ভারতের আসাম পুনর্বিন্যস্ত নির্বাচনী এলাকা নিয়ে বিশাল বিক্ষোভের সাক্ষী

Muslim Population in Assam based on district maps and census of India 2011. Image via Wikipedia by SPQR10. CC BY-SA 4.0.

ভারতের ২০১১ সালের আদমশুমারি ভিত্তিক আসামের মুসলমান জনসংখ্যা্র জেলা মানচিত্। উইকিমিডিয়া সাধারণের মাধ্যমে পাওয়া এসপিকিউআর১ এর চিত্রসৃজনী সাধারণ অনুমতি একইরকম ভাগাভাগি ৪.০

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের সরকার ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ভারতের নির্বাচন কমিশনকে ১৯৭৬ সাল থেকে সীমানা নির্ধারণের প্রক্রিয়াটি অনিষ্পন্ন থাকায় তার নির্বাচনী এলাকার সীমানা পর্যালোচনা করার অনুরোধ করে। ফলে ২০ জুন, ২০২৩ তারিখে কমিশন আসামের বিধানসভা ও সংসদীয় নির্বাচনী এলাকা সীমাবদ্ধ করার একটি খসড়া প্রস্তাব প্রকাশ করেছে যা বিরোধী দলগুলি থেকে প্রচুর বিরোধের জন্ম দিয়েছে। প্রক্রিয়াটি একটি নির্বাচনী আসনের ভৌগোলিক সীমানা পুনর্নির্মাণ করে জেলাগুলিকে একীভূত করে বা একটি নতুন জেলা গঠনের জন্যে একটি নির্বাচনী আসন যোগ করে। সমালোচকরা অভিযোগ করেছে পরিচালিত প্রক্রিয়াটি মূলত মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলে নির্বাচনী আসন হ্রাস করতে পারে।

বর্তমানে ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) আসাম বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন দখল করে আছে। মূলত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস (আইএনসি) এবং নিখিল ভারতীয় সংযুক্ত গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট (এআইইউডিএফ) মিলে জাতীয় বিরোধী দলগুলি তাদের উদার ও ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থানের জন্যে পরিচিত। এর সাথে আঞ্চলিক দল, রাজ্যর দল পার্টির সাথে অসমিয়া জাতীয়তাবাদের সাথে একটি বামভাবাপন্ন মতাদর্শ মিলে আসাম জাতীয় পরিষদ দৃঢ়ভাবে অসমিয়া জাতীয়তাবাদের পক্ষে সমর্থন করে। সীমানা নির্ধারণ রাজ্যের ক্ষমতাসীন অনেক বিজেপি আইন প্রণেতাদের প্রভাবিত করলেও বিরোধীদের দাবি এটি বিরোধী দলগুলিকে আরো ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

সীমানা নির্ধারণ কী?

নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণের অর্থ হলো প্রতিটি আসনে যাতে সমান সংখ্যক ভোটার থাকে সেজন্যে তাদের পুনর্বিন্যাস করা। সাধারণত আদমশুমারির পরে সীমানা কমিশন আইনের অধীনে গঠিত একটি স্বাধীন সীমানা কমিশন কাজটি করে।

১৯৫১ সালের আদমশুমারির পরে ১৯৫২ সালে প্রথম সীমানা নির্ধারণের প্রক্রিয়াটি সম্পাদিত হয়। পরবর্তীতে ১৯৫২, ১৯৬৩, ১৯৭৩ এবং ২০০২ সালে সারা দেশে আরো চারবার সীমানা নির্ধারণ করা হয়। নিরাপত্তার কারণে ২০০২ সালের সীমানা নির্ধারণে আসাম, অরুণাচল প্রদেশ, মণিপুর ও অরুণাচল প্রদেশকে বাইরে রাখা হয়। ২০২০ সালের  ৬ মার্চ বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার এই চারটি রাজ্য এবং জম্মু ও কাশ্মীরের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের জন্যে কমিশন পুনর্গঠিত করে।

বর্তমানে আসামে ১২৬টি রাজ্য বিধানসভা আসন ও ১৪টি লোকসভা (সংসদীয়) নির্বাচনী এলাকা রয়েছে। সাম্প্রতিক প্রক্রিয়াটি উভয় ক্ষেত্রে জন্যে আসন সংখ্যা পরিবর্তন না করলেও কিছু নির্বাচনী এলাকার পুনর্বিন্যাস ও তফসিলি জাতির জন্যে আসন বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে। আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের সবচেয়ে অনগ্রসর আর্থ-সামাজিক গোষ্ঠী হিসেবে মনোনীত সম্প্রদায় হলো তফসিলি জাতি ও তফসিলি উপজাতি

প্রস্তাবিত সীমানা নির্ধারণ ২০০১ সালের আদমশুমারির ভিত্তিতে করা হয়েছে। অনেকের দাবি রাজ্যে ২০০১ সালের ২৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০১১ সালে ৩৪ শতাংশে উন্নীত মুসলমান জনসংখ্যাকে বাদ দেওয়ার জন্যে উদ্দেশ্যমূলকভাবে এটি করা হয়েছে।

আদমশুমারি ২০১১ অনুসারে আসামের জনসংখ্যা ৩,১২, ০৫,০০০ এর বেশি রেকর্ড করা হয়, যাদের মধ্যে হিন্দুদের সংখ্যা প্রায় ১,৯১,৮০,০০০ (৬১.৪৭%) এবং মুসলমান প্রায় ১,০৬,‌৭৯,০০০ (৩৪.২২%)। রাজ্যে জনসংখ্যা, ধর্ম ও নাগরিকত্বের উত্তেজনা নিয়ে বিতর্কের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।

১৯৮০র দশকে শিক্ষার্থী-নেতৃত্বাধীন “আসাম আন্দোলন” (বিদেশি বিরোধী আন্দোলন) আসামে “অবৈধ বিদেশীদের” চিহ্নিত করে তাদের নির্বাচনী ভূমিকা থেকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা করে। আসামের অসংখ্য আদিবাসী সংগঠন উন্নত জীবনযাপনের জন্যে বাংলাদেশ থেকে বেআইনিভাবে মানুষের আগমন ঘটেছে বলে দাবি করে। এই উদ্বেগের প্রতিক্রিয়া হিসেবে, হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপি ২০১৬ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর আসামে নাগরিকদের জাতীয় নিবন্ধন (এনআএসি) চালু করে। এনআরসির চূড়ান্ত খসড়ায় আসামের ১৯ লক্ষ লোককে বাদ পড়ায় তা একটি উল্লেখযোগ্য নাগরিকত্ব সংকট ও পরিণতি সৃষ্টি করেছে।

বিরোধী দল ও বিভিন্ন অংশীজনের উপর প্রভাব

প্রতিবেদন অনু্সারে এই সীমানা নির্ধারণের কারণে মুসলমানরা সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এআইইউডিএফ বলেছে খসড়া প্রস্তাবে মুসলমান-সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনের সংখ্যা কমিয়ে ২২ করা হয়েছে, যা আগের ২৯টি আসনের চেয়ে সাতটি কম। এই ২৯টি আসনের মধ্যে তিনটি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন তফসিলি জাতি ও উপজাতির প্রার্থীদের জন্যে সংরক্ষিত রয়েছে।

প্রস্তাব বাতিল না হলে আদালতে যাওয়ার হুমকি দিয়েছে এআইইউডিএফ। এদিকে ঐক্যবদ্ধ বিরোধীদের আসাম জাতীয় পরিষদ ৪ জুলাই, ২০২৩ সীমানা নির্ধারণের বিরোধিতা করে একটি মামলা দায়ের করেছে

সাংবাদিক রকিবুজ জামান টুইট করেছেন:

অনেকগুলি মুসলমান-সংখ্যাগরিষ্ঠ বিধানসভা আসন বাতিল করে তিনটি মুসলমান-সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন তফসিলি জাতি ও উপজাতির জন্যে সংরক্ষিত করা হয়েছে

এই আসনগুলিকে অন্যান্য সদ্য-সৃষ্ট উল্লেখযোগ্য হিন্দু জনসংখ্যা অধ্যুষিত আসনগুলিতে হয় একীভূত অথবা অন্তর্ভুক্ত করা হবে

রাজ্যের একটি নবগঠিত উপজাতীয় সংস্থা উপজাতীয় জনগণের কনফেডারেশন, আসাম (টিপিসিএ)  এই প্রস্তাবে দ্বিমত প্রকাশ দাবি করেছে আদিবাসীদের জন্যে আরো আসন সংরক্ষিত করা দরকার।

মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অবিভক্ত বারপেটা জেলায় দুটি আসন বাদ দেওয়ায় আইএনসি বারপেটা শহরে ব্যাপক প্রতিবাদ করেছে

আসাম প্রদেশ কিষান কংগ্রেসের সহ-সভাপতি মোহাম্মদ ফুজাইল আহমেদ টুইট করেছেন:

নির্বাচন কমিশন প্রকাশিত খসড়া সীমানা প্রস্তাবে অবিভক্ত বরপেটা জেলার দুটি বিধানসভা আসন বাদের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে আজ জেলার সুশীল সমাজ ও বারপেটা জেলা কংগ্রেস কমিটি …র সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে।

তবে ক্ষমতাসীন বিজেপি খসড়া প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছে। একটি টুইটে আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বলেছেন এটি আসামের আদিবাসীদের অনুভূতিকে প্রতিফলিত করে।

জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদর্পী গরিয়সী

আজ ইসিআই প্রকাশিত খসড়া সীমানা নির্ধারণে ২০০১ সাল থেকে আমার প্রতিনিধিত্ব করা বর্তমান জালুকবাড়ি নির্বাচনী এলাকা তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যাওয়ায় আর থাকবে না। এই খবরে আমি খুবই মর্মাহত।

একটি বিবৃতিতে হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বলেছেন খসড়া প্রস্তাবটি বাস্তবায়িত হলে আইএনসি শীঘ্রই রাজ্যে ক্ষমতায় “ফিরতে পারবে না।” তিনি আরো বলেছেন সীমানা নির্ধারণ যা করেছে তা আসামের অবৈধ নাগরিকদের চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) ও নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) করতে পারে নি।

প্রস্তাবটি আসামের বরাক উপত্যকায় আসন সংখ্যা ১৫ থেকে কমিয়ে ১৩ করায় উপত্যকা জুড়ে ব্যাপক প্রতিবাদের সূত্রপাত করেছে।

তৃণমূল কংগ্রেস ও আইএনসি সমর্থিত বরাক গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট ২৭ জুন সমগ্র বরাক উপত্যকায় ১২ ঘন্টার বন্ধের (একটি সাধারণ ধর্মঘটের মতো একটি ঘটনা) ডাক দিয়েছে

#সীমানা নির্ধারণের কারণে দুটি এলএসি হারানোর বিরুদ্ধে আজ বরাক উপত্যকায় ব্যাপক বিক্ষোভ ও সম্পূর্ণ বন্ধ দেখা গেছে।

সংসদের উচ্চকক্ষের সদস্য ও তৃণমূল কংগ্রেসের নেত্রী সুস্মিতা দেব টুইট করেছেন:

এই ভিডিওটি তারাপুর, শিলচর, আসাম থেকে আমি বিকেল ৩.১৫ টায় লাইভ করেছি।

এটি একটি শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ। জনসংখ্যা বৃদ্ধি সত্ত্বেও সীমানা নির্ধারণ বরাক উপত্যকায় মোট বিধানসভা আসনের সংখ্যা ১৫ থেকে ১৩-তে  নামিয়েছে।

কাছাড় বিজেপি তাদের মনিবকে খুশি করতে কিছু দোকান খুলিয়েছে!

প্রতিবাদটি বিপুল সংখ্যক আদিবাসী অধ্যুষিত উচ্চ আসামকেও স্পর্শ করেছে। রায়জোর দোল নেতা অখিল গগৈ বলেছেন এটি আদিবাসীদের মারাত্মক ক্ষতি করবে।

আসাম জাতীয় পরিষদের সভাপতি লুরিনজ্যোতি গগৈ, শিবসাগরে ঐক্যবদ্ধ বিরোধী দলগুলিতে যোগদান করে এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার প্রতিশ্রুতি দেন।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .