নেপালের প্রথম পাখি অভয়ারণ্যের সংস্কৃতি ও সংরক্ষণ

ঘোড়াঘোড়ি হ্রদ, নেপাল। উইকিমিডিয়া সাধারণের মাধ্যমে বিবেক১০১ এর ছবি। (সৃজনী সাধারণ অনুমতি একইরকম ব্যবহার ৪.০)।

নেপালের প্রথম পাখি অভয়ারণ্য ঘোড়াঘোড়ি হ্রদ কমপ্লেক্স বিপন্ন স্থানীয় এবং পরিযায়ী পাখি প্রজাতি উভয়ের জন্যে আবাসস্থল হিসেবে কাজ করে। তার ওপর এখানে একটি মন্দির রয়েছে যা পূজা ও বিয়েসহ বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান পালন করতে আসা স্থানীয়দের আকৃষ্ট করে। আগাহান পঞ্চমী ও মাঘী উৎসবের সময় মন্দিরটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আদিবাসী থারু লোকদের আকর্ষণ করে যারা সেখানে উপাসনার জন্যে জড়ো হয়।

ঘোড়াঘোড়ি হলো “ঘোড়া” এবং “ঘোড়ি” শব্দের সংমিশ্রণ, যার আক্ষরিক অর্থ যথাক্রমে পুরুষ ও মাদি ঘোড়া। একটি বিশ্বাস অনুসারে থারু সম্প্রদায় হ্রদের তীরে দেবীকে যে মাটির ঘোড়া নিবেদন করতো তা থেকে এই নামের উৎপত্তি। আরেকটি বিশ্বাস অনুসারে হ্রদটি এতোই বিস্তৃত যে একটি ঘোড়া একদিনে তার পুরো পরিসীমা পরিক্রম করতে পারে না বলে এই নামটি হয়েছিল। মন্দির ও আশেপাশের এলাকায় মাটির ঘোড়ার মূর্তি পাওয়া যায় যা ভক্তরা দেবীকে নিবেদন করে।

জীববৈচিত্র্যের একটি তীর্থকেন্দ্র

নেপালের দশটি রামসার এলাকার (আন্তর্জাতিক গুরুত্বের জলাভূমি) একটি হিসেবে স্বীকৃত ঘোড়াঘোড়ি হ্রদের বিস্তৃতি মোট ২,৫৬৩ হেক্টর (প্রায় ৬,৩৩৩ একর)। ঘোড়াঘোড়ি হ্রদ কমপ্লেক্সে ২৪টি আলাদা হ্রদ রয়েছে। হ্রদগুলির মধ্যে ঘোড়াঘোড়ি, নাখরোদি, বুধিয়া নাখরোদ, বাইনসাহুয়া, ওজাহুওয়া, রামফল, সানোপোখারি, তেহরি, চন্দ্রবিজুয়া ও পারসিহিনিয়ার ক্ষেত্রফল এক হেক্টরের বেশি, অর্থাৎ এগুলির আকার ১ থেকে ৭৭.৫ হেক্টর পর্যন্ত।

হ্রদ এলাকাটিতে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রজাতির বসবাস যার মধ্যে ভীষণ বিপন্ন লাল-মুকুট ও ছাদযুক্ত কচ্ছপ (Kachuga kachuga) এবং তিন ডোরাকাটা ছাদযুক্ত কচ্ছপ (Kachuga dhongka), একটি বিরল বন্য চাল (Hygrohiza aristata) সহ বিপন্ন অর্কিড (Aerides odorata) এবং বিপন্ন ও পবিত্র পদ্ম (Nelumbo nucifera) রয়েছে। উপরন্তু, অঞ্চলটি অন্যান্য বিভিন্ন প্রাণী, সরীসৃপ ও পাখির বাসস্থান।

গ্লোবাল ভয়েসেসের সাথে মুখোমুখি সাক্ষাৎকারের সময় নেপালের পাখি সংরক্ষণের পক্ষীবিদ হিরুলাল ডাঙ্গাউরা বলেছেন তিনটি পাখির প্রজাতি, বিশেষ করে সাধারণ মুরহেন (Gallinula chloropus), ছিটে ঠোঁটের হাঁস (Anas aoecilorhyncha) এবং তুলট বেঁটে রাজহাঁস (Nettapus coromandelianus) শুধুই নেপালের ঘোড়াঘোড়ি হ্রদ এলাকায় বংশ বৃদ্ধি করে। ডাঙ্গাউড়া ২০০৯ সাল থেকে ঘোড়াঘোড়ি হ্রদ এলাকায় জলজ পাখি শুমারি পরিচালনা করছেন।

তিনি আরো উল্লেখ করেন ঘোড়াঘোড়ি হ্রদ এলাকায় পরিযায়ী ও স্থানীয় মিলে মোট ৩৬০টি পাখির প্রজাতি রয়েছে। প্রজাতিগুলির মধ্যে ১৩টি আইইউসিএন ২০২২ শ্রেণীবিভাগ অনুসারে বিশ্বব্যাপী হুমকির মুখোমুখি হিসেবে চিহ্নিত। একইভাবে ঘোড়াঘোড়ি হ্রদ এলাকার ৫৮টি প্রজাতিকে জাতীয়ভাবে হুমকির মুখে বিবেচনা করা হয়।

হ্রদ এলাকাটির বাস্তুতন্ত্র হুমকির মুখে। কৃষকদের কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের ব্যাপক ব্যবহারের ফলে জলাশয়গুলিতে ইউট্রোফিকেশন (ক্রমগতভাবে কীটনাশক শোষণ) ঘটেছে। অধিকন্তু, পাহাড়ি অঞ্চল থেকে স্থানান্তরের কারণে এলাকার জনসংখ্যা দ্রুত বাড়ার ফলে জলজ সম্পদের অত্যধিক ব্যবহার, অত্যধিক গোচারণ ও প্রতি বছর হ্রদ পরিদর্শনকারী হাজার হাজার দেশীয় পর্যটকদের থেকে বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। সম্মিলিতভাবে, এই সমস্যাগুলি হ্রদের বাস্তুতন্ত্রের স্বাস্থ্য ও কল্যাণকে হুমকির মুখে ফেলেছে।

#ঘোড়াঘোড়ি #হ্রদ এলাকা, #কাইলাই জেলা, #সুদুরপাশ্চিম প্রদেশ, #নেপাল। আপনি কি ২০০৩ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে হ্রদ এলাকায় পরিবর্তন দেখতে পান? #বন এলাকা ২০০৩ এর চেয়ে ঘন দেখানোটা আকর্ষণীয়। হ্রদ এলাকার #তৃণভূমির কিছু অংশও #কৃষি জমিতে রূপান্তরিত দেখা যাচ্ছে।

সংরক্ষণে সংস্কৃতির গুরুত্ব

ঘোড়াঘোড়ি হ্রদ এলাকাটি আদিবাসী থারুদের কাছে সাংস্কৃতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং মন্দির এলাকায় – বিশেষ করে উৎসবের সময় – জনসমাগম, এমনকি অ-থারুদেরও আগমন ঘটে। তবে হ্রদের বাস্তুতন্ত্রের অবক্ষয়ে অবদান রাখতে পারে বলে বিশেষ করে এই উৎসবগুলির সময় জনসমাগম বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে।

ঘোড়াঘোড়ি মন্দিরের ভিতরে ঘোড়ার মূর্তি। ব্যবহারকারী রাজেশ ধুঙ্গানার ছবি, উইকিমিডিয়া সাধারণ থেকে নেওয়া। (সৃজনী সাধারণ অনুমতি একইরকম ব্যবহার ৪.০)

একটি মুখোমুখি সাক্ষাৎকারে হ্রদ এলাকায় সংরক্ষণ উদ্যোগের নেতৃত্ব প্রদানকারী সংরক্ষণবাদী আনন্দ চৌধরী গ্লোবাল ভয়েসেসকে বলেছেন:

আমার মতে ঘোড়াঘোড়ি হ্রদ এলাকার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব এর সংরক্ষণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। বিপরীতক্রমে অন্যান্য হ্রদগুলির বেশিরভাগ (ঘোড়াঘোড়ি ব্যবস্থাপনার বাইরে) চাষ বা বাণিজ্যিক মাছ ধরার উদ্দেশ্যে নিষ্কাশন করা হয়েছে।

মন্দির এলাকা ও পর্যটকদের সৃষ্ট দূষণ সম্পর্কে উদ্বেগ থাকলেও আমি মনে করি এর জন্যে মন্দির এলাকায় ঘটমান প্রধানত অ-থারু সংস্কৃতি বা সাংস্কৃতিক দখল দায়ী। এসব সত্ত্বেও মন্দিরটি অ-থারুদের মধ্যেও সমভাবে জনপ্রিয় বলে মনে হয়।

সর্বোপরি আমি মনে করি হ্রদটির সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় তাৎপর্য এর বাস্তুতন্ত্র ও পাখির আবাসস্থল সংরক্ষণে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে।

জৈবিক বৈচিত্র্যের সনদ অনুসারে এই চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলি সংরক্ষণ বা টেকসই ব্যবহারের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ও ঐতিহ্যগত সাংস্কৃতিক চর্চা (জাতিসংঘ, ১৯৯২) অনুসারে জৈবিক সম্পদের প্রথাগত ব্যবহার সুরক্ষা ও উৎসাহিত করতে বাধ্য।

সাম্প্রতিক সময়ে সংরক্ষণ সংস্থাগুলি তাদের সংরক্ষণ প্রচেষ্টার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে একীভূত করছে। এটি স্থানীয় আদিবাসী সম্প্রদায়ের অধিকারের সম্মান নিশ্চিত করতে এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের মূল্য সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে সাহায্য করে।

সংরক্ষণের জন্যে সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের প্রতিফলন: বাস্তবায়নের ২০ বছরের শিক্ষা” সমীক্ষা অনুসারে, সংরক্ষণ প্রচেষ্টায় সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে একীভূত করা স্থানীয় সম্প্রদায়ের সংরক্ষণ ও কল্যাণ উভয় ক্ষেত্রেই সুবিধা দিতে পারে। লাইবেরিয়ার পিসো হ্রদ অঞ্চলে এর একটি উদাহরণ দেখা যেতে পারে, যেখানে গোরস্থান, অনুষ্ঠান এবং গোপন সমাজের জন্যে মনোনীত স্থানগুলি বনকে খণ্ড খণ্ড হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা পেতে সাহায্য করেছে।

একইভাবে উগান্ডার রয়েনজোরি জাতীয় উদ্যানে বাকোঞ্জো বা পর্বত সম্প্রদায়ের আচার-অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত পবিত্র স্থান ও সংস্থানগুলিতে প্রবেশাধিকারের বিষয়ে আলোচনা ও সম্মতির মাধ্যমে সাংস্কৃতিক চর্চার একীভূতকরণ স্বীকৃত হয়েছে। প্রবেশাধিকার পরিচালনার জন্যে ঐতিহ্যবাহী নেতাদের ভূমিকা উদ্যানটির ব্যবস্থাপনা কাঠামোতে একীভূত করা হয়েছে

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .