ক্যামেরুন: মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে ইংরেজিভাষী দ্বন্দ্বের প্রতিবেদন

ফ্রান্স২৪ এর ইউটিউব চ্যানেলের একটি ভিডিওর পর্দাছবিতে দৃশ্যমান ক্যামেরুন।

ক্যামেরুনের রাজধানী শহর ইয়াউন্ডেতে একজন রুটি প্রস্তুতিকারীর মতো কেউ বসবাস করে না। তিনি রুটি প্রস্তুতিকারী হতে না চাইলেও বেঁচে থাকার জন্যে পরিস্থিতি তাকে এমন হতে বাধ্য করেছে।

সাংবাদিক ল্যামবার্ট কেহভেন রুটি প্রস্তুতিকারী হওয়ার স্বপ্ন দেখেননি। তিনি ক্যামেরুনের অশান্ত উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বুই বিভাগের কুম্বোর স্থানীয় গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ক্যানাল ২ ইন্টারন্যাশনালে সাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। ২০১৭ সালে ইংরেজিভাষী দ্বন্দ্ব বেড়ে গেলে তিনি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী ও অ-রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে ফেঁসে যান যারা প্রত্যেকেই চেয়েছে তিনি প্রতিবেদনের গল্পে যেন তাদের পক্ষাবলম্বন করেন। তারা প্রকাশিত হওয়ার আগেই তার প্রতিবেদন পড়তে চেয়েছে।

কেহভেনকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অ-রাষ্ট্রীয় কর্মীদের সাথে কাজের অভিযোগে গ্রেপ্তার করে ২০২০ সালের ১০ জানুয়ারি মুক্তি দিলে তিনি তার জীবন ও নিরাপত্তার জন্যে সংঘাতপূর্ণ অঞ্চল থেকে পালিয়ে যান।

চিলেন গণমাধ্যম টিভির ইংরেজিভাষী দ্বন্দ্বের প্রতিবেদনকারী জনপ্রিয়ভাবে স্যামুয়েল ওয়াজিজি নামে পরিচিত স্যামুয়েল আজিকাহ আবুওয়ে ততোটা ভাগ্যবান ছিলেন না। ক্যামেরুন পুলিশ সাংবাদিকদের বলেছে তিনি তার প্রতিষ্ঠানকে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলিকে ব্যবহার করার অনুমতি দিয়ে কথিত সামরিক নৃশংসতার ফুটেজ তুলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে সরবরাহ করলে ২০১৯ সালের ২ আগস্টে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

স্যামুয়েল ওয়াজিজি পুলিশী হেফাজতে মারা যান; ২০১৯ সালের ২ জুন ইকুইনক্স টিভি তাদের প্রধান সংবাদ চলাকালে তার মৃত্যুর খবর প্রকাশ করে। পরিবার তার দেহাবশেষের কোনো হদিস পায়নি। সামরিক বাহিনী সেপসিস রোগে তার মৃত্যুর কথা বললেও কোনো স্বাধীন তদন্ত শুরু হয়নি এবং সাংবাদিকরা নিহত হওয়ার ভয়ে প্রশ্ন বা তদন্ত করার সাহস করেনি।

ক্যামেরুনের সাংবাদিকরা এখনো ওয়াজিজির মামলা প্রক্রিয়াকরণ করতে থাকায় আরেকজন সাংবাদিক কিংসলে ফোমুনুয়ি নজোকাকে ২০২০ সালের ১৫ মে ইংরেজিভাষী দ্বন্দ্বের বিষয়ে তার প্রতিবেদন ও ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে এই অঞ্চলে সন্ত্রাসীদের “মদদ” দিয়ে তথ্য সরবরাহ করার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। নজোকাকে কয়েক সপ্তাহ ধরে যোগাযোগহীন রাখা হয়। সামরিক আদালত পরে তাকে সন্ত্রাসবাদের অভিযুক্ত করলে প্রায় দুই বছর ধরে তিনি বিচারের অপেক্ষায় আছেন।

সবচেয়ে সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার নিখোঁজ দুর্নীতির তদন্তকারী রেডিও সাংবাদিক মার্টিনেজ জোগোর বিকৃত দেহাবশেষ ২২ জানুয়ারি ইয়াউন্ডে শহরের উপকণ্ঠে সোয়া রোডে পাওয়া যায়। সীমান্তবিহীন প্রতিবেদক এটিকে “রাষ্ট্রীয় অপরাধ” হিসেবে বর্ণনা করেছে।

উপরে আঁকা পরিস্থিতি কীভাবে অনলাইন ও অফলাইনে ইংরেজিভাষী দ্বন্দ্বের বিষয়ে সমালোচনামূলক প্রতিবেদনকারী সাংবাদিকদের জেলে যেতে নয়তো সংঘর্ষের অঞ্চল ও সাংবাদিকতা ছেড়ে দিয়ে অথবা শেষ পর্যন্ত মারা যেতে হয় তা চিত্রিত করে। এগুলি আরো দেখায় ভিন্নমত নীরব ও সমালোচনামূলক প্রতিবেদন দমন করতে রাষ্ট্র কতদূর যেতে পারে।

ইংরেজিভাষী দ্বন্দ্ব

ইংরেজিভাষী বিরোধটি ফ্রান্স ও ব্রিটেনের মধ্যে ক্যামেরুনের বিভক্তির ইতিহাসে গভীরভাবে প্রোথিত, যেখানে ফ্রান্স পায় বড় অংশটি। ফরাসি ক্যামেরুন প্রথম স্বাধীনতা পেলে ইংরেজ অংশকে ফরাসি ক্যামেরুন অথবা নাইজেরিয়ায় যোগ দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়। তারা একটি দ্বি-রাষ্ট্রীয় ফেডারেশন গঠনের জন্যে ফরাসি ক্যামেরুনে যোগদান করার সিদ্ধান্ত নিলেও ইংরেজ অংশ প্রান্তিক হয়ে যাওয়ায় ফেডারেশনের শর্তাবলী ক্ষুন্ন হলে তা একটি সংকট থেকে একটি সংঘাতে রূপান্তরিত হয়।

একটি নতুন সংবিধান ১৯৭২ সালে দেশের ইংরেজি-ভাষী অংশগুলির স্বায়ত্তশাসন প্রত্যাহার করে রাষ্ট্রপতিকে আরো ক্ষমতা দেওয়ার ফলে দক্ষিণ ক্যামেরুনের আগেকার স্বায়ত্তশাসিত ইংরেজিভাষী অঞ্চলের নেতাদের সাথে সংঘর্ষ হয়। অবহেলা, প্রান্তিককরণ ও ফেডারেশনের শর্তাবলী ক্ষুন্ন হলো ক্যামেরুনে চলমান ধ্বংসাত্মক প্রভাব সৃষ্টিকারী  ইংরেজিভাষী দ্বন্দ্বের মূল কারণ

শিক্ষক ও আইনজীবীরা শিক্ষা ও আইনের অ্যাংলো স্যাক্সন ব্যবস্থার দুর্বল করার নিন্দা জানাতে ২০১৬ সালে শান্তির গাছ নিয়ে রাস্তায় নামলে ইংরেজিভাষী বিরোধ চরমে পৌঁছায়। বলপ্রয়োগে নেতাদের গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠিয়ে রাষ্ট্র প্রতিক্রিয়া জানায়। বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতা বেড়ে গেলে অ-রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র দলগুলো অস্ত্র তোলে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে।

সাত বছর পরে সংঘাত চলমান এবং সরকার সংঘাত বিষয়ে সমালোচনামূলক মতামতের প্রতি সহনশীল নয়।

রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী ও অ-রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র গোষ্ঠী উভয়ের মাধ্যমে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত নাইজেরিয়ায় ৮৭,০০০ উদ্বাস্তু এবং ৬ লক্ষ ২৮ হাজার জন অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুতসহ চার হাজার বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে। কথিত বিচ্ছিন্নতা ও সন্ত্রাস, আইন লঙ্ঘন এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতার অভিযোগের শাস্তি প্রদানকারী দণ্ডবিধির অধীনে সংঘাত সম্পর্কিত গ্রেপ্তারগুলি করা হয়েছে। সরকার সন্ত্রাসী কে তা সংজ্ঞায়িত না করায় সন্ত্রাস-বিরোধী আইন সন্ত্রাসীদের চেয়ে বেশি সাংবাদিককে তার জালে আটকে রেখেছে বলে মনে হয়। স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালতে সুষ্ঠু বিচারের অধিকার না দিয়ে সামরিক আদালতে গ্রেপ্তারকৃত সাংবাদিকদের বিচার করা হয়।

সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা

ক্যামেরুনের সংবিধানের প্রস্তাবনায় সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিহিত। “যোগাযোগ মত প্রকাশ, সংবাদমাধ্যম, সমাবেশ, সমিতি এবং ট্রেড ইউনিয়নবাদের স্বাধীনতার পাশাপাশি ধর্মঘটের অধিকার আইনের নির্ধারিত শর্তে নিশ্চিত করা হবে।” তবুও সাংবাদিক সুরক্ষা কমিটি (সিপিজে) ক্যামেরুনকে সাংবাদিকদের তৃতীয় নিকৃষ্ট কারাগার হিসেবে বর্ণনা করেছে। ইংরেজিভাষী সাংবাদিকদের ক্যামেরুন সমিতি (সিএএমএএসইজে) ২০২২ সালে অঞ্চল দুটি থেকে অন্তত ৮০ জন সাংবাদিক পালানো এবং মোট নয়জন সাংবাদিককে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে

সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সীমিত করার জন্যে এবং সরকারের সমালোচনাকারী সাংবাদিক ও গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলির বিরুদ্ধে দমনাভিযান করার জন্যে সরকার সমালোচিত হয়েছে। ২০২১ সালের বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচক অনুসারে ক্যামেরুন ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৩৫তম স্থানে রয়েছে যা তার ২০২০ সালের ১৩৪তম অবস্থান থেকে পতন নির্দেশ করে। প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে ক্যামেরুনে সাংবাদিকরা হয়রানি, ভয়ভীতি ও শারীরিক আক্রমণের সম্মুখীন হয় এবং সংবেদনশীল বিষয়ে প্রতিবেদন বা সরকারি কর্মকর্তাদের সমালোচনাকারী গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলিকে সরকার স্থগিত বা বন্ধ করে দিয়েছে। উপরন্তু, ডিসেম্বর ২০১৪ সন্ত্রাসবিরোধী আইন ব্যবহার করে ভিন্নমতকে নীরব এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত করার দায়ে সরকারকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক অন্যান্য ২৯টি সুশীল সমাজ সংস্থার সাথে সিপিজে ২০২২ সালে একটি চিঠিতে রাষ্ট্রপতি বিয়া মত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার প্রয়োগ করার জন্যে সাংবাদিক সি কনরাড, মাঞ্চো বিবিক্সি, টমাস আওয়াহ এবং কিংসলে ফোমুনুয়ি নজোকার মতো মুক্ত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের দাবি করেছে।

সিপিজের যুক্তিতে সাংবাদিকরা সন্ত্রাসী না হলেও সরকার তার কর্মকাণ্ডের ন্যায্যতা দিতে আঞ্চলিক অখণ্ডতা, জনশান্তি ও নিরাপত্তাকে ব্যবহার করে। সরকারের মুখপাত্র যোগাযোগ মন্ত্রী রেনে সাদি দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার বিরুদ্ধে সাংবাদিকদের কঠোরভাবে সতর্ক করে বলেছেন “স্বদেশের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও শত্রুতার উস্কানি আইনের শাসন এবং স্বাধীন ও দায়িত্বশীল সমাজে সহ্য করা যায় না।

সাংবাদিকরা চুপ থাকেনি। বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা দিবস ২০২২ সিএএমএএসইজে-কে সাংবাদিকদের প্রতি আচরণে অসন্তোষ প্রকাশ এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী এবং অ-রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র গোষ্ঠী উভয়ের প্রতি সাংবাদিকদের উপর আক্রমণ বন্ধের আহ্বান জানানোর একটি সুযোগ করে দিয়েছে। এটা সামান্য পার্থক্য সূচিত করেছে।

পরাধীনতা পর্যবেক্ষক থেকে আরো কিছুরা জন্যে দয়া করে প্রকল্প পৃষ্ঠা দেখুন।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .