নৈতিকতা পুলিশের হাতে চুল পুরোপুরি ঢেকে না রাখার জন্যে ২২ বছর বয়সী এক কুর্দি নারী মাহসা জিনা আমিনির মর্মান্তিক মৃত্যুর প্রথম বার্ষিকীর স্মারক হিসেবে আসা এই গল্পটি প্রবাসী ইরানি নারীদের প্রদর্শিত স্বাধীনতার প্রচেষ্টা ও সহনশীলতার অভিজ্ঞতার গভীরে যাওয়া একটি ধারাবাহিকের অংশ। ঘটনাটি ইরানে ব্যাপক বিক্ষোভের জন্ম দেয়, যা সরকারি নিপীড়ন বৃদ্ধি সত্ত্বেও আজও অব্যাহত।
ইরানে ২০০৯ সালের জুনে অভূতপূর্ব “সবুজ আন্দোলন” উন্মোচনের সময় আমি উপস্থিত ছিলাম না। রাষ্ট্রপতি হিসেবে মাহমুদ আহমাদিনেজাদকে দ্বিতীয় মেয়াদে সুরক্ষিত করা ইরানের বিতর্কিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে আবির্ভূত এই আন্দোলনটি নির্বাচনী জালিয়াতির বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদের দিকে পরিচালিত করে। এটি প্রথমবারের মতো ১৯৮০’র দশকে একটি অরাজনৈতিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করা আমার মতো কারো শাসকগোষ্ঠীর ব্যাপক ও প্রকাশ্য দমন-পীড়ন প্রত্যক্ষ করা চিহ্নিত করে। অথবা অন্তত ইন্টারনেট প্রথমবার আমাদের দেখার সুযোগ করে দিয়েছে।
কেউ কেউ বলতেই পারে ভাগ্যক্রমে আমিসহ অন্যরা আফসোস করে বলবো তেহরানের রাস্তায় নেমে আসা হাজার হাজার মানুষের প্রতিধ্বনিত পদধ্বনির সময় আমি সেখানে ছিলাম না।
আমার দেশের মানুষের ওপর অত্যাচারীদের গুলি চালানো এবং ভিড়ের মধ্যে ২৮ বছর বয়সী নেদা আগা সুলতানের বুকে বুলেট বিদ্ধ করার সময় আমি উপস্থিত ছিলাম না। বেশ কয়েক বছর ধরে “ইরানে না থেকে” কেবল বিশ্বে আমার অবস্থানকে সংজ্ঞায়িত করার এই বাস্তবতা জগদ্দল পাথরের মতো আমার বুকে প্রবলভাবে চেপে ছিল।
আমার নতুন বাড়ি, বার্লিন
আমি ২০০৯ সালের জুনে সাংবাদিক হিসেবে বার্লিনে একটি সংক্ষিপ্ত শিক্ষা সফরে থাকায় দূর থেকে “সবুজ আন্দোলন” পর্যবেক্ষণ করা আমাকে মিশ্রভাবে আবেগাক্রান্ত করে। একদিকে প্রায়শই “শেষের শুরু” হিসেবে বর্ণিত এটি অনেকের কাছে শাসনের পতনের সূচনা করতে পারে বলে পরিবর্তনের আশা ছিল। অন্যদিকে মূলত তেহরানে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ঘটনাবলী চিত্রিত করে অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া যন্ত্রণাদায়ক ছবিগুলো আমার হৃদয়কে ব্যাথিত করে।
বার্লিন সাধারণত জুন মাসে সবুজ সবুজ গাছ, পরাগ-বোঝাই গাছপালা আর মাঝে মাঝে বৃষ্টিতে সেজে থাকে। আমার স্মৃতিতে গেঁথে রয়ে গেছে কোনো ইচ্ছুক শ্রোতার সাথে শহরের চারপাশে আমার অর্ধ-জাগ্রত বিচরণসহ ইরানে কঠোর দমনাভিযান নিয়ে আমার কথোপকথন।
এই ঘোরাফেরার সময় আমি একদল লোককে ইরানের একটি সুপরিচিত স্বাধীনতার গান “সার উমাদ জেমেস্তুন” (শীত শেষ হয়েছে) গাইতে শুনেছি। আমি কণ্ঠস্বর অনুসরণ করে বার্লিনের কেন্দ্রস্থলে ইরানিদের একটি সমাবেশ আবিষ্কার করি। এই ব্যক্তিদের বেশিরভাগই স্বাধীন ইরানের আশায় এখনো জন্মভূমি বঞ্চিত বার্লিনে বসবাসকারী।
বেশি ঝুঁকির কারণে ইরানে না ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলায় আমার জার্মানিতে নির্বাসিত ইরানি সম্প্রদায়ে যোগ দিতে বেশি সময় লাগেনি। তারপর থেকে আমি দেশ ছেড়ে পালিয়ে এসে বিভিন্ন অভিবাসন মর্যাদায় জার্মানিতে বসবাসকারী ইরানিদের সাথে দেখা করেছি।
তবে সংকটময় মুহুর্তে বিদেশ থেকে শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে তারা স্বেচ্ছায় ইরানে যাওয়ার অধিকার ত্যাগ করেছে। অন্যথায় শাসকগোষ্ঠী কর্মকাণ্ড চালিয়ে গেলে তারা নিষ্ক্রিয় থাকতে বাধ্য হতো, অথবা ইরানে পা রাখার সাথে সাথেই নিজেদের গ্রেপ্তারের ঝুঁকিতে ফেলতো।
আমিসহ অনেক ইরানিদের ক্ষেত্রে নির্বাসন কখনোই আইনি প্রক্রিয়ার বিষয় ছিল না; আমার নিরাপত্তা, সাংবাদিকতা ও সুশীল সমাজের কর্মী হিসেবে কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্যে আমি স্বদেশে ফিরে যাওয়ার অধিকার ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তবে বৃহত্তর পরিস্থিতি বিবেচনা না করা এটিকে আমরা কি সত্যিই একটি পছন্দ বলতে পারি?
ইরানের চিরবিবর্তিত গল্প
আমি অন্যান্য নারী আন্দোলন কর্মীদের সাথে শুধু শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে অংশগ্রহণের জন্যে ২০০৭ সালে ২৫ বছর বয়সে তেহরানের কুখ্যাত এভিন কারাগারে কিছু রাত কাটিয়েছিলাম। ঘন্টার পর ঘন্টা জিজ্ঞাসাবাদের পর শেষ পর্যন্ত আদালতের বিচারে গড়ানোর পরে আমি আর কোন প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন না হলেও এই অভিজ্ঞতা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের বিষয়ে ইসলামি প্রজাতন্ত্রের অবস্থানের একটি প্রখর স্মারক হিসেবে কাজ করেছে। হাস্যকরভাবে সমালোচনা ও বিতর্কের জন্যে অপেক্ষাকৃত উন্মুক্ত বিবেচিত তথাকথিত সংস্কারপন্থী মোহাম্মদ খাতামি রাষ্ট্রপতি হওয়ার অব্যবহিত পরেই এটি ঘটে।
তেহরানের শাসকগোষ্ঠী ইন্টারনেটের প্রতিপক্ষতা ও সাংবাদিকদের কারাগারে রাখায় নিজের শীর্ষস্থান ধরে রাখার কোনো প্রচেষ্টাই ছাড়েনি। তবে সবাই ইরান ছেড়ে যাওয়াটা পছন্দ করে না।
সেন্সর ও ক্রমাগত গ্রেপ্তার ও হয়রানির হুমকি সত্ত্বেও আমার অনেক সহকর্মী দেশেই রয়েছে। সাহসের সাথে মাহসা জিনা আমিনির হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রতিবেদনকারী এরকমই দু’জন সাংবাদিক নিলুফার হামেদি ও এলাহে মোহাম্মদি, যারা বেশ কয়েকটি ভিত্তিহীন অভিযোগে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে কারাগারে রয়েছে।
মাহসা জিনা আমিনির হত্যাকাণ্ড দেশব্যাপী “নারী, জীবন, স্বাধীনতা” বিদ্রোহের সূচনা করে। বিক্ষোভের পরিমাণ কমে এলেও ইরানের বিভিন্ন শহরে নারীদের প্রতিদিনের প্রতিরোধ অব্যাহত রয়েছে।
গুরুতর পরিণতির সম্ভাবনা সত্ত্বেও তারা হিজাব না পরে তাদের ভিন্নমত প্রকাশ করে। তাদের কর্মকাণ্ড ইতিমধ্যে সমাজে শাসকগোষ্ঠীর ভঙ্গুর ভিত্তিকে নাড়া দেওয়া ছাড়াও তাদের গৌণ মর্যাদা দেওয়া গভীর ঐতিহ্যগত ও আদর্শিক নিয়মাবলীকে চ্যালেঞ্জ করেছে। এই কারণে এমনকি ইরানি শাসকগোষ্ঠীর বিরোধীদের কিছু অংশও “নারী, জীবন, স্বাধীনতা”কে বেশি প্রগতিশীল বিবেচনা করে।
ইরানের সাহসী নারীদের কর্মকাণ্ড আমাকে বার্লিনে স্বেচ্ছানির্বাসনে থাকা বহু প্রজন্মের ইরানি নারীদের গল্প শোনাতে অনুপ্রাণিত করেছে। এই নারীরা আমার নির্বাসিত গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ছাড়াও “যথেষ্ট হয়েছে” ঘোষণা করার জন্যে ইরানি নারীদের কষ্টকর যাত্রার বিস্তৃত বর্ণনার ভিত্তি হিসেবেও কাজ করে।