প্রযুক্তি কেনিয়ার গণতন্ত্রে রাজনৈতিক পছন্দ নিয়ন্ত্রণের কর্তৃত্ববাদী নির্বাচনী চর্চার হাতিয়ার

ছবির সৌজন্যে আমেয়া নাগরাজন

গণতন্ত্রের সংজ্ঞা অনুসারে কেনিয়া গণতান্ত্রিক নির্বাচন আয়োজন করলেও প্রযুক্তি সরকারকে তথ্যের কারসাজি ও নিয়ন্ত্রণ করা এবং পছন্দসই প্রার্থীদের পক্ষে রাজনৈতিক চিন্তাধারা প্রণয়নের সুযোগ দিয়েছে।

গণতন্ত্রের পশ্চিমা উদারপন্থী ধারণার কেন্দ্রবিন্দু হলো নির্বাচন, রাজনৈতিক পছন্দের চর্চা ও স্বাধীনতা। সাধারণভাবে নির্বাচনকে একটি সত্যিকারের “গণতান্ত্রিক চর্চা” হিসেবে বিবেচনা করা হয় যেহেতু এর মাধ্যমে দেশ পরিচালনার ব্যাপারে জনগণের কথাবলার একটি জায়গা থাকে। তবে লক্ষণীয় বিষয় হলো প্রকৃত গণতন্ত্রের নীতির অধীনে প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্যে নির্বাচন অবশ্যই অবাধ ও সুষ্ঠু হতে হবে।

অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের এই ধারণা কেনীয় সংবিধানে প্রোথিত থাকলেও নাগরিকরা পাঁচ বছর পরপর সরকারগুলিকে নির্বাচিত করা কেনিয়ায় গণতন্ত্রকে অসম্মান করা কর্তৃত্ববাদী নির্বাচনী চর্চার একটি গভীর ইতিহাস রয়েছে। এই ধরনের কর্তৃত্ববাদী নির্বাচনী চর্চা কেনীয় সর্বোচ্চ আদালতকে ২০১৭ সালের রাষ্ট্রপতির সাধারণ নির্বাচন বাতিল করার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের দিকে পরিচালিত করে। সেসময় কেনিয়ার প্রধান বিচারপতি উইলি মুতুঙ্গা ” অভিজাতদের দখলে থাকা নির্বাচনী অবকাঠামোতে অগুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের ভুয়া গণতন্ত্র” হিসেবে কেনিয়াকে বর্ণনা করেন। কেনিয়ার নির্বাচন গণতন্ত্রের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতি শুধু সরকারকে তার নাগরিকদের রাজনৈতিক পছন্দ নিয়ন্ত্রণের সুবিধা দিয়েছে।

কেনীয় নির্বাচনে কর্তৃত্ববাদের ইতিহাস

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ থেকে ১৯৬৩ সালে স্বাধীনতা লাভ করে কেনিয়া ১৯৬৪ সালে নিজেকে একটি বহু-দলীয় প্রজাতন্ত্র নির্ধারণ করার পর থেকে ঔপনিবেশিকতার কর্তৃত্ববাদী উত্তরাধিকার হিসেবে বেঁচে আছে। এর সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ প্রমাণ হলো স্বাধীনতার পর থেকে একজন ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতিও কখনো নির্বাচনে পরাজিত হননি। তদুপরি  রাজনীতিতে আপাত পরিবর্তন সত্ত্বেও কেনিয়ার প্রাক্তন কর্তৃত্ববাদী শাসক দল (কেনিয়া আফ্রিকীয় জাতীয় ইউনিয়ন, কেএএনইউ) এখনো আজকের রাজনীতিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। দেশটি এখন পর্যন্ত কেএএনইউর সদস্য নয় এমন একজন রাষ্ট্রপতি বা উপ-রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করতে পারেনি; এবং মন্ত্রিসভায় নিয়োগপ্রাপ্ত ও মনোনীতদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশই প্রাক্তন কেএএনইউ দলের পদাধিকারী। এটি প্রমাণ করে ক্ষমতার হাত বদল হলেও দেশের গণতন্ত্র এখনো এক শ্রেণীর অভিজাতদের হাতে বন্দী রয়েছে বলে মনে হচ্ছে।

দেশটির প্রথম রাষ্ট্রপতি জোমো কেনিয়াত্তা তার তৎকালীন সহকারী ওডিঙ্গার গঠিত প্রথম বিরোধী দলকে নিষিদ্ধ করেন। সরকার তখন রাজনৈতিক ভিন্নমতকে নির্মমভাবে দমন করে কেনিয়ার নির্বাচনী কর্তৃত্ববাদের ভবিষ্যৎ ভিত্তি স্থাপন করে। বহুদলীয়তা ১৯৯০ এর দশকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলেও পরবর্তী নির্বাচনগুলি দেশের কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক উৎসের মতো নির্বাচনী হস্তক্ষেপে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যিনিই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করুন না কেন কারচুপি, রাষ্ট্রীয় পরিচালিত সহিংসতা, ভোটারদের ভীতি প্রদর্শন, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ও সংবাদমাধ্যমের দমনের মাধ্যমে কেনিয়ার নির্বাচন কলঙ্কিত হওয়া প্রত্যাশিত। এই মূল্যায়ন কেনীয় নির্বাচনী প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত পছন্দকে কাল্পনিক চিহ্নিত করে। আপাতদৃষ্টে কেনীয়রা ব্যালটে প্রায়শই একটি স্বাধীন রাজনৈতিক পছন্দের কথা মনে করলেও আসলে তারা তা করছে না।

প্রযুক্তি ও কেনিয়ার নির্বাচন

দুর্ভাগ্যবশত হস্তক্ষেপ, দুর্নীতি ও স্বৈরাচার কেনীয় নির্বাচনের প্রতীক। কেনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ এখন ইন্টারনেটের সাথে সংযুক্ত থাকায় শুধু নতুন যুগের প্রযুক্তিগুলির সর্বাধিক ব্যবহারের জন্যে নির্বাচনী হস্তক্ষেপের পুরানো পদ্ধতিগুলি অভিযোজন প্রত্যাশিত। এর সবচেয়ে দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ হলো দেশের নির্বাচন কমিশনের শীর্ষ তথ্যপ্রযুক্তি কর্মকর্তা ক্রিস এমসান্ডোর ২০১৭ সালে হত্যাকাণ্ড। ইলেকট্রনিক ব্যবস্থার নিরাপত্তার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। জনগণের অনেকেই সরকারকে অমীমাংসিত হত্যাকাণ্ডটির প্রধান সন্দেহভাজন মনে করে।

কেনিয়ার জনসংখ্যার বেশিরভাগের ইন্টারনেটে প্রবেশাধিকার এবং অর্ধেকের সামাজিক গণমাধ্যমে সক্রিয় থাকার বিষয়টি একটি নতুন বাস্তবতা যা অভূতপূর্ব মাত্রায় কর্তৃত্ববাদী নির্বাচনী চর্চার দুর্দান্ত সম্ভাবনা তৈরি করে। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি উহুরু কেনিয়াত্তাকে ২০১৩২০১৭ সালে নির্বাচনে জয়ী করতে সাহায্য করতে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা সম্মতি ছাড়াই লক্ষ লক্ষ কেনীয় ফেসবুক ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত ডেটাইয় অনুপ্রবেশ করে। প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রপতি প্রার্থী রাইলা ওডিঙ্গাকে ভুলভাবে হিংসাত্মক, অসৎ ও বিপজ্জনক হিসেবে উপস্থাপন করে অশুভ আক্রমণাত্মক বিজ্ঞাপন ব্যবহার করে ভোটারদের রাজনৈতিক পছন্দ হেরফের ও প্রভাবিত করা হয়।

এটি ফেসবুক, টুইটার, গুগল ও অন্যান্য ডিজিটাল সংস্থার সংরক্ষিত ব্যবহারকারীদের ডেটা নির্বাচনকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে কীভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে তা দেখায়। ব্যক্তিগত রাজনৈতিক পছন্দের এই হেরফেরটি প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি মোইয়ের একনায়কত্বের অ্যানালগ দিনের সাথে তুলনীয় যেখানে সরকার কুখ্যাত ম্ললোঙ্গো ব্যবস্থা ব্যবহার করে রাজনৈতিক পছন্দ নিয়ন্ত্রণ করতো। উদ্ভট এই ভোট ব্যবস্থায় প্রতিটি ভোটারকে শারীরিকভাবে তাদের পছন্দের রাষ্ট্রপতি প্রার্থীর একটি ছবির পিছনে একটি সারিবদ্ধ হতে হতো। এই ভোট শৈলী ব্যবহার করে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি মোই তাকে পুনরায় নির্বাচিত করার জন্যে ভোটারদের ভয় দেখাতে সক্ষম হন। আজকের ডিজিটাল যুগে সরকার রাজনৈতিক পছন্দের পূর্বাভাস দিতে, প্রভাবিত করতে এবং দোলাতে ইন্টারনেট ও সামাজিক গণমাধ্যম ব্যবহার করে প্রকৃত নির্বাচনের আগেই একটি পুনঃনির্বাচন নিশ্চিত করতে পারে। এইভাবে ইন্টারনেট কার্যত সরকারকে নাগরিকদের মনে প্রবেশের সুযোগ দিয়ে নির্বাচনে কর্তৃত্ববাদী চর্চা ত্বরান্বিত ও পরিমাপ করে।

নির্বাচনের সময় পছন্দসই রাষ্ট্রপতি প্রার্থীদের পক্ষে রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা নিয়ন্ত্রণ এবং রাজনৈতিক বর্ণনা প্রণয়নে কেনিয়ার সরকার উল্লেখযোগ্যভাবে ইন্টারনেট ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে চলেছে। অতি সম্প্রতি ২০২২ সালের আগস্টে নির্বাচনে রাজনৈতিক প্রার্থীরা গণমাধ্যম কোম্পানিগুলিতে তাদের প্রভাব ও অংশীদারিত্ব ব্যবহার করে তথ্যের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে বড় আকারের বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা চালিয়েছে। এতে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলির একটির সভাপতির মালিকানাধীন সরকারি গণমাধ্যম স্টেশনগুলির মিথ্যা প্রকাশনা এবং উভয় প্রতিদ্বন্দ্বী শিবিরের জাল হ্যাশট্যাগগুলির পৃষ্ঠপোষকতা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

তদুপরি কেনিয়ার জাতীয় মানবাধিকার কমিশন পর্যবেক্ষণ করেছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অনলাইনে “ভুয়া খবর” ছড়ানো ও প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক প্রার্থীদের অসুবিধায় ফেলার উদ্দেশ্যে ঘৃণামূলক বক্তব্য প্রচারের মাধ্যমে মত প্রকাশের স্বাধীনতা লঙ্ঘন করা হয়েছে। ইন্টারনেটের যুগ টুইটার, ফেসবুক ও  টিকটকের মতো সামাজিক গণমাধ্যম সাইট অপরিহার্য বিতর্কের জন্যে একটি মঞ্চ প্রদান করে রাজনৈতিক আলোচনাকে রূপান্তরিত করেছে। জটিল সমস্যা্টিও প্রযুক্তির অগ্রগতির কারণেই, কেনীয় সরকার কেনীয়দের রাজনৈতিক মতামতেরও গোপনীয়তার রক্ষক।

কেনিয়ার গণতন্ত্র ইতোমধ্যেই যথেষ্ট ভঙ্গুর এবং রাজনৈতিক পছন্দ ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণের নির্বাচনী চর্চার সাথে জড়িত। প্রযুক্তির বৈশ্বিক ত্বরণ ও সামাজিক গণমাধ্যমের প্রসারের সাথে সাথে অভূতপূর্বভাবে কেনীয়দের রাজনৈতিক চিন্তা সংগঠিত ও ভাগভাগি করে নেওয়ার সুযোগ দেখা গেলেও এর সমান্তরালটি আরো জটিল: দেশ যতোই ডিজিটাল যুগে যাত্রা করছে রাজনৈতিক স্বাধীনতার উপর সরকারের প্রভাব ততোই বাড়ছে।

পরাধীনতা পর্যবেক্ষক থেকে আরো কিছুরা জন্যে দয়া করে প্রকল্প পৃষ্ঠা দেখুন।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .