র্য ও মাত্রা গগণচুম্বী। গুরুত্বসহ আমাদের এই সমস্যাগুলির সর্বজনীন সমাধান দরকার।

নতুন সিম কার্ড পাওয়ার নিয়ম আরো কঠোর হলে কেমন হয়? এটি কমপক্ষে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নিরাপত্তার সমতুল্য হওয়া উচিত।

বেকারত্ব কেলেংকারীর দিকে পরিচালিত করে কি?

সাধারণত ২০ থেকে ৩৫ বছর বয়সী এই অপরাধীরা ইংরেজি ভাষার দক্ষতাসহ প্রযুক্তি-সচেতন তরুণদের একটি নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করে। এই তরুণ প্রাপ্তবয়স্কদের অনেকেই দক্ষ ও বেকার, জীবিকা অর্জনের বিকল্প উপায় হিসেবে কেলেংকারীর আশ্রয় নেয়।

ভারতের বিকাশমান প্রতারণা শিল্প: আপনার প্রযুক্তির সাহায্য নেওয়ার আগে’ শিরোনামের সিএনএ ইনসাইডার তথ্যচিত্রটি আয় উপার্জনের উপায় হিসেবে এই প্রতারণার কল সেন্টারগুলিতে কর্মরত কিছু ভারতীয় তরুণদের তুলে ধরে। ভারতীয় যুবকদের একটি ভাল সংখ্যক এই প্রতারণামূলক কল সেন্টারগুলিতে পূর্ণকালীন চাকরি হিসেবে কাজ করছে। দেশে ব্যাপক বেকারত্ব সমস্যা তাদের অনেককে অবৈধ হলেও এই লাইনে কাজ চালিয়ে যেতে বাধ্য করে।

‘কেন ভারতীয়রা প্রতারক কল সেন্টারে কাজ করতে ইচ্ছুক?’ শীর্ষক একটি রেডিট আলোচনা সূত্রে এমনকি অবৈধ কার্যকলাপে জড়িত হয়েও অর্থ উপার্জন ছাড়া কোনো বিকল্প না থাকা বিপুল সংখ্যক বেকার যুবকদের কাছে প্রায়ই সীমিত বিকল্প থাকর কথা অংশগ্রহণকারীরা তুলে ধরে

প্রতারণা ভারত ছাড়িয়ে

ভারতীয় প্রতারকদের আর্থিক সাইবার অপরাধের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ ঘটেছে। প্রতারণার শিকার হয়ে ২০২২ সালে বেশিরভাগ ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সী প্রবীণ মার্কিন নাগরিকদের অন্তত ১,০০০ কোটি ডলার ক্ষতি হয়েছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির সাথে কম পরিচিত ও ডিজিটাল ব্যবস্থায় প্রায়ই তাদের সহায়তার প্রয়োজন হয় বলে বিশেষভাবে প্রবীণ নাগরিকরা প্রতারকদের সহজ লক্ষ্যবস্তু

ফ্লোরিডায় ২০২৩ সালের জুনে একজন বয়স্ক মহিলার ৮০,০০০ ডলার (প্রায় ৮৮ লক্ষ টাকা) প্রতারণার জন্যে দুই ভারতীয়কে গ্রেপ্তার করা হয়

অন্যান্য ঘটনার বিপরীতে এই আন্তর্জাতিক প্রতারণাগুলিতে প্রাথমিকভাবে প্রযুক্তি সহায়তা জালিয়াতি জড়িত। বছরের পর বছর ধরে ভারতীয় শহরগুলিতে কল সেন্টার বেড়েছে। এই কল সেন্টারগুলির মধ্যে কয়েকটি দৃশ্যত বাহ্যিকভাবে একটি বৈধ পরিষেবা চালালেও পর্দার আড়ালে প্রতারণার কল সেন্টার পরিচালনা করছে।

এনডিটিভি ভারতের তথ্যচিত্র ওটিপি মাফিয়াতে এফবিআই-এর দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান শুয়েল দাউদের একটি সাক্ষাৎকারও রয়েছে, যেখানে তিনি এই ভারতীয় প্রতারকদের লক্ষ্যবস্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষতিগ্রস্তদের মোকাবেলায় তাদের প্রচেষ্টা নিয়ে আলোচনা করেছেন।

দিল্লি পুলিশ ও এফবিআইয়ের একটি যৌথ অভিযান ২০২৩ সালের জুনে মার্কিন নাগরিকদের প্রায় দুই কোটি মার্কিন ডলার প্রতারণা করা দিল্লির একটি কল সেন্টার উন্মোচন করে। একইভাবে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে আসাম পুলিশ গৌহাটিতে অনুরূপ আটটি প্রতারক কল সেন্টারে অভিযান চালিয়ে অন্তত ২০০ জনকে গ্রেপ্তার করে।

তবে বিশালসংখ্যক প্রতারকদের বিরুদ্ধে এই গুটিকয়েক পদক্ষেপ অপ্রতুল। ভারত জুড়ে বিশেষ করে শহরাঞ্চলে প্রতারণামূলক এই কল সেন্টারগুলি টিকে আছে এবং বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের মতো মূল কারণগুলি এদের বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করছে৷

এই প্রতিবেদন লিখতে সহায়তা করেছেন সিরনজিব ভারালি।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .