ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু ১১ আগস্ট, ২০২৩-এ বেশ কয়েক বছর ধরে তৈরি ভারতের ডেটা সুরক্ষা আইন ডিজিটাল ব্যক্তিগত ডেটা সুরক্ষা, ২০২৩ আইনে স্বাক্ষর করেছেন৷ তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী এটিকে “বৈশ্বিক মানের সাইবার আইন কাঠামোর একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক” এবং মেটা'র ভারতীয় প্রধান এটিকে “উদ্ভাবনের সাথে ব্যবহারকারী সুরক্ষার ভারসাম্য বজায় রাখার একটি মহান পদক্ষেপ” বলে অভিহিত করলেও সুশীল সমাজের সংগঠনগুলি খসড়া আইনটির চূড়ান্ত আকার নিয়ে ততোটা খুশি নয়। প্রতিক্রিয়াগুলির ভিন্নতা বোঝার জন্যে বর্তমান আকারের দিকে খসড়া আইনটিকে পরিচালিত পরিস্থিতিটিতে ফিরে যাওয়া দরকার।
বীজটি হলো আধার
ভারতে ডেটা সুরক্ষা নিয়ে আলোচনাটি গত দশকের মাঝামাঝি সময়ে (২০০৯ সালে প্রথম চালু) সরকারের তৈরি বায়োমেট্রিক সনাক্তকরণ সরঞ্জাম আধারের প্রেক্ষাপটে রূপ নিতে শুরু করে। তবে আধারের প্রাথমিক বিবৃত ব্যবহার ছিল কল্যাণমূলক প্রকল্পগুলিতে প্রবেশের জন্যে ভারতের প্রতিটি বাসিন্দার একটি অনন্য পরিচয় যা স্কুলে ভর্তি থেকে কর জমাদান পর্যন্ত সমস্ত কিছুতে বাধ্যতামূলকভাবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। এটি প্রতিটি বাসিন্দাকে অনুসরণ করার সরকারের স্থাপিত একটি বিস্তৃত নজরদারি ব্যবস্থা এমন একটি ভয়কে উস্কে দেয়। উপরন্তু, ব্যবহার নিয়ন্ত্রণকারী আইন দিয়ে আধার সংগৃহীত ডেটা সুরক্ষিত করার আগে এটির ব্যবহারের অনেক সম্প্রসারণ ঘটে।
এমনকি (আধার বাধ্যতামূলক ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে) ২০১৬ সালে একটি আধার আইন পাশের পরেও ভারতের সাংবিধানিক আদালতে আধারের ব্যাপক বাধ্যতামূলক প্রয়োজনীয়তার জন্যে সাংবিধানিক ও আইনি চ্যালেঞ্জের একটি ধারাবাহিক তৈরি হয়। চ্যালেঞ্জের প্রাথমিক ভিত্তি হলো আধারের সাংবিধানিকভাবে সুরক্ষিত গোপনীয়তার অধিকারের লঙ্ঘন, যদিও সরকারের দাবি সংবিধানের মৌলিক অধিকার অধ্যায়ে তালিকাভুক্ত নয় বলে সংবিধান এই ধরনের কোনো অধিকারের নিশ্চয়তা দেয় না।
শেষ পর্যন্ত ২০১৭ সালে সর্বোচ্চ আদালতের একটি নয়-বিচারকের বেঞ্চ বলেছে প্রকৃতপক্ষে সংবিধানের গোপনীয়তার একটি অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে, যার একটি দিক “তথ্যগত গোপনীয়তা” যা সরকার ও ব্যক্তিগত উভয় সংস্থার ক্ষেত্রেই দাবি করা যেতে পারে। আদালত স্বীকার করেছে আইনের আরোপিত বিধিনিষেধের মাধ্যমে এবং আনুপাতিকভাবে কিছু বৈধ উদ্দেশ্যে এই অধিকার সীমাবদ্ধ করা যেতে পারে। আদালত আরো উল্লেখ করেছে ডিজিটাল যুগে একটি সাধারণ ডেটা সুরক্ষা আইন (আধার আইন থেকে পৃথক) সময়ের দাবি।
আইনটির খসড়া তৈরির বিশেষ কমিটি
আদালতের পর্যবেক্ষণের জবাবে সরকার ২০১৭ সালে ভারতে তথ্য সুরক্ষার জন্যে একটি খসড়া আইন প্রস্তুতে ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের অবসরপ্রাপ্ত বিচারক বি.এন. শ্রীকৃষ্ণের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে। কমিটির ২০১৮ সালে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে ভারতে ডেটা সুরক্ষা ও ভারতের বাইরে ডেটা স্থানান্তর পরিচালনার আইনি ও নিয়ন্ত্রক কাঠামোর রূপরেখা দেওয়া খসড়া ডেটা সুরক্ষা আইন অন্তর্ভুক্ত ছিল।
সরকার কমিটির সুপারিশগুলিকে বহুলাংশে গ্রহণ করলেও ডিসেম্বর ২০১৯-এ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কমিটির সুপারিশ থেকে আলাদা বিশেষত এই আইন থেকে সরকারের ছাড় সম্বলিত ডেটা সুরক্ষা আইনের একটি খসড়া প্রবর্তন করে। আরো এক দফা আলোচনা ও বিতর্কের জন্যে খসড়া আইনটি (ভারতের সংসদের উভয় কক্ষের নির্বাচিত সদস্যদের সমন্বয়ে খসড়া আইনটি আরো বিশদভাবে অধ্যয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত) যৌথ সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো্র পরে ২০২১ সালে আরো পরিবর্তনসহ সংসদে ডেটা সুরক্ষা আইনের আরো একটি খসড়া চালু করা হয়। এই খসড়াটিও গোপনীয়তা সম্পর্কে খুব কম যত্নবান ও রাষ্ট্রীয় নজরদারি চালুর বিষয়ে অনেক কিছু করার এবং বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলি থেকে ডেটা স্থানীয়ভাবে সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক করার বিধানের জন্যে নাগরিক সমাজের সমালোচনার মুখোমুখি হয়।
তবে ২০২২ সালের আগস্টে এক মাসের মধ্যে একটি নতুন আইন চালুর প্রতিশ্রুতি দিয়ে সরকার হঠাৎ করে এই খসড়া আইনটি সংসদ থেকে প্রত্যাহার করে নেয়। অবশেষে ডেটা সুরক্ষা আইনের চতুর্থ সংস্করণ নতুন এই খসড়া আইন ডিপিডিপি আইন নামে পাস করা হয়েছে।
শেষ পর্যন্ত ভারত কি একটি ভাল তথ্য সুরক্ষা আইন পেয়েছে?
সরলভাবে পড়লে ডিপিডিপি আইনটিকে যোগ্যই মনে হয়। এটি “ডেটা অভিভাবক” (ব্যক্তিদের কাছ থেকে ডেটা সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকারী) একটি “ডেটা প্রিন্সিপাল” (যে ব্যক্তির ডেটা সংগ্রহ করা হচ্ছে) এর ডিজিটাল ব্যক্তিগত ডেটা ব্যবহারের আগে নোটিশ দিয়ে “মুক্ত, নির্দিষ্ট, অবহিত, শর্তহীন ও দ্ব্যর্থহীন” সম্মতি নিতে বাধ্য করে। এটি ডেটা প্রিন্সিপালের ডেটা মুছে ফেলা ও অভিযোগের প্রতিকার চাওয়ার মতো চারটি অধিকার তালিকাভুক্ত করে ডেটা অভিভাবকদের উপর বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে।
তবে খসড়া আইনটি সম্পর্কে সুসংবাদের সমাপ্তি এখানেই।
ডিপিডিপি আইন শক্তিশালী নিয়ন্ত্রকের অনুপস্থিতি ও আইনের বিধান থেকে সরকারের নিজেকে অব্যাহতি দেওয়ার ব্যাপক ক্ষমতার মতো দুটি খুব বড় ব্যর্থতার শিকার। ডিপিডিপি ডেটা প্রিন্সিপালের অধিকার ও ডেটা অভিভাভবকদের দায়িত্বগুলি নির্ধারণ করলেও এটি এই অধিকার ও কর্তব্যগুলির প্রয়োগকে প্রভাবিত ব্যক্তিদের উপর ছেড়ে দেয়। ডেটা নিয়ন্ত্রক (ভারতের একটি ডেটা সুরক্ষা কর্তৃপক্ষ) কল্পনা করা আইনটির খসড়া সংস্করণের বিপরীতে বর্তমান সংস্করণটি বৃহৎ প্রযুক্তি কোম্পানিগুলির ডেটা সংগ্রহ ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের প্রবিধান তৈরির বা কোম্পানিগুলির উপর আইনের আদেশ কার্যকর করার ক্ষমতাহীন মূলত একটি নখদন্তহীন সংগঠন – ডেটা সুরক্ষা বোর্ড (ডিপিবি) – সরবরাহ করে। সর্বোপরি, এটি ডেটা প্রিন্সিপালদের অভিযোগ শুনতে পারলেও একটি বড় প্রযুক্তি সংস্থার বিরুদ্ধে নিজস্ব আদেশ বা নির্দেশাবলী প্রয়োগের ক্ষমতা কম। বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলি এই নখদন্তহীন ডিপিবির কোনো পদক্ষেপের জন্যে বিনিদ্র রাত কাটাতে চলেছে।
কাকে নিয়োগ করা উচিত সে সম্পর্কে সরকারের বাইরের কারো কোনো পরামর্শ ছাড়াই শুধু সরকারের নিযুক্ত ব্যক্তি ও কর্মীপূর্ণ এই ডিপিবি। এটি সরকারকে একজন নিযুক্ত ব্যক্তির যোগ্যতা কী হওয়া উচিত ও তাদের নিয়োগের প্রক্রিয়া সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেয়, যা ডিপিবিকে মূলত একটি স্বাধীন সংস্থা হতে বাধা দেয়।
এটি আইনটির সাথে আমাদের কাছে গণনজরদারি পরীক্ষা করার মতো কিছু সরবরাহের সম্পূর্ণ অক্ষমতাসহ আরো বড় বড় সমস্যা নিয়ে আসে। ডেটা সুরক্ষা আইনের পূর্ববর্তী সংস্করণগুলি যথেষ্ট না করার জন্যে সমালোচিত হলেও ডিপিডিপি আইন “ভারতের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা বজায় রাখা বা এইগুলির যেকোন একটির সাথে সম্পর্কিত যেকোন অপরাধের জন্যে উস্কানি রোধ করা”র স্বার্থে সরকারকে যেকোনো সরকার, সরকারি সংস্থা বা রাষ্ট্রীয় উপকরণকে (সরকারি খাতের উদ্যোগ, সরকার নিয়ন্ত্রিত সংস্থা ও অনুরূপ সত্ত্বাসহ) ঢালাও ছাড় দেওয়ার ক্ষমতা দেয়। এই ধরনের বিস্তৃত ক্ষমতা পদ্ধতিগতভাবে বা উপাদানগতভাবে অনিয়ন্ত্রিত।
ডিপিডিপি আইন তার বর্তমান আকার ও আকৃতিতে বড় প্রযুক্তি কোম্পানি বা রাষ্ট্র থেকে ডেটা প্রিন্সিপালদের তথ্যগত গোপনীয়তা রক্ষায় খুবই অপ্রতুল। একটি উদার সংবিধান, গণতান্ত্রিক শাসনের দীর্ঘ ইতিহাস ও অনলাইন ব্যবহারকারীদের একটি বৃহৎ জনসংখ্যাসহ একটি জাতি হিসেবে ভারতের কাছে ডেটা সুরক্ষার বিষয়ে কথোপকথনকে নতুন সীমান্তে বিশেষ করে বেশ দর্শনীয়ভাবে বৈশ্বিক দক্ষিণের নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ থাকলেও বলাইবাহুল্য সেই সুযোগ হাতছাড়া করেছে।
অলোক প্রসন্ন কুমার আইনি নীতির জন্যে বিধি কেন্দ্রের সহ-প্রতিষ্ঠাতা। বিধি আধার আইনের খসড়া তৈরিতে সরকারকে সহায়তা করেছে এবং বিচারপতি বি.এন. শ্রীকৃষ্ণ কমিটি্র প্রতিবেদন তৈরি করছে। তিনি সর্বোচ্চ আদালতে অনুশীলনরত একজন আইনজীবী যিনি আধার মামলার প্রাথমিক পর্যায়ে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে হাজির হয়েছেন।