ইরানে স্কুলছাত্রীদের ওপর গ্যাস হামলায় সন্দেহভাজন রাষ্ট্র

ইরানের ইয়াজদ জামেহ মসজিদে স্কুলের মেয়েরা। স্তেফানো ভিগোরেলির ২০১৪ সালে তোলা ছবি, সৃজনী সাধারণ একইরকম ভাগাভাগি ৪.০ অনুমতির অধীনে ব্যবহৃত।

ইরানে প্রায় এক বছর ধরে চলা নারীবাদী বিপ্লব ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ২১ বছর বয়সী কুর্দি নারী জিনা মাহসা জিনা আমিনির নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর গতি পায়৷ এই বিক্ষোভগুলি ইসলামি প্রজাতন্ত্রের ইতিহাসে ব্যাপক ধর্মঘট ও নাগরিক অবাধ্যতাসহ ইরানের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় ও জঙ্গি বিক্ষোভে পরিণত হয়েছে৷

শাসকগোষ্ঠী উল্লেখযোগ্য চাপের মুখে পড়ে বিক্ষোভে তীব্রতার সাথে সাথে দমন ও বর্বরতার প্রচারণা বাড়িয়েছে। স্কুল ছাত্রীদের গ্যাস প্রয়োগের সাম্প্রতিক ঘটনাটি দেশজুড়ে বিভ্রান্তি, আতঙ্ক ও সন্ত্রস্ততার জন্ম দিয়েছে। জনগণ প্রদর্শিত অবিরাম প্রতিরোধের সাথে তাল মিলিয়ে শাসকগোষ্ঠীর প্রতিক্রিয়ায় অনেককে শাসকগোষ্ঠীর দিন ফুরিয়ে আসার কথা ভাবার দিকে পরিচালিত করেছে।

বিষাক্ত গ্যাসে স্কুলছাত্রীদের বিষক্রিয়া

আল্লামেহ তাবাতাবা'ই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ইরানি স্কুলছাত্রীদের গণবিষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে, ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩। শিক্ষার্থী সংবাদ এজেন্সির ছবি, সৃজনী সাধারণ ৪.০ অনুমতির অধীনে ব্যবহৃত।

ইরানে স্কুলের মেয়েদের উপর হামলাটি বিশেষ করে সাম্প্রতিক বিক্ষোভগুলিতে পালনকৃত নারী ও অল্পবয়সী মেয়েদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বিবেচনা করে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষার দাবি রাখে। আংশিকভাবে এই কারণেই মেয়ে ও নারীরা এখন শাসকগোষ্ঠীর বিশেষ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত

ইরানের মানবাধিকার সংস্থাগুলি জানিয়েছে ৭,০০০ এরও বেশি স্কুল ছাত্রী ইরানের স্কুলগুলির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ঢেউ-সদৃশ গণ গ্যাস হামলায় আক্রান্ত হয়েছে। গত বছরের নভেম্বরে শুরু হওয়া এই হামলাগুলো দেশের ২৮টি প্রদেশের অন্তত ৯৯টি স্কুলে হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত মাত্র একদিনেই ৮১টির মতো হামলা নথিভূক্ত হয়েছে।

সিএনএনের একটি প্রতিবেদন অনুসারে সরকারি কর্মকর্তারা গ্যাস হামলাগুলি চেপে যেতে চেষ্টা করে। একদিকে শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষার্থীদের বিষক্রিয়ার জন্যে শিক্ষার্থীদের নিজেদেরই দোষারোপ করেছেন, অন্যদিকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী দাবি করেছেন “গ্যাসের আক্রমণ নয়, ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই লক্ষণগুলি ছিল মানসিক ও আবেগগত উত্তেজনার ফলাফল।”

সরকারের উদাসীনতায় স্কুলছাত্রীদের পরিবাগুলির ব্যাপক ক্ষোভ ও প্রতিবাদের ফলে সৃষ্ট চাপ বিরোধীদের উপর দোষ চাপিয়ে শত শত কথিত অপরাধীদের “শনাক্ত ও গ্রেপ্তার” করার দিকে শাসকগোষ্ঠীকে ঠেলে দিয়েছে।

তবে গত বছর থেকে এই আক্রমণগুলি চলমান থাকার বাস্তবতা, তাদের পরিধি, বিস্তারের সাথে সাথে দেশের স্কুলগুলিতে উচ্চ-নিরাপত্তা ব্যবস্থা ইঙ্গিত করে সরকার এই ঘটনায় জড়িত বা জড়িত থাকতে পারে।

জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা ইরানে অল্পবয়সী মেয়েদের লক্ষ্যবস্তু করে বড় আকারের সমন্বিত হামলার জন্যে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত ও গ্রেপ্তার করতে শাসনের আপাত অক্ষমতার বিপরীতে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে তাদের দ্রুত পদক্ষেপের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে শাসকদের জড়িত থাকার ইঙ্গিত দিয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার (ওএইচসিএইচআর) কার্যালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে:

আমাদের শঙ্কা তারা মেয়েদের নারী, জীবন, স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িত থাকা এবং বাধ্যতামূলক হিজাবের বিরোধিতা এবং সমতার দাবিতে সোচ্চার হওয়ায় তাদের শাস্তি সমন্বিত করা হয়েছে।

ইরানে লিঙ্গ বর্ণবাদ

ইরানের একটি শহরের চত্বরে নারীরা। অজ্ঞাতনামার তোলা ছবিসৃজনী সাধারণ০ ১.০ সার্বজনীন প্রকাশ্য ডোমেন অনুমতির অধীনে উইকিমিডিয়া সাধারণ

ইরান গভীরভাবে লিঙ্গ বর্ণবিদ্বেষে নিমজ্জিত, যা নারী জীবনের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। আইনের মাধ্যমে নারীর উপর পুরুষের আধিপত্য বজায় রাখে। এই পদ্ধতিগত লিঙ্গ বৈষম্য বিভিন্ন বৈষম্যমূলক চর্চায় প্রকাশিত। উদাহরণস্বরূপ, ৫ বছর বয়সে বাল্যবিবাহ এবং বিভিন্ন বয়সের অপরাধমূলক দায়িত্বের জন্যে মেয়ে ও ছেলেদের মধ্যে বৈষম্য তুলে ধরে। নাগরিক আইনে পরিবারের প্রধান হিসেবে পুরুষদের দেওয়ায় মায়েরা প্রায়ই হেফাজত হারায় এবং আদালতে অসম আচরণের শিকার হয়। উত্তরাধিকার আইন, পাসপোর্টের অনুমতি, পেশাগত বিধিনিষেধ, বিবাহবিচ্ছেদের প্রয়োজনীয়তা, বৈবাহিক ধর্ষণের স্বীকৃতির অভাব ও  চাপিয়ে দেওয়া নির্ধারিত পোশাক লিঙ্গ বৈষম্য এবং নারীর প্রতি চিরস্থায়ী বৈষম্য বৃদ্ধিতে অবদান রাখে।

এই বৈষম্য ইরানের অল্প-বয়সী নারীদের আইনের অধীনে মৌলিক সার্বজনীন অধিকার ও সমতার দাবির দিকে পরিচালিত করেছে। শুধু শাসকগোষ্ঠী পরিবর্তনের মাধ্যমেই এই অধিকারগুলি অর্জন করার ব্যাপারে জনগণের মধ্যে একটি বিস্তৃত ঐকমত্য থেকে তাদের উদ্দেশ্যের প্রতি সমর্থন ব্যাপক বলে মনে হচ্ছে।

যা দাঁড়িয়েছে তা হলো অন্তত বিগত ২৫ বছর ধরে শাসকগোষ্ঠীর রাজনীতিকে সংজ্ঞায়িত ইরানের জনগণের আর সংস্কারবাদী-রক্ষণশীল দ্বিধাবিভক্তিতে বিশ্বাস নেই। পরিবর্তে জনগণ সমগ্র শাসনব্যবস্থা ও এর ব্যবস্থা – ধার্মিক শিয়া আইনবিদদের মুসলমান বিশ্বের “ধর্মীয় ও সামাজিক বিষয়াবলী” পরিচালনা নির্দেশ করার “বেলায়ত-ই ফকিহ” (“ফকীহের অভিভাবকত্ব”) ধারণার সম্পূর্ণ বিলুপ্তির দাবি করছে।

কার্টুনশিল্পী কিয়ানুশ রামাজানি ব্যবস্থাটিতে বিশ্বাস হারানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন:

এই শীতে ইরানিরা জানে কীভাবে নিজেদের উষ্ণ রাখতে হয়! #মাহসাআমিনি #ইরানবিপ্লব #مهسا_امینی

এই উপসংহারটি সহিংস ভিন্নমত দমন ও ভীতি প্রদর্শন করা শাসকদের ক্রমবর্ধমান হতাশার একটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা প্রদান করে। গ্যাস হামলাগুলি জবাবদিহি দাবিকারীদের চুপ করিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য সাধন করেছে। তাছাড়া এটিও বিবেচনা করা দরকার গ্যাস হামলার মতো একটি সংকট দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটের মতো অন্যান্য বিপর্যয়কর বিষয়গুলি থেকে মনোযোগ সরাতে সহায়তা করে।

নারী ও মেয়েদের প্রতিরোধ ইরানের শাসকগোষ্ঠীর একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার প্রতিনিধিত্ব করে। নিজেরাই ধরা_খাওয়া-২২ পরিস্থিতিতে ফেঁসে গিয়ে লিঙ্গ বর্ণবৈষম্যের উপর তাদের অস্তিত্বের সম্পূর্ণ বিবরণের উপর নির্ভরশীলতার কারণে তারা আর এতে ছাড় দিতে পারছে না। ইতোমধ্যে নারীরা এমন একটি পর্যায়ে প্রবেশ করেছে যেখানে পাশে থাকা পুরুষদের সমর্থনসহ তাদের অবিচল ও নির্ভীক বলে মনে হচ্ছে।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে ইরানের সন্ত্রাসী প্রচারণা দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিস্তৃত। ইরান তার নৃশংস সহিংসতা নথিভুক্ত বা প্রতিবেদন করতে পিছপা হয় না; প্রকৃতপক্ষে, শাসকগোষ্ঠী ভয় ছড়িয়ে দিতে ও বৃহত্তর প্রভাব তৈরির জন্যে এটি দিয়ে আচ্ছাদিত করতে চায়।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ইরানের জনগণকে তাদের চলমান বিপ্লবে সমর্থন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বহির্বিশ্ব ইরানের মানবতাবিরোধী অপরাধের নিন্দা না করা পর্যন্ত নীরবে এই অপব্যবহার চলতেই থাকবে।

তবে মৌলিক প্রশ্ন থেকে যায়: ভেঙ্গে পড়ার না পর্যন্ত কতোক্ষণ শাসকগোষ্ঠী জনগণের উপর অত্যাচার করতে পারে? আর কতোকাল এধরনের অত্যাচার সহ্য করা যায়?

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .