জাতিসংঘের সার্বজনীন পর্যায়ক্রমিক পর্যালোচনা প্রক্রিয়ায় থাকা দেশগুলিতে ডিজিটাল অধিকারের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ তুলে ধরে প্রবন্ধের একটি সংকলন উচ্চকণ্ঠ উদ্যোগ উপস্থাপনের জন্যে ক্ষুদ্র গণমাধ্যম ফাউন্ডেশনের সাথে অ্যাডভক্সের অংশীদারিত্বের অংশ হিসেবে তৈরি এই লেখাটি।
কেনিয়াকে শুধু স্থানীয় সমস্যার জন্যে দেশীয় প্রযুক্তির সমাধান নিয়ে তৈরি অসংখ্য প্রযুক্তি ও ফিনটেক স্টার্টআপের জন্যেই নয়, কেনিয়াবাসীদের দ্রুত প্রযুক্তি উদ্ভাবন গ্রহণ করার ক্ষমতার জন্যেও প্রায়ই সিলিকন সাভানা বলে ডাকা হয়। অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি প্রচার করা মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাপ এম-পেসা ছাড়া জীবন কল্পনা করা কঠিন। রয়টার্স ডিজিটাল সংবাদ প্রতিবেদন ২০২৩ অনুসারে টিকটকের সবচেয়ে বড় শ্রোতার আবাসস্থল কেনিয়া।
স্বাভাবিকভাবেই ২০২২ সালের নির্বাচনে বিশেষ করে সামাজিক গণমাধ্যম মঞ্চের মাধ্যমেপ্রযুক্তির ব্যবহার এবং অপব্যবহার জড়িত। আফ্রিকার কোডের জ্যেষ্ঠ্য তদন্ত ব্যবস্থাপক অ্যালান চেবোয়ের মতে কেনিয়ার ২০১৭ সালের নির্বাচনে ভোটারদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে কলংকিত প্রচারণার কথিত ব্যবহার ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকা উন্মোচনের পর কেনীয়রা এটিকে সহজেই প্রতিলিপি করার মতো কিছু হিসেবে দেখেছিল।
“তারা [ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকা] লক্ষ লক্ষ টাকা পরিশোধের দাবি করেছে। স্থানীয় প্রভাবকরা এটি দেখে ভেবেছিলেন, ‘তাহলে এই কাজটি করে আমরা কেন সেই টাকাগুলি পেতে পারি না?’” চেবোই গ্লোবাল ভয়েসেসকে একটি ফোন সাক্ষাৎকারে বলেছেন। “সুতরাং এবার প্রভাবকরা সমসাময়িক ছিল। এটিকে ২০১৭ সালে লাভজনক কিছু মনে হতো না।”
প্রভাবকদের নতুন তরঙ্গটি হলো প্রায়ই নিজেদের পরিচয় গোপনকারী মুখাবয়বহীন সামাজিক গণমাধ্যম অ্যাকাউন্টের একটি নেটওয়ার্ক। কেনিয়ার একটি গণমাধ্যম সংস্থাকে কলংকিত করতে ভাড়াটে প্রভাবক ব্যবহার সম্পর্কিত একটি তদন্তে দেখা গেছে এক্সে (আগের টুইটার) এলন মাস্কের নীতিমালার সুযোগে একেকজন প্রভাবক সাধারণত কয়েকটি যাচাইকৃতসহ অন্তত ১০টি অ্যাকাউন্ট চালায়৷
সেপ্টেম্বর ২০২২-এ কেনিয়ার সর্বশেষ নির্বাচনে রাষ্ট্রপতি রুটোর রাজনৈতিক দলের নিয়োগকৃত অনলাইন প্রভাবক তিনটি উৎস সাক্ষাৎকারে নির্বাচনে সামাজিক গণমাধ্যম ব্যবহার ও অপব্যবহারের এক ধরনের প্লেবুক প্রকাশ করেছে।
একটি শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব
একটি দেশ যেখানে ৮০ শতাংশেরও বেশি খ্রিস্টান সেখানে ২০২২ সালের নির্বাচনে ধর্মের একটি মুখ্য ভূমিকা পালন আশ্চর্যজনক কিছু নয়। বিজয়ী প্রার্থী উইলিয়াম রুটো একটি “ঈশ্বর-নির্বাচিত” খ্রিস্টান নেতা হিসেবে একটি মোটামুটি প্রতিযোগিতামূলক প্রচারাভিযান চালিয়েছিলেন।
অন্য কারো মতো রুটোর শিবির তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ রাইলা ওডিঙ্গার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক কার্ড হিসেবে ধর্মকে ব্যবহার করে “রাইলা একজন শয়তান পূজারী” এর মতো প্রচারণা চালায়। ওডিঙ্গার স্ত্রীর বক্তৃতায় গীর্জা নিয়ন্ত্রণের আহ্বান জানিয়েছেন বলে অন্য একটি কলংকের প্রচারণা অনুসারে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে ওডিঙ্গা নাকি গীর্জা বন্ধ করে দেবেন।
বেকারত্ব টোপ
গ্লোবাল ভয়েসেসের সাক্ষাৎকার গৃহীত তিনজন প্রভাবক বলেছে তারা প্রচারাভিযান প্রতি প্রায় ১,০০০ কেনীয় শিলিং (প্রায় ৭৭০ টাকা) এবং একাধিক প্রচারণা থেকে মাসে প্রায় ৫০,০০০ কেনীয় শিলিং (প্রায় ৩৬,৭০০ টাকা) উপার্জন করবে, বিশেষ করে নির্বাচনের ঠিক আগের তিন মাসে। এটিকে নির্বাচনের আগে তাদের একই ধরনের প্রচারাভিযানে থেকে প্রচারণা প্রতি ৭০০ কেনীয় শিলিং (প্রায় ৫৫০ টাকা) এর সাথে তুলনা করা যায়।
প্রভাবকদের একজন জেমস (তার আসল নাম নয়) গ্লোবাল ভয়েসেসকে বলেছেন একটি যথাযথ সামাজিক গণমাধ্যম প্রচারণার জন্যে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ হতে পারে যাতে প্রভাবক, ক্ষুদ্র-প্রভাবক, ডিজাইনার, আলোকচিত্রী, ভিডিওগ্রাফার এবং ফটো ও ভিডিও সম্পাদক নিয়োগের মাধ্যমে অনেক সম্ভাব্য কর্মসংস্থান রয়েছে।
জানতে হবে কোথায় কী পোস্ট করবেন
অনেক কেনীয় এখনো ফেসবুকে রয়েছে। নির্বাচনের সময় ফেসবুক গ্রুপগুলো মুখ্য ভূমিকা পালন করে। জেমস বলেন, “প্রার্থীরা ফেসবুক গ্রুপ পর্যন্ত কিনে নেয় যাতে গ্রুপটি শুধু প্রার্থী সম্পর্কে ইতিবাচক বার্তা পোস্ট করে।”
ফেসবুক গ্রুপগুলি ব্যবহারের সাথে নির্বাচনী ভুল তথ্যের সূতিকাগার হিসেবে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপগুলির ব্যবহারের সাথেও ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। সীমাবদ্ধ চ্যানেলগুলি, “মানুষকে একটি নিরাপদ স্থানের অনুভূতি দেয়,” চেবোই বলেন। এই লক্ষ্যে হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুক গোষ্ঠীগুলি ঘৃণাত্মক বক্তব্য চিহ্নিতকরণের বিষয়বস্তু নিয়ন্ত্রণ ও সত্য-যাচাইয়ের হস্তক্ষেপ এড়িয়ে যেতে কখনো কখনো স্থানীয় ভাষায় যোগাযোগকারী নির্দিষ্ট জাতিগত গোষ্ঠীগুলিকে আরো বেশি লক্ষ্যবস্তু করে।
অন্যদিকে এক্স (পূর্বের টুইটার) চাউর বিষয় ও হ্যাশট্যাগের মাধ্যমে চালিত হয়। এটি সমন্বিত অনিশ্চিত আচরণের (সিআইবি) জন্যে পছন্দনীয় মঞ্চ, যেখানে বেশিরভাগ জাল ও স্বয়ংক্রিয় অ্যাকাউন্ট ব্যবহারকারী প্রভাবকদের একটি নেটওয়ার্ক অল্প সময়ের মধ্যে একই কীওয়ার্ড, বিষয়বস্তু ও হ্যাশট্যাগ পোস্ট করে অ্যালগরিদম-নির্ভর ব্যবস্থাগুলিকে কাজে লাগিয়ে কোনো বিষয়বস্তুকে চাউর করে তোলে।
“আগে প্রায় দুই ঘন্টা ধরে হ্যাশট্যাগ এগিয়ে নিতে প্রায় ২০টি অ্যাকাউন্ট লাগতো। আর এখন এটা করতে ৩০টিরও বেশি অ্যাকাউন্টকে প্রায় দুই ঘন্টা ধরে ১,৬০০টিরও বেশি পোস্ট করে যেতে হয়। তাদের অনন্য আইপি ঠিকানা, অনন্য অর্গানিক পোস্টকে বিভিন্ন অবস্থান থেকে আসতে হয়, যাতে সেগুলি রোবটের কাজ হিসেবে পতাকাঙ্কিত না হয়,” কেনিয়ার জনপ্রিয় ব্লগার সাইপ্রিয়ান নিয়াকুন্ডি বলেছেন।
টিকটক মঞ্চটি পরিষ্কারভাবে “আফ্রিকীয় গণতন্ত্রে তার প্রথম বাস্তব পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে”, কারণ একটি মোজিলা প্রতিবেদন অনুসারে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে কেনিয়ার নির্বাচনকে ঘিরে ৪০ লক্ষ ব্যবহারকারীর কাছে রাজনৈতিক ভুল তথ্য সম্বলিত ১৩০টিরও বেশি ভিডিও পাওয়া গেছে।
এসব মঞ্চ জুড়ে ছড়িয়ে পড়া মিথ্যা তথ্যের মধ্যে বানোয়াট সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠা, ফটোশপ করা ও বাতিল ছবিতে দেখানো একটি সমাবেশে একজন প্রার্থীর বিশাল জনসমাগম এবং প্রথমবারের মতো একটি ভুয়া ইশতেহার রয়েছে।
মূলধারার গণমাধ্যমে অস্বীকৃতি, অধিকার বঞ্চনা ও আপস
কেনিয়ার গণমাধ্যম পর্ষদ মূলধারার গণমাধ্যমের ২০২২ সালের নির্বাচনের দুই শীর্ষ রাষ্ট্রপতি প্রার্থীর পক্ষপাতদুষ্ট কভারেজকে পতাকাঙ্কিত করেছে: রাইলা ওডিঙ্গার ৬১.২ শতাংশ এবং উইলিয়াম রুটোর ৩৮.২ শতাংশ গণমাধ্যম কভারেজ।
তবে আমাদের অন্য একটি সূত্র জিমের (নাম পরিবর্তিত) মতে মূলধারার গণমাধ্যম কভারেজ একজন বিজয়ী প্রার্থীর জন্যে তাদের কম সক্রিয় অনলাইন প্রচারণা একটি দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল।
এখন অন্যান্য রাজনীতিবিদরা বিরোধীদের পরাস্ত করতে আপনার সামাজিক গণমাধ্যম ব্যবহার দেখতে পাচ্ছে,” জিম বলেন। “তাকে [রুটো] পর্যাপ্ত এয়ারটাইম দেওয়া হয়নি। তাই মূলধারার গণমাধ্যমের উপর নির্ভর না করে বিশেষ করে ফেসবুকের মাধ্যমে আমরা গ্রাম এলাকার জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি।”
পক্ষপাতমূলক মূলধারার গণমাধ্যম কভারেজের ফলে গণমাধ্যমের উপর আস্থা কমে গিয়ে সামাজিক গণমাধ্যমের প্রভাবক ও ব্লগাররা তথ্যের বিকল্প উৎস হয়ে ওঠে।
শুধু নির্বাচনে জিতে থেমে থাকবে না
জিম বলেছেন তিনি এখন আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রীয় ভবনে কাজ করেন। রুটো নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর তাদের বিরুদ্ধে অভিনন্দন বার্তা পোস্টের অভিযোগ ওঠে। জিম ও তার দল এখন রাষ্ট্রপতির বিভিন্ন প্রকল্প সম্পর্কে পোস্ট করে। বিভাগটি #পরিকল্পনাসরবরাহ #রুটোরক্ষমতায়ন #রুটোরসরবরাহ এর মত হ্যাশট্যাগ চালায়।
সমাধান আবিষ্কৃত
চেবোয়ের মতে ২০২২ সালের নির্বাচনের আগে ও চলাকালে ভুল তথ্য রোধের চেষ্টা চলেছিল।
“আমি মনে করি প্রথমবারের মতো আমরা অনেক সহযোগিতা দেখেছি। সুশীল সমাজের কুশীলবরা ঘৃণামূলক বক্তব্য নিরীক্ষণের দায়িত্বে থাকা সরকারি সংস্থা জাতীয় ঐক্য ও সমন্বয় কমিশনের (এনসিআইসি) সাথে সহযোগিতা করতে পেরেছে,” তিনি বলেছেন। “জাতিসংঘ আগাম সতর্কতা সনাক্তকরণ ও প্রতিক্রিয়া সমর্থন করায় আমরা শান্তি প্রচারের মাধ্যমে সচেতনতা ও নাগরিক প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পেরেছি।”
ফুম্বুয়ার মতো মঞ্চগুলি সাংবাদিক ও জনসাধারণকে মিথ্যা তথ্য শনাক্ত ও নির্মূল করা সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিতে সারাদেশ থেকে সত্য-যাচাইকারীদের একত্রিত করেছে। একই সময়ে সুজাজের মতো মঞ্চের শান্তি সমর্থনের উদ্যোগ তরুণদের শান্তি প্রচারে উৎসাহিত করেছে। পেসাচেক, আফ্রিকাচেক, পিগা ফিরিম্বি ও আইভেরিফাই এর মতো কেনীয় সত্য-যাচাইকারী সংস্থাগুলি প্রিবাঙ্কিং হস্তক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে এসে পূর্ববর্তী নির্বাচনী ভুল তথ্যের প্রবণতার উপর ভিত্তি করে সম্ভাব্য মিথ্যা তথ্যকে উড়িয়ে দেয়।
প্রভাবকদের বেশিরভাগই গড়ে ২৫ বছর বয়সী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আমাদের সাক্ষাৎকার গৃহীত তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক প্রভাবক জেমস ২৭ বছর বয়সী একজন বিপণন সংস্থার মালিক যিনি আপাতভাবে খাদ্য শৃঙ্খলের শীর্ষে। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপগুলিতে ক্ষুদ্র-প্রভাবকদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে তিনি মূল সংগঠকদের একজন। এখনো একজন ছাত্র জিম (২৪) উল্লেখ করেছেন তার অনেক সহকর্মী প্রভাবক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। রাষ্ট্রীয় ভবনের একজন বেতনভোগী সরকারি কর্মচারী হয়েও তিনি বর্তমানে পূর্ণকালীন ছাত্র।
“আমার কাছে এটি একটি ভাল পেশাজীবন,” জিম বলেন, “এতে আমার বেশি সময় যায় না। যতোক্ষণ আমার ইন্টারনেট আছে, আমি যেকোনো জায়গা থেকে কাজ করতে পারি। আনুষাঙ্গিক কিছুর মতো আমি আমার পড়াশুনার সাথে এর ভারসাম্য রাখতে পারি।”
বিশ্ব যখন ২০২৪ সালে প্রত্যাশিত ৬৫টিরও বেশি নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন প্রযুক্তিগত ন্যায়বিচারের বৈশ্বিক জোট সামাজিক গণমাধ্যমের মঞ্চগুলিকে তাদের মঞ্চে নির্বাচনী ভুল তথ্য, বিভ্রান্তি ও ঘৃণামূলক বক্তব্য বন্ধ করে গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখার আহ্বান জানিয়ে #গণতন্ত্রেরবছর প্রচারণা শুরু করেছে৷