বাংলাদেশে ডেঙ্গু ভয়ংকর হয়ে উঠছে

একটি স্ত্রীলিঙ্গের এডিস মশা মানুষের চামড়া থেকে রক্ত চুষে নিচ্ছে। র'পিকজেল থেকে নেয়া। মূল ছবি: পাবলিক হেলথ ইমেজ লাইব্রেরি, সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন। মার্কিন আইন অনুযায়ী এই ছবিটি কপিরাইট মুক্ত।

একটি স্ত্রীলিঙ্গের এডিস মশা মানুষের চামড়া থেকে রক্ত চুষে নিচ্ছে। র'পিকজেল থেকে নেয়া। মূল ছবি: পাবলিক হেলথ ইমেজ লাইব্রেরি, সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন। মার্কিন আইন অনুযায়ী এই ছবিটি কপিরাইট মুক্ত।

বাংলাদেশে ডেঙ্গু ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। আগস্ট মাসের ৯ তারিখ পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৩৫২ জন – যা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের অধীনে ডিজিএইচএস এর তথ্য অনুসারে, জুলাই মাসে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে ৪৩,৮০০ জনের বেশি – যেখানে জুন মাসে ৫,৯০০ আক্রান্তের সংখ্যা রেকর্ড করা হয়েছিল। চলতি আগস্ট মাসেও ডেঙ্গু দাপট দেখিয়ে চলছে।

যদিও একসময় ডেঙ্গুকে মৌসুমী রোগ বলে মনে করা হতো। আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসকে ডেঙ্গুর মৌসুম বলে ধরা হতো। কিন্তু কয়েক বছর ধরে বছরজুড়েই এর প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। ডেঙ্গু আক্রান্তের (হাসপাতাল ও বাসায়) কোন সুনির্দিষ্ট সংখ্যা পাওয়া দুষ্কর, তবে বায়োমেডসেন্ট্রাল (বিএমসি) জার্নালে প্রকাশিত একটি সমীক্ষা থেকে জানা যায় যে সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে বছরে ২৪ লাখের মত জনসংখ্যা ডেঙ্গু আক্রান্ত হতে পারে।

উল্লেখ্য, ডেঙ্গু ভাইরাস এডিস প্রজাতির বিভিন্ন প্রজাতির স্ত্রী মশার কামড়ের মাধ্যমে ছড়ায়। সাধারণত, ডেঙ্গু রোগের উপসর্গ প্রকট থাকে না বা দৃশ্যমান হয়না এবং দুই সপ্তাহের মধ্যে ভালো হয়ে যায় কারণ এর কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। যাইহোক, সম্ভাব্য মশার প্রজনন স্থানগুলি (যেমন পাত্রে স্থির জল) ধ্বংস করা এবং মশা নিরোধক কীটনাশক প্রয়োগ এবং মশারি ব্যবহার সহ ব্যক্তিগত সতর্কতা অনুশীলনের মাধ্যমে এর বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।

দীপু মাহমুদ লেখক। দিনকয়েক আগে তার ছেলে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। হাসপাতালে গিয়ে দেখেন, কোনো সিট ফাঁকা নেই। সব হাসপাতাল ডেঙ্গু রোগীতে ভর্তি। এরকম অভিজ্ঞতা শুধু উনার একার নয়। বাংলাদেশের নাগরিকদের ফেসবুক খুললেই হাসপাতালে সিট ফাঁকা না থাকার এরকম অসংখ্য স্ট্যাটাস চোখে পড়বে।

কেন ভয়ংকর রূপ নিলো ডেঙ্গু

বাংলাদেশে প্রথম ডেঙ্গু শনাক্ত হয় ১৯৬৫ সালে। তখন এটি ঢাকা ফিভার নামে পরিচিত ছিল। ২০০০ সালের পর থেকে রোগটির সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে। কিন্তু এবার কেন এতো ভয়ংকর হয়ে উঠলো?

২০২৩ সালে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব (১১ই আগস্ট পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি রুগীর সংখ্যা অনুযায়ী)।

২০২৩ সালে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব (১১ই আগস্ট পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি রুগীর সংখ্যা অনুযায়ী)। ছবি জিসান তারিকের – উইকিপিডিয়া থেকে নেয়া। সিসি বাই ৪.০ লাইসেন্সের আওতায় প্রকাশিত।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এই বছর অস্বাভাবিক পরিমাণে বৃষ্টিপাত হয়েছে এবং সাথে ছিল অত্যাধিক তাপমাত্রা এবং উচ্চ আর্দ্রতা – যা ডেঙ্গু রুগীর সংখ্যা বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বছরের শুরুতেই সতর্কবার্তা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু নিয়ন্ত্রণে খুবই গতানুগতিক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। যা যথেষ্ট ছিল না। আবার মশা দমনে যেসব ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বা ঔষধ ব্যবহার করা হচ্ছে, সেগুলোর কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। সব মিলিয়ে ডেঙ্গু এবার এতো ভয়ংকর হয়ে উঠেছে যা সামলাতে সবাই হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে

তাছাড়া চলতি বছর ডেঙ্গুর সবচেয়ে ক্ষতিকর ধরনগুলোর মধ্যে অন্যতম ডেনভি-৩ এর মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষ বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। ডেঙ্গুর এই ধরনের কারণে দ্রুত রোগীদের রক্তের প্লাটিলেট কমে যাচ্ছে। সে কারণে আক্রান্ত ব্যক্তিরা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ায় হাসপাতালে নিতে হচ্ছে। তাছাড়া এবার যে সেরোটাইপ দিয়ে এবারে ডেঙ্গু হচ্ছে, তার ভিরুলেন্স বা সংক্রমণ ক্ষমতা অনেক বেশি। আক্রান্ত হওয়ার দুই-তিনদিনের মধ্যে মারা যাচ্ছেন।

ঢাকার মাতুয়াইলে শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের স্ত্রী ও প্রসুতি রোগ বিভাগের চিকিৎসক ছিলেন দেওয়ান আলমিনা। তিনি ডেঙ্গু এনসেফালাইটিসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তার বয়স ছিল মাত্র ৩২ বছর। অনেক চেষ্টা করেও তাকে বাঁচানো যায়নি। তার স্বামীও চিকিৎসক। মশা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব ঢাকা সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষের। তারা ঠিকমতো দায়িত্ব পালন না করায় স্ত্রীকে হারাতে হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন:

এক মশার কামড়ে আমার পুরো পরিবার তছনছ হয়ে গেল। বাচ্চাগুলো এতিম হলো। ওদের যে বয়স, বড় হতে হতে মায়ের স্মৃতি বলে আর কিছুই থাকবে না। কেউ তো আর ওদের মায়ের অভাব পূরণ করতে পারবে না। আমার জীবনটাও ওলটপালট হয়ে গেল। মশা না থাকলে তো এটা হতো না।’

ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। হাসপাতালগুলোতে সিট হচ্ছে না। তাদের মেঝেতে থাকতে হচ্ছে জানিয়ে ডেইলি স্টার টুইট করেছে:

এদিকে গতকাল (আগস্ট ৮, ২০২৩) সকাল পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে ২,৭৪২ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, যার ফলে মোট ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ৭২,২২৫ এ দাঁড়িয়েছে।

মশাও আচরণ বদলাচ্ছে

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ কবিরুল বাশারের করা ‘অ্যাডাপশন অব এডিস এজিপ্টি মসকিউটো লার্ভা ইন সুয়ারেজ, সি, ব্র্যাকিশ অ্যান্ড ড্রেইন ওয়াটার: আ নিউ চ্যালেঞ্জ ফর ডেঙ্গু কন্ট্রোল’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ডেঙ্গুবাহী এডিস মশার আচরণ বদলানোর কথা। মশা আগে দিনের শুরু ও সন্ধ্যায় কামড়ালেও নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, এডিস মশা এখন রাতেও কামড়াচ্ছে। যদিও রাতে কামড়ানোর হার কম। এ মশা আগে স্বচ্ছ পানিতে ডিম পাড়তো, এখন ময়লা পানিতেও ডিম পাড়ছে।

মশার আচরণ বদলাতে শহরের আলোক দূষণও দায়ী বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। আগে মানুষ এতো উজ্জ্বল আলো ব্যবহার করতো না। এখন আধুনিক জীবনে বেশি আলো ব্যবহার করা হচ্ছে। তাছাড়া, এডিস মশার ঘনত্বও বেড়ে গেছে। শহরে, গ্রামে প্যাকেটজাত খাবার ও বোতলজাত পানীয়ও জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির ফলে প্রচুর বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। এসব বর্জ্যরে সঠিক ব্যবস্থা করতে না পারার কারণে বৃষ্টির পানি জমে এডিস মশার প্রজননক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। ফলে ডেঙ্গুবাহী এডিস মশা বেড়েছে।

২০২৩ সালে করা ‘ইনসেকটিসাইড রেজিস্ট্যান্স কমপ্রোমাইসেস দ্য কন্ট্রোল অব এডিস এজেপ্টি ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণায় ঢাকার এডিস মশার কীটনাশক প্রতিরোধী হয়ে উঠছে বলে জানা গেছে। গবেষণায় বোতলজাত কীটনাশক প্রয়োগের পর ৭৪ শতাংশ পর্যন্ত উড়ন্ত ও বিশ্রাম নেয়া মশা বেঁচে থেকেছে।

এদিকে এডিস মশার আচরণ পরিবর্তনের পাশাপাশি পরিবর্তন এসেছে ডেঙ্গুর লক্ষণেও। চিকিৎসকরা বলছেন, আগে ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তি প্রচন্ড জ্বর নিয়ে হাসপাতালে আসতো। কিন্তু এখন জ্বর কম থাকলেও গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গে শক বেশি হতে দেখা যাচ্ছে। বেড়েছে মৃতের সংখ্যাও। আবার ডেঙ্গুকে শহরের রোগ ধরা হলেও এখন গ্রাম-গঞ্জেও ছড়িয়ে পড়ছে। এবছর দেশের ৬৪টি জেলা থেকেই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে রোগীরা হাসপাতালে আসছেন।

ডেঙ্গু ভয়াবহ হয়ে উঠার পিছনে সিটি কর্পোরেশনে মশা নিধন কার্যক্রমের ব্যর্থতাকে দায়ী করা হলেও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা এবং ব্যক্তিগত সচেতনতা সহ কর্তৃপক্ষের একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা এই মহামারী মোকাবেলায় প্রয়োজন।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .