বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় একসময় ৪৭টি খাল সচল ছিল। চারপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদীর সঙ্গে সংযুক্ত ছিল ওই খালগুলো। বৃষ্টির পানি নিঃসরণের পাশাপাশি নৌকা, স্টিমার চলতো সেসব নদীখালে। এই খালগুলোর বেশিরভাগই হারিয়ে গেছে। এর মধ্যে ২৬টি এখনো টিকে আছে, এবং সেগুলোর বিভিন্ন অংশ দখল হয়ে গেছে। তাছাড়া দূষণের কারণে নদীর সাথে যুক্ত হতে পারছে না। ফলে বৃষ্টি হলেই ঢাকায় জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে।
ঢাকার খাল পরিষ্কার, পয়ঃনিষ্কাশন ও ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের উপর থাকলেও তারা বর্ষা মৌসুমের আগে সেগুলো পরিষ্কার করে শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে ব্যর্থ হয়েছে। এদিকে একজন কার্টুনিস্টের নেতৃত্বে একদল তরুণ স্বেচ্ছাসেবক ঢাকার মোহাম্মদপুর হাউজিং সোসাইটি এলাকার একটি অতিদূষিত খাল পরিষ্কার করতে এগিয়ে আসেন, যা শহরের সবার মনোযোগ কেড়েছে এবং প্রশংসা অর্জন করেছে।
গত কয়েক বছর ধরে, ঢাকা শহর ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে বারবার জলাবদ্ধতা দেখা যাচ্ছে। ২০২৩ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে দ্রুত নগরায়ন, জনসংখ্যার ঘনত্ব বৃদ্ধি এবং অপ্রতুল ও অপরিকল্পিত পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থা এই জলাবদ্ধতার সমস্যার মূল কারণ। বিদ্যমান স্টর্মওয়াটার ড্রেনেজ সিস্টেম সমস্ত শহরে বিস্তৃত নয় এবং ড্রেন ও খালগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ায় অতিবৃষ্টির ফলে পতিত পানি কার্যকরভাবে নিষ্কাশন করা যায় না – ফলে রাস্তাগুলো পানিতে ডুবে যায়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম
গত সেপ্টেম্বর মাসে বৃষ্টিতে মিরপুরে জলাবদ্ধ রাস্তায় উন্মুক্ত বৈদ্যুতিক তারে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ৪ জন মারা যান।
বিষয়টি কার্টুনিস্ট মোরশেদ মিশুকে নাড়া দেয়। মিশু সম্প্রতি শহরের কিছু দেয়াল পরিষ্কার ও রং করার জন্য #flash_mop শিরোনামে একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রচেষ্টার নেতৃত্ব দিয়েছেন। সেটার জের ধরেই তার মনে হয়েছিল, ঢাকার বুকে বয়ে চলা খালগুলো পরিষ্কারের কথা। এটি করতে পারলে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি মিলবে। দুর্ঘটনায় প্রাণহানিও বন্ধ হবে। এরমধ্যে তার এক বন্ধু ফেসবুকে মোহাম্মদপুর হাউজিং লিমিটেডের মধ্যে অবস্থিত একটি খালের ভিডিও পোস্ট করেন। খালে কয়েক স্তরের ময়লা জমে আছে। পানিই দেখা যায় না।
খালটি পরিষ্কার করার ইচ্ছার কথা জানিয়ে মোরশেদ মিশু তার ফেসবুকে একটা পোস্ট দেন সেপ্টেম্বরের ২২ তারিখে। সেখানে তিনি লিখেন:
পরবর্তী দেয়াল পরিষ্কারের উদ্যোগ নেয়ার আগে এই খাল/নালা পরিষ্কারের উদ্যোগ নিবো মনস্থির করছি…
মোহাম্মদপুরে আমার বন্ধু, বড় ভাই, ছোট ভাইদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেছি… ইউল্যাবে আমার প্রিয় ছোটভাইদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করতেছি… আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য…
ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠান আগ্রহ দেখাইলে অবশ্যই ওয়েলকাম… তবে অতিমাত্রায় ব্র্যান্ডিং আশা কইরেন না আর কি…
আর যদি সহযোগিতা না ও পাই, তবুও চেষ্টা করমু… ফেইল মারলে ফেইল… কিন্তু, চেষ্টা না কইরা হাল ছাড়া যাইবো না…
মোরশেদ মিশু খাল পরিষ্কার করার কার্যক্রমের নাম দেন- প্রোজেক্ট খালে হবে। তার আহ্বানে শ’খানেক বিভিন্ন বয়সের মানুষ সাড়া দেন। কাজের সময়ের আনুষঙ্গিক সব খরচের জন্য অনেকেই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। ফেসবুকে মানুষের এই স্বত:স্ফুর্ত অংশগ্রহণকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের শক্তি হিসেবে উল্লেখ করে মোরশেদ মিশু লিখেন:
খালে হবে’ প্রজেক্টায় আপনাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করার আগ্রহ দেখে যে কি সাহস পাইতেছি বলে বোঝানো সম্ভব না…
মোরশেদ মিশু ও তার দলবল মিলে গত ২৮ ও ২৯ সেপ্টেম্বর মাত্র দুইদিনে মোহাম্মদপুরের রামচন্দ্রপুর খাল পরিষ্কার করেছেন। পাশাপাশি খালের উপর তিনটি সেতুও রং করেছেন। যে পরিমাণ ময়লা-আবর্জনা ছিল, কাজটা করা খুব কঠিন ছিল। কিন্তু সেই কঠিন কাজটাই স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে করে দেখিয়েছেন মোরশেদ মিশু।
তার টিমের এক সদস্য ঋষি কাব্য লিখেছেন:
… দুইদিনে পুরো টিম যা শিখলো ” মানবজাতি / বাঙালিজাতি ড্রেনে শুধু নিজে ঝাঁপ দেন না এবং টাকা ফেলে দেন না । এই ছাড়া যাবতীয় যা আছে সব ড্রেনে ফেলে । কি উঠানো হয় নাই? বালিশ, কোলবালিশ, কম্বল, কাঠের ফার্নিচার, খেলনা পুতুল , ডেইলি ওয়েস্ট ….”
যাই হোক হয়তো এক সপ্তাহ এই খাল এমন পরিষ্কার থাকবে কিংবা কিছুদিন বেশি? কিন্তু এই যে এতো গুলা মানুষ দেখলো জানলো যে আমরা চাইলেই দুইদিনে একটা এলাকার চেহারা বদলায় ফেলতে পারি? এরা কি কিছু শিখে নাই? আশা করি শিখেছে….. এবং পরের বার নিজের এলাকা পরিষ্কার হয়তো নিজেরাই করবেন…..
মোরশেদ মিশুর এটাই প্রথম উদ্যোগ নয়। এর আগেও তিনি ঢাকার মিরপুরের এক রাস্তা পরিষ্কার করে নানা রঙে রাঙিয়েছেন। প্রথম আলো’র সাথে এক সাক্ষাৎকারে আগামী দুই বছরে ২০০ দেয়াল, নদী, খাল পরিষ্কারের উদ্যোগ নেয়ার কথা জানিয়েছেন তিনি।
যে কাজের দায়িত্ব সরকারের, সে কাজ করায় মোরশেদ মিশু’র প্রশংসা করে নারায়ণগঞ্জের ইশতিয়াক আহমেদ তার ফেসবুকে লিখেছেন:
নিজের ব্যক্তিগত সম্পদ, সম্পত্তির বাইরে এসে কেউ যদি সামগ্রিক মানুষের জন্য সরকারি সম্পদকে রঙিন করতে নিজের সময় এবং শক্তিকে ব্যায় করে তাকে সাধারণ মানুষ ধরার কোনও কারণ নেই।
সে আলাদা।
সে অসাধারণ।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম তার ফেসবুক পেইজে প্রোজেক্ট খালে হবে’র একটি ভিডিও শেয়ার করে লিখেছেন- “একটু একটু করে আমরা সবাই মিলে বদলে দিচ্ছি ঢাকা”। উল্লেখ্য, স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনার, সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা এই উদ্যোগে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করেছেন।