কেনিয়া এবং জাতীয় নিরাপত্তার জন্যে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বিক্রির ভ্রান্তি

পিক্সাবে থেকে নামহীন_১৩ এর ছবি। একটি পিক্সাবে অনুমতির আওতায় ব্যবহৃত।

প্রায় ৫ কোটি ৪০ লক্ষেরও বেশি জনসংখ্যার গণতান্ত্রিক দেশ কেনিয়াতে ইন্টারনেটে অন্তর্ভূক্তি প্রায় ৫০ শতাংশ। বৈশ্বিক দক্ষিণের অনেক দেশের মতো ডিজিটাল যুগে এই অগ্রগতি গোপনীয়তার অধিকারের অপর্যাপ্ত সচেতনতার সমান্তরাল। একটি সমীক্ষায় ২০২১ সালে দেখা গেছে প্রায় ৫৪ শতাংশ মানুষ গোপনীয়তার অধিকারের কথা শুনেইনি। এটি এমন একটি বিপজ্জনক ফাঁকি যা নাগরিকদের ডেটা গোপনীয়তাকে রাষ্ট্রের শোষণ ও লঙ্ঘনের ঝুঁকিতে ফেলে দেয়।

কথাটিকে সত্যে পরিণত করে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে কেনিয়া রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সংস্থা পরিচালিত লাগামহীন ডেটা সংগ্রহ চর্চার পাশাপাশি অসম ইন্টারনেটযোগাযোগ পর্যবেক্ষণের বৈশিষ্ট্যযুক্ত নজরদারির একটি উদ্বেগজনক প্রবণতা দেখেছে। এধরনের অনিয়ন্ত্রিত নজরদারি ক্ষমতা কেনীয় সরকারের অন্তর্নিহিত স্বৈরাচারী প্রবণতার প্রতীক ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের কাজে রাষ্ট্রীয়ভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্যে উপযুক্ত সুযোগ উপস্থাপন করে। সরকার প্রায়শই অসাধুভাবে জাতীয় নিরাপত্তাকে গোপনীয়তার অধিকার বিনিময়ের ন্যায্য মূল্য হিসেবে চিত্রিত করে। তাই অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন কেনীয়দের দাবি করা জরুরি, জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষা তাদের গোপনীয়তার অধিকারের জন্যে ক্ষতিকর হতে পারে না।

যন্ত্র ব্যবস্থাপনা প্রকল্প

কেনিয়ার নজরদারি প্রবণতার একটি মূল উল্লেখ্য হলো একটি যন্ত্র ব্যবস্থাপনা প্রকল্প (ডিএমএস) এর একত্রীকরণ। কেনিয়ার সরকার ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসের বেশ কয়েকদিন তার যোগাযোগ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে একটি ডিএমএস চালু করার পরিকল্পনা সকল স্থানীয় মোবাইল অপারেটর নেটওয়ার্ককে (এমএনও) অবহিত করেছে

তিনটি টেলিযোগাযোগ পরিষেবা প্রদানকারী – অরেঞ্জ-টেলকম কেনিয়া, এয়ারটেল কেনিয়া এবং সাফারিকম পিএলসি-কে তাদের নেটওয়ার্কে গ্রাহকদের তথ্যে প্রবেশাধিকার দেওয়ার জন্যে যোগাযোগ কর্তৃপক্ষকে ডিএমএস ও তাদের নিজস্ব ব্যবস্থাগুলির মধ্যে সংযোগ তৈরির অনুমতি দেওয়ার জন্যে আদেশ দেওয়া হয়। কেনীয় সুশীল সমাজের অভিনেতারা একটি ডিএমএসে একীকরণকে প্রশ্নবিদ্ধ করে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি বিশেষ করে নাগরিকদের কল ডেটা রেকর্ড, ক্ষুদেবার্তা ও মোবাইলে অর্থ লেনদেনের ডেটা অনুসরণ, সংগ্রহ ও সংরক্ষণের সম্ভাবনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বাস্তবে দেশের বৃহত্তম বাজার দখলকারী এমএনও সাফারিকম পিএলসি”আঁড়িপাতা যন্ত্র” অভিহিত করে একটি ডিএমএস চালুতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে

ডিএমএস গোপনীয়তার অধিকারের প্রতি হুমকি তৈরি করেছে বলে কেনিয়ার উচ্চ আদালত প্রাথমিকভাবে রায় দিলেও উচ্চ আদালত বন্দুক নাড়াচ্ছে এবং গোপনীয়তার অধিকার হুমকির মধ্যে থাকার কোনো বাস্তব প্রমাণ নেই মনে করে এক সপ্তাহের মধ্যে, আপিল আদালত এই রায়টি বাতিল করে দেয়।

কেনীয়দের উপর গুপ্তচরবৃত্তির উদ্দেশ্যে একটি ডিএমএস চালু করা হয়েছে বলে যোগাযোগ কর্তৃপক্ষ অটল। কর্তৃপক্ষের মতে কেনিয়ার সরকারের উদ্দেশ্য হলো অঞ্চলটির মধ্যে বৈধ মোবাইল যন্ত্রের ব্যবহার অবরোধ, মোবাইল যন্ত্র চুরি কমানো, নকল যন্ত্রের বাজার থেকে মুক্তি, সিম বক্স জালিয়াতি বন্ধ এবং মোবাইল অপারেটরদের রাজস্ব ফাঁকি কমানোসহ জাতীয় বিভিন্ন  নিরাপত্তা উদ্বেগ মোকাবেলা করা। এছাড়াও আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা অনুসারে কেনিয়ার একটি ডিএমএস সংহতকরণ প্রয়োজনীয় বলে কর্তৃপক্ষ মনে করে।

উদ্ধৃত জাতীয় নিরাপত্তা উদ্বেগ কেনিয়ার জন্যে নতুন বা অনন্য নয় বলে এই ন্যায্যতাগুলি বিতর্কিত। ডিএমএস চালু হওয়ার মধ্যবর্তী সময়ে স্থানীয় এমএনও’র সহযোগিতায় যোগাযোগ কর্তৃপক্ষের কাছে ইতোমধ্যে কার্যকরভাবে নকল যন্ত্রের পসার মোকাবেলা করার একটি ব্যবস্থা ছিল যা ব্যবহার করে দেশটি নকল যন্ত্র সনাক্ত ও লক্ষ লক্ষ অবৈধ যন্ত্র অবরোধ বা বন্ধ করে দিতে পেরেছিল। এটি মাথায় রাখলে কেনীয় সরকারের “জাতীয় নিরাপত্তা” ডিএমএস এর ন্যায্যতাকে এখন একটি মট-বেইলি ফ্যালাসি হিসেবে দেখার বাকি আছে।

জাতীয় নিরাপত্তা বনাম গোপনীয়তার অধিকার

এই বিতর্কের সময় সরকারগুলির গোপনীয়তা লঙ্ঘনের অস্পষ্ট হুমকি ও ক্ষতির বিপরীতে “প্রকৃত” ক্ষতির সম্ভাবনাসহ বাস্তব হুমকি হিসেবে জাতীয় নিরাপত্তা উদ্বেগ প্রকাশ করাটা অস্বাভাবিক নয়। এখানে সমস্যাটি হলো গোপনীয়তার অধিকারকে জাতীয় নিরাপত্তার জন্যে একটি যুক্তিসঙ্গত বিনিময় হিসেবে চিত্রিত করা। সুরক্ষার জন্যে নজরদারিকে প্রয়োজনীয় ভাবা হলে গোপনীয়তার অধিকারের লঙ্ঘনকে তখন ততোটা খারাপ বলে মনে হয় না।

এটি নাগরিক স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের উপর নজরদারির প্রকৃত প্রভাবকে তুচ্ছ করে তুললেও বাস্তবতা অনেক বেশি অন্ধকারাচ্ছন্ন। জাতীয় স্তরে নজরদারির মতো কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে গোপনীয়তার অধিকার ভেঙ্গে গেলে অগণিত অন্যান্য মানবাধিকার তাসের ঘরের মতো এক ধরনের ভঙ্গুরতার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মানবাধিকারগুলি পরস্পরকে ছেদ করে বলে এরকমটা ঘটে কারণ গোপনীয়তার অধিকার মতপ্রকাশ, তথ্য, সমিতি, সেইসাথে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের অপরাধ স্বীকারোক্তির বিরুদ্ধে অধিকারের মতো বিভিন্ন অধিকারসহ অন্যান্য মৌলিক স্বাধীনতাকে সমর্থন করে।

এলজিবিটিকিউ+ এর মতো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে গোপনীয়তার অধিকার অনেকটা আক্ষরিক অর্থেই জীবন ও মৃত্যুর বিষয় কারণ তারা অনলাইন ও অফলাইনে নিরাপদে থাকার জন্যে বেনামীতার উপর নির্ভর করে। নারীদের ক্ষেত্রে ডেটা গোপনীয়তা লঙ্ঘন ও অনলাইন লিঙ্গ ভিত্তিক সহিংসতার মধ্যে একটি সরাসরি সম্পর্ক বিদ্যমান। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বর্জিত সমাজে জাতীয় নিরাপত্তা সত্যিই বিদ্যমান থাকতে পারে কিনা সেটা প্রশ্ন সাপেক্ষ ব্যাপার। মানবাধিকারের অন্তর্বিভাগীয় প্রকৃতি অনুসারে গোপনীয়তার অধিকার একটি গণতান্ত্রিক সমাজে নাগরিক স্বাধীনতার পূর্ণ উপভোগের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তাই বৈশ্বিক মানবাধিকারের সমগ্র জালের সাথে আপস না করে এটাকে বলিদান করা যাবে না।

চূড়ান্ত বিবেচনা

কেনিয়া ও বাকি বিশ্ব (বিশেষ করে বৈশ্বিক দক্ষিণ) ডিজিটাল যুগে অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে গোপনীয়তার অধিকার জোরদারের একটি দৃশ্যমান প্রয়োজন রয়েছে। কেনীয় নাগরিক সমাজ ডিজিটাল নিরাপত্তা সাক্ষরতা কর্মসূচি বাস্তবায়নমুখী পদক্ষেপ নিচ্ছে, যার একটি ভাল উদাহরণ হলো ২০২৩ সালের মে মাসে কাউন্টি-সচেতনতার জন্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা ও ডেটা গোপনীয়তা প্রশিক্ষণের জন্যে একটি অগ্রবর্তী কর্মসূচি সমাপ্ত করা অ্যামনেস্টি ও ডেটা সুরক্ষা কমিশনারের অফিসের মধ্যে চলমান সহযোগিতা। এটা গণতান্ত্রিক বিশ্বে গোপনীয়তার অধিকারের প্রয়োজনীয়তা প্রতিফলনের জন্যে আমাদের গোপনীয়তার অধিকার বনাম জাতীয় নিরাপত্তা বিতর্কের পুনর্বিন্যাসের প্রয়োজনীয়তার কথা বলে। এছাড়াও আমাদের গোপনীয়তার অধিকার সীমিতকরণের ন্যায্যতা প্রতিপন্নের বিষয়ে আরো সন্দিহান রও সন্দেহজনক এবং সমালোচনামূলক হতে হবে।

পরাধীনতা পর্যবেক্ষক থেকে আরো কিছুর জন্যে দয়া করে প্রকল্প পৃষ্ঠা দেখুন।

 

 

 

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .