‘নিজ দায়িত্বে পোস্ট করুন': ভারতীয় সাংবাদিক সৃষ্টি জাসওয়াল এর সাক্ষাৎকার

Image by Srishti Jaswal. Used with permission.

সৃষ্টি জাসওয়ালের ছবি। অনুমতিসহ ব্যবহৃত।

প্রযুক্তি বিশেষ করে কর্তৃত্ববাদী শাসনে বা দুর্বল ভারসাম্যের গণতন্ত্রে প্রায়শই সক্রিয় কর্মী, সাংবাদিক, ভিন্নমতাবলম্বী এবং সরকার বা অতি-ডানপন্থী গোষ্ঠীর রাজনৈতিক বিরোধীদের আক্রমণ ও নির্যাতনে ব্যবহৃত হয়।

রাজনীতি, প্রযুক্তি ও সমাজের সংযোগ কেন্দ্রিক মঞ্চ বিঘ্ন নেটওয়ার্ক গবেষণাগার ২০২৩ সালের মার্চ মাসে বার্লিনে “চৌকস কারাগার: অনুসরণ, পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ” শিরোনামে একটি সম্মেলন করে। প্যানেলের সময় ভারতীয় স্বাধীন সাংবাদিক সৃষ্টি জাসওয়াল “অ্যালগরিদম ও সীমানা কি নতুন কারারক্ষক?” এর মাধ্যমে বিশেষ করে অনলাইন ট্রলের লক্ষ্যবস্তু ও হয়রানির শিকারদের ক্ষেত্রে প্রযুক্তির একটি কারাগার হিসেবে কাজ করার সম্ভাবনার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ছয় মাস ধরে তার পাসপোর্ট নবায়ন করতে না পারার কারণে তিনি ব্যক্তিগতভাবে সম্মেলনে যোগ দিতে পারেননি। হিন্দু অতি-ডান ট্রল প্রতিষ্ঠানগুলি নিয়ে  প্রতিবেদন করার পর থেকেই তার আবেদনটি স্বেচ্ছাচারী সমস্যার শিকার হয়।

এই পুরস্কার বিজয়ী সাংবাদিক গ্রামীণ সংযোগ, মানবাধিকার, রাজনীতি, প্রযুক্তি ও শাসনের মতো বিস্তৃত বিষয়গুলির উপর স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় গণমাধ্যম সংস্থায় অবদান রাখেন। হিন্দুস্তান টাইমসের সাংবাদিক থাকাকালে তিনি বিরোধপূর্ণ রাজ্য জম্মু ও কাশ্মীরের ৩৭০ অনুচ্ছেদ এবং বিশেষ মর্যাদা বাতিলেপ্রভাব এর মতো সংবেদনশীল রাজনৈতিক বিষয়ে লিখেছেন।

জসওয়ালের ২০২০ সালের টুইটের একটিতে ডানপন্থী দলগুলির চিহ্নিত  হিন্দু দেবতা কৃষ্ণের মতো একই নামের চলচ্চিত্রের একটি চরিত্রের উল্লেখ করায় তাকে চাকরি হারাতে হয়। তিনি ডানপন্থী ট্রলের অনলাইন হয়রানির লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়ে হাজার হাজার ধর্ষণ এবং হত্যার হুমকি পান। পুলিশে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ নথিভুক্ত করা হলে গ্রেপ্তার এড়াতে তাকে তিন মাস লুকিয়ে থাকতে হয়।

চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও জাসওয়াল তার কাজ অব্যহত রেখে অনলাইনে হিন্দু অতি-ডান ট্রল ও ট্রল প্রতিষ্ঠানগুলির কৌশল তদন্ত করতে শুরু করেন। তিনি ডিজিটাল ক্ষেত্রে তাদের ধর্ম রক্ষার উদ্দেশ্যে “হিন্দু তথ্যপ্রযুক্তি কোষ” টুইটার অ্যাকাউন্ট চালানো একদল পুরুষের ভেতর ঢুকতে সক্ষম হন। দলটি সাধারণত তাদের ধর্মের বিরুদ্ধে রয়েছে বলে মনে করা ব্যক্তিদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে। তারা “সাইবার স্বেচ্ছাসেবক” ও তাদের লক্ষ্যবস্তুর বিরুদ্ধে আইনি অভিযোগ দায়ের এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্যে পুলিশকে চাপ দিতে সহযোগিতা করতে পারা আইনজীবীদের একটি দলের সাথে কাজ করে। জাসওয়ালের অনুসন্ধান কীভাবে সম্ভাব্য লক্ষ্যগুলির প্রতি আপত্তিজনক আচরণে জড়িত থাকার জন্যে ট্রলদের নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তার উপর আলোকপাত করে।

বর্তমানে জাসওয়াল “নিজ দায়িত্বে পোস্ট করুন ” (প্যান ম্যাকমিলান, ২০২৪) শিরোনামে ভারতে রাজনৈতিক ট্রোল কেন্দ্রিক তার প্রথম বই নিয়ে কাজ করছেন।

গ্লোবাল ভয়েসেস টেলিফোনে সৃষ্টি জাসওয়ালের সাক্ষাৎকার নিয়েছে। সংক্ষিপ্ত ও স্পষ্ট করার জন্যে সাক্ষাৎকারটির সম্পাদনা করা হয়েছে।

গ্লোবাল ভয়েসেস (জিভি): আপনার ভোগ করা অগ্নিপরীক্ষাগুলি সত্যিই বেদনাদায়ক এবং দুর্ভাগ্যবশত অনলাইন হয়রানির অন্যান্য অনেক শিকার তা নীরবেই ভোগেন। কী আপনাকে এই অভিজ্ঞতাটিকে “ডিজিটাল কারাগার” বলতে উদ্বুদ্ধ করেছে?

সৃষ্টি জাসওয়াল (এসজে): আমি মনে করি ট্রোলকে একটি ডিজিটাল কারাগার হিসেবে আমার বর্ণনা করার একটি কারণ হলো এই অভিজ্ঞতাটি খুবই বিচ্ছিন্ন এবং একটি জেলের মতোই এটি আপনাকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। প্রকৃত কারাগারের দেয়াল বন্দীদের সমাজের সাথে যোগাযোগ করা বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এবং আপনাকে ট্রোল করা হলে সেটিই ঘটে। ট্রোল আপনার বিচ্ছিন্নতা নিশ্চিত করে যাতে আপনার কণ্ঠ সমাজে বৃহত্তরভাবে না পৌঁছায়। এটা এমন নয় যে আপনার চারপাশে দেয়াল আছে, কিন্তু আপনাকে ট্রোল করার পর আপনি আপনার নিজের ঘরে, নিজের প্রাঙ্গনে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েন। হুমকি এবং ভয়ভীতির কারণে আপনি জনগণের সাথে কথা বলতে পারেন না। খুব অনিরাপদ বলে আপনি বাইরে যেতে পারবেন না। প্রকাশ্যে লজ্জা দিয়ে লোকেরা আপনাকে ধর্ষণ ও হত্যার হুমকি দিচ্ছে।

প্রকাশ্যে লজ্জা অপরাধীদের সাথে করা এক ধরনের জাগ্রত ন্যায়বিচারের মতো। আমার ক্ষেত্রেও আমি প্রকাশ্যে লজ্জিত হয়েছিলাম। আমার কী অপরাধ ছিল?

এই চিন্তাগুলিই আমাকে ট্রোলকে ডিজিটাল কারাগার হিসেবে বর্ণনা করতে পরিচালিত করেছে।

জিভি: অনলাইন মঞ্চের অ্যালগরিদমগুলি কীভাবে ট্রোল প্রতিষ্ঠানগুলির কর্মকাণ্ডে কাজ করে এবং কীভাবে এই গোষ্ঠীগুলি তাদের শিকারকে সনাক্ত ও লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতে বা ইন্টারনেটে ভিন্নমতের কণ্ঠস্বর দমন করতে সম্প্রদায়গত অভিযোগ বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগাতে সাহায্য করে?

এসজে: আমি মনে করি সময়ের সাথে সাথে সামাজিক গণমাধ্যমে বিশেষ করে টুইটারে লক্ষ্যবস্ততে পরিণত ও ট্রোল করা আরো সহজ হয়ে গেছে। তাই এখন পর্যন্ত ট্রোল প্রতিষ্ঠানগুলি নিয়ে আমার প্রতিবেদন থেকে আমি জানি: ভারতীয় ইন্টারনেটে হিন্দুত্বের অতি-ডান মতাদর্শ, হিন্দু আধিপত্যের এবং তাদের দল, ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এর সমালোচকদের খোঁজ, নজরদারি বা লক্ষ্যবস্তু করা একটি অতি-ডান স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী রয়েছে।

শিকারে থাকাকালীন হিন্দু অতি ডান স্বেচ্ছাসেবকরা আদর্শগতভাবে অতি ডানপন্থীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হিন্দু ধর্ম, ভারতীয় সেনাবাহিনী, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বা অন্য কোনো উগ্র হিন্দু প্রতীক সম্পর্কে মন্তব্য খোঁজ করে। তারা সমালোচক ও ভিন্নমত পোষণকারীদের মন্তব্যকে সংবেদনশীল ও জাতীয়তাবাদী প্রতীককে অপমান করার জন্যে জনগণের মধ্যে ক্ষোভ জাগিয়ে তুলতে ব্যবহার ও বিকৃত করে। এই প্রক্রিয়ায় তারা প্রায়শই ফটোশপ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এই জাতীয় অন্যান্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে।

হিন্দুরা বিপদের মধ্যে রয়েছে বলে মোদির সমালোচকরা হিন্দু সংস্কৃতি, প্রতীক ও নেতাদের লক্ষ্যবস্তু করছে এমন একটি আলোচ্য তৈরি করার চিন্তা তাদের মাথায় খেলা করে। অভ্যন্তরীণভাবে বিচারবহির্ভূত কাজগুলিকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্যে হিন্দুভীতি বা “হিন্দুরা বিপদে আছে” হলো বিজেপির পোষা একটি রাজনৈতিক প্রকল্প।

অতি-ডানপন্থী ট্রোলরা জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ জাগিয়ে তুলে ভুল ধারণাযুক্ত মন্তব্যগুলি ভাইরাল হওয়া নিশ্চিত করে। প্রায়শই কথোপকথনের ভারসাম্য খুবই হিংস্র হয় এবং এতে হিন্দু ডানপন্থীদের সমালোচকদের দিকে পরিচালিতধর্ষণ ও হত্যার হুমকিসহ যৌনভিত্তিক গালাগালি থাকে। এটিকে ভাইরাল করার প্রক্রিয়ায় প্রচুর কৃত্রিম ট্রোলও রয়েছে যার মধ্যে বেনামী অ্যাকাউন্ট ছাড়া পরিত্যাগযোগ্য অ্যাকাউন্ট এবং নীল টিক চিহ্নযুক্ত ব্যাপক অনুসরণকৃত প্রভাবশালী অ্যাকাউন্টও থাকে।

কৃত্রিম ট্রোলে একটি ছোট দল সামাজিক গণমাধ্যমে উচ্চস্বরে শব্দ করে অনেক লোক রাগান্বিত হওয়ার মতো একটি বিভ্রম নিশ্চিত করে যা তখন চরম ডানপন্থীদের সমালোচক ব্যক্তিটিকে বরখাস্ত করতে নিয়োগকর্তাদের চাপ দেওয়ার জন্যে ব্যবহৃত হয়। বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রেই চাপ এতোটাই বেশি হয় যে আইনের মৌলিক প্রয়োজনীয়তা পূরণ না করলেও পুলিশ ব্যক্তিটির বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ নথিভুক্ত করতেও বাধ্য হয়।

জিভি: গ্লোবাল ভয়েসেস অ্যাডভক্সে আমরা ডিজিটাল কর্তৃত্ববাদের উপর একটি গবেষণা প্রকল্প পরিচালনা করছি যা অনলাইন ও অফলাইনে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও মুক্ত সংবাদমাধ্যমকে কীভাবে আক্রমণ করা হয় তা পরীক্ষা করে। আমাদের অনুসন্ধান ইঙ্গিত করে সাংবাদিকদের উপর অনলাইন আক্রমণ ও রাজনৈতিক নিপীড়নের মধ্যে একটি সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। এই বিষয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কি?

এসজে: আমি মনে করি অনলাইন আক্রমণগুলো খুবই রাজনৈতিক প্রকৃতির। আমি মনে করি না এটিকে যা বলা যায় তা ছাড়া এটি বর্ণনা করার অন্য কোনো উপায় আছে। এটা রাজনৈতিক ট্রোল। ভারতের চরম ডানপন্থীদের সমালোচকদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক কর্মসূচি শক্তিশালী করার জন্যে এটা করা হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কিছু বলার জন্যে মানুষকে বরখাস্ত করা হয় এবং জেলে পাঠানো হয়।  একটি সমালোচনার এমন কঠোর প্রতিক্রিয়া নিজেই বলে দেয় যে রাজনৈতিক প্রভুদের সাথে ট্রোল প্রক্রিয়ার সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে।

শুধু এই প্রশ্নটির উত্তর দিন: ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করার জন্যে একজন অধ্যাপককে চাকরি থেকে সরিয়ে দিলে কার লাভ?

এই উত্তর উদ্দেশ্যটিকে প্রকাশ করবে।

জিভি: আপনি আপনার আসন্ন বই সম্পর্কে কিছু তথ্য দিতে পারেন কি? এতে পাঠকরা কী খুঁজে পাওয়ার আশা করতে পারে?

এসজে: আমার আসন্ন বইটি ট্রোলের শিকারদের গভীরভাবে বলা শুধু সাধারণ ট্রোল নয় বরং ভারতের রাজনৈতিক ট্রোলের একটি গল্প নিয়ে।

তারা সাধারণ মানুষ, উঁচু মাপের ব্যক্তি নন। তাদের উপর ট্রল আক্রমণ হলে তাদের কোনো সামাজিক সমর্থন থাকে না। ট্রোল কাকে বলে তারা জানেও না। এগুলি হলো সামাজিক গণমাধ্যমে ভারতের চরম ডানপন্থীদের বিরুদ্ধে মন্তব্য করার জন্যে — অনলাইন ও অফলাইন — চরম সহিংসতার মুখোমুখি হওয়া একজন বিমানচালক বা একজন শিক্ষকের মতো সাধারণ মানুষের বাস্তব গল্প। ভারতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে আপসের সময় এই সহিংসতা ঘটছে।

রাজনৈতিক ট্রোলের বাস্তবতাটি এতোটাই গুরুতর যে সমালোচনামূলক কিছু পোস্ট করলে মূল্য দিতে হবে জানার কারণে বছরের পর বছর ধরে খুবই কম লোক তাদের মনের কথা বলছে। তাই বইটি এই ধরনের পোস্ট নিয়ে। এটিকে “আপনার নিজ দায়িত্বে পোস্ট” বলা হয়।

আমি বইটি লিখছি কারণ আমি নিজেও এই অনলাইন আক্রমণের মুখোমুখি হয়েছি। আমি মারাত্মক রাজনৈতিক ট্রোলের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি। ট্রোলের এই ঘূর্ণিঝড়ের মাঝে আমি এই গল্পগুলি অবশ্যই প্রকাশ্যে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।

এখানে বিঘ্ন নেটওয়ার্ক গবেষণাগার আয়োজিত প্যানেলের একটি ভিডিও আছে যেখানে জাসওয়াল তার অনলাইন হয়রানির অভিজ্ঞতার পাশাপাশি বর্ণনা করেছেন কীভাবে এটি ব্যক্তিদের বিশেষ করে প্রান্তিক বা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকদের প্রভাবিত করতে পারে।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .