
ডিমকে গরীবের প্রোটিন বলা হয়ে থাকে। দেশের সবাই কম বেশি ডিম খেয়ে থাকেন।
ছবি তুলেছেন ইসাবেল হুরবাইন পালাটিন। সিসি বিওয়াই-এসএ ২.০ লাইসেন্সের আওতায় উইকিপিডিয়া থেকে নেয়া।
ডিম স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী একটি খাবার। শরীরের নানা প্রয়োজনীয় উপাদানের ঘাটতি পূরণ করতে সাহায্য করে। নানা অসুখ প্রতিরোধ করা থেকে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসহ অনেক কিছুর জন্য দারুণ উপকারী ডিম। বিশেষজ্ঞরাও প্রতিদিন একটি করে ডিম খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
কিন্তু বাংলাদেশে এই উপকারী ডিম খাওয়াও এখন নিরাপদ নয়। এক গবেষণায় খামারে উৎপাদিত যেসব ডিম ঢাকা শহরে পাওয়া যায়, তাতে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মাত্রায় ভারী ধাতুর উপস্থিতি পাওয়া গেছে। সর্বোচ্চ অনুমোদিত মাত্রার (ম্যাক্সিমাম পার্মিসিবল লিমিট বা এমপিএল) চেয়ে বেশি পরিমাণে দস্তা, তামা, সিসা ও লোহা পাওয়া গেছে। মাত্রাতিরিক্ত এসব ভারী ধাতুর কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে।
ডিমের মাধ্যমে বিষাক্ত পদার্থ গ্রহণ ও ঢাকা নগরীর মানুষের সম্ভাব্য স্বাস্থ্যঝুঁকি পরিমাপ শীর্ষক গবেষণাটি করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ ও হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয় গবেষক। গবেষণাটি নেদারল্যান্ডভিত্তিক চিকিৎসা ও বিজ্ঞানবিষয়ক জার্নাল সায়েন্স ডিরেক্ট-এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে।
তাদের গবেষণায় ডিমে ১০টি ভারী ধাতুর উপস্থিতি খোঁজা হয়েছে। এর সব কটিরই উপস্থিতি পাওয়া গেছে গবেষণায়। এর মধ্যে ছয়টির উপস্থিতি সর্বোচ্চ অনুমোদিত মাত্রার (এমপিএল) মধ্যে রয়েছে। বাকি চারটি দস্তা, তামা, সিসা ও লোহা’র উপস্থিতি এমপিএলের চেয়ে বেশি। এই ফলাফল কতটা বিপদের বার্তা দিচ্ছে? এ প্রসঙ্গে গবেষণার সাথে যুক্ত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক দোলন রায় প্রথম আলো’র সাথে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন:
খাদ্যে মাত্রাতিরিক্ত যেকোনো ধাতুর উপস্থিতিই খারাপ। এর কারণে হৃদ্যন্ত্র, কিডনি ও যকৃৎ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এতে ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে। ফলে ডিমে চারটি ভারী ধাতুর মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতির যে তথ্য আমাদের গবেষণায় উঠে এসেছে, তা অবশ্যই উদ্বেগের কারণ।
… মাত্রাতিরিক্ত দস্তায় রক্তশূন্যতা ও ক্ষুধামান্দ্য হয়। অতিরিক্ত তামার উপস্থিতিতে বমি বমি ভাব, ডায়রিয়া, পেটে অস্বস্তি ইত্যাদি হয়। অতিরিক্ত সিসা কার্ডিওভাসকুলার ব্যবস্থার ক্ষতিসাধন করে, উচ্চ রক্তচাপ বাড়ায়। অতিরিক্ত লোহা কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট, শ্বাসপ্রশ্বাসে জটিলতা, খিঁচুনি, বিষণ্নতা ইত্যাদির জন্য দায়ী।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতিদিন চার কোটি ডিমের প্রয়োজন হয়। দেশের সবাই কম বেশি ডিম খেয়ে থাকেন। ডিমে থাকা এসব ভারী ধাতুর কারণে জনস্বাস্থ্যের উপর যে ঝুঁকি যে তৈরি হয়েছে, সেটা দেখার কেউ জানিয়ে আক্ষেপ করে হারুনার রশীদ লিখেছেন:
মুরগির খাবারের মাধ্যমেই বিষাক্ত ধাতু মুরগির পেটে যায়। চামড়ার ট্যানারীর বিষাক্ত বর্জ্য দিয়ে মোরগ এবং মাছের খাবার তৈরি হয়। একটি জাতির মনন যখন পচে যায় তখন এই সব ঘটতেই থাকবে। দেখারও যেন কেউ নেই!

বাজারে বিক্রির জন্য রাখা ডিম। ছবি তুলেছেন IFPRI । ফ্লিকার থেকে নেয়া। সিসি বাই-এনসি -এনডি ২.০ লাইসেন্সের আওতায় প্রকাশিত।
ডিমে ভারী ধাতুর উপস্থিতি
ডিমে এই ভারী ধাতু কোথা থেকে এলো, সে প্রসঙ্গে পোল্ট্রি শিল্পের সাথে জড়িত অনেকেই ট্যানারির বর্জ্যরে কথা উল্লেখ করেছেন। ট্যানারির বর্জ্যে ভারী ধাতুর পরিমাণ বেশি থাকে। মুরগির খাদ্যে কখনো কখনো ট্যানারির বর্জ্য মেশানো হয়। কারণ, তাতে প্রোটিনের পরিমাণ বেশি থাকে। যা মুরগিকে তাড়াতাড়ি বড় হতে সাহায্য করে। গবেষকরাও ধারণা করছেন, খাবারের মাধ্যমে মুরগির শরীরে বিষাক্ত ভারী ধাতু প্রবেশ করছে। সেখান থেকে ডিমে। আর ডিম থেকে মানুষের শরীরে।
এজন্য গবেষণার সাথে যুক্ত অধ্যাপক দোলন রায় খামারে পালন করা মুরগির খাবার নিরাপদ হওয়া উচিত বলে জানিয়েছেন। প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার খাদ্য উৎপাদনকারীদের কাছে নিরাপদ পোল্ট্রি খাবার দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। কারণ, নিরাপদ পোল্ট্রি খাদ্য না পেলে প্রান্তিক খামারিরা নিরাপদ মুরগির মাংস ও ডিম দিতে পারবেন না।
শুধু ডিমে নয়, মুরগি, মাছ, শাকসবজিসহ সবকিছুতেই দূষণ। এই বিষাক্ততার ভিড়ে সুস্থ থাকাটাই দিন দিন সংকুচিত হয়ে আসছে জানিয়ে ইমু বড়ুয়া লিখেছেন:
খাবার পানিতে বিষাক্ততা, চালে ক্যাডমিয়াম, ডিমে রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতি, মুরগীতে ক্রমিয়াম, পাউরুটিতে পটাশিয়াম ব্রোমেট, দুধে সীসা, মাছে অতিরিক্ত এন্টিবায়োটিক, চিংড়িতে কেমিক্যাল জেলি, শাকসবজিতে লেদ, আর্সেনিক, কেডিয়ামের উপস্থিতিতে মানুষ কি খেয়ে বাঁচবে!
বাংলাদেশে প্রাণিজ আমিষের সবচেয়ে সস্তা উৎস ডিম। এতো দিন সীমিত আয়ের মানুষের কাছেও সাশ্রয়ী পণ্য হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরেই ডিমের দাম বাড়তির দিকে। সরকার থেকে দাম বেঁধে দিলেও বাজারে সে দামে ডিম মিলছে না। দাম বাড়ার কারণ হিসেবে পোল্ট্রি শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্টরা পোল্ট্রি খাদ্য, জ্বালানির দাম বৃদ্ধিকে দায়ী করেছেন। একদিকে বাড়তি দাম, আরেক দিকে ভারী ধাতুর কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি, দুটোই সাধারণ মানুষকে দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে।