আজারবাইজান-ইরান উত্তেজনা বাড়ছে

গুগল মানচিত্র থেকে নেওয়া পর্দাছবি।

শেষবার ২০২২ সালের নভেম্বরে আজারবাইজান ও ইরান যুদ্ধংদেহী মনোভাব ও শত্রুতামূলক বক্তব্য বিনিময় করে। সেসময় আজারবাইজানের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা পরিষেবা (এসএসএস) আজারবাইজানি অঞ্চলে ব্ল্যাকমেল এবং অন্যান্য হিংসাত্মক কাজ চালানোর জন্যে প্রশিক্ষিত বলে কথিত ১৯ জনের একটি দলকে আটক করে। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা পরিষেবা দাবি করেছে গোষ্ঠীটি ইরানের বিশেষ পরিষেবা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং সশস্ত্র ছিল। এরপর ইরান কর্তৃপক্ষ একজন আজারবাইজানীয় ব্যক্তিকে শাহ চেরাগ মন্দিরে হামলার পরিকল্পনার জন্যে অভিযুক্ত করে যাতে ১৫ জন নিহত ও ৪০ জন আহত হয়। ইরানের রাজধানী তেহরানে ২০২৩ সালের জানুয়ারি আজারবাইজানি দূতাবাসে একজন বন্দুকধারী হামলা চালালে এবারের উত্তেজনা বৃদ্ধি পেতে থাকে। বন্দুকধারী নিরাপত্তা প্রধানকে হত্যা ও দূতাবাসের দুইজন রক্ষীকে আহত করে। হামলার পর আজারবাইজানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্মী ও তাদের পরিবারকে সরিয়ে নেয়। এরপর থেকেই উত্তেজনা বাড়তে থাকে। সর্বশেষ উত্তেজনায় আজারবাইজান ৬ এপ্রিল ইরানের চার কূটনীতিককে অবাঞ্ছিত ঘোষণাবহিষ্কার করে।

এর আগে ২৮ মার্চ আজারবাইজানীয় সাংসদ ফাজিল মোস্তফাকে তার বাড়ির বাইরে গুলি করা হয়। কাঁধ ও উরুতে ক্ষত নিয়ে হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া সাংসদ ইরানের সমালোচনার জন্যে পরিচিত। এই আইনপ্রণেতা ইরানকে “সন্ত্রাসী রাষ্ট্র” বলেছেন বলে কথিত রয়েছ। আজারবাইজান রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা পরিষেবা ২৭ মার্চ সরকারি টেলিভিশনের একটি সম্প্রচারে বলেছে এটি একজন সুপরিচিত সরকারি ব্যক্তিত্বকে হত্যার পূর্বাভাস।

মোস্তফার উপর হামলার দুইদিন পর আজারবাইজানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেহুন বায়রামভ জেরুজালেমে আজারবাইজানের দূতাবাস খোলার জন্যে ইসরায়েলে গেলে পারস্পরিক অভিযোগ সমানে সমান হয়। ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে দীর্ঘদিনের বিরোধ চলার কারণে কিছু আজারবাইজানীয় সাংসদ এই সাংসদের উপর হামলার সময়কে দূতাবাস খোলার সাথে সংযুক্ত করে উপসংহারে তেহরানকেই অপরাধী ভাবছে। মেদান টিভির প্রতিবেদন অনুসারে আজারবাইজানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদমাধ্যম সচিব একটি পৃথক বিবৃতি জারি করে বলেছেন তদন্তের প্রাথমিক ফলাফলগুলি এই হামলায় ইরান জড়িত থাকার ইঙ্গিত করে।

দূতাবাস খোলার পর কঠোর নিন্দা জানিয়েছে ইরান। যেমন প্রথমে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নাসির কানানি বলেছেন দূতাবাসের উদ্বোধনের সময় ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এলি কোহেনের ইসরায়েল ও আজারবাইজানকে “ইরানের বিরুদ্ধে অবশ্যই একসাথে কাজ করতে হবে” বলার মধ্যে “ভেতর ভেতর ইরান-বিরোধী অভিযোজন নিশ্চিতকরণ” রয়েছে বলে তিনি আজারবাইজানের কাছ থেকে এর আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা দাবি করেন। এরপর ইরানের স্থল বাহিনীর অধিনায়ক কিউমারস হায়দারি বলেছেন ইরান তার সীমান্তে “জায়নবাদী উপাদান” সহ্য করবে না। এছাড়াও হায়দারি ২০২০ সালে দ্বিতীয় কারাবাখ যুদ্ধে সিরীয় যোদ্ধাদের মোতায়েন করার জন্যে আজারবাইজানকে অভিযুক্ত করেছেন। আজারবাইজানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় হেদারির অভিযোগের নিন্দা করেছে

আজারবাইজান-ইরান রাষ্ট্রের সীমান্ত বরাবর ১১ মার্চ তারিখে ইরানের সামরিক বিমানের উড্ডয়নের পরে আজারবাইজানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাথে একটি যৌথ বিবৃতিতে ইরানের উস্কানির নিন্দা করে বলেছে, “আজারবাইজানের স্বাধীন অঞ্চলের উপর দিয়ে আধা ঘন্টারও বেশি সময় ধরে একটি সামরিক বিমান ওড়া আজারবাইজানের প্রতি একটি উস্কানি ও অবন্ধুত্বসুলভ আচরণ।” বিবৃতিতে আজারবাইজান সীমান্তে ২০২২ সালের ১৭ অক্টোবরে শুরু হওয়া ইরানের সামরিক মহড়ারও উল্লেখ করা হয়েছে।

জানুয়ারির শেষ থেকে “ইরানী গুপ্তচর” চিহ্নিত করে গ্রেপ্তারের ধারাবাহিকতার সর্বশেষ হিসেবে আজারবাইজানীয় রাষ্ট্র ৬ এপ্রিল ইরানের গোয়েন্দা বাহিনীর সাথে সংযুক্ত দাবি করে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে। বেসরকারি তথ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে মেয়দান টিভি ৩ এপ্রিল জানিয়েছে ইরানের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে তেহরানে আজারবাইজানের দূতাবাসে হামলার পর থেকে ৪০০ জনের মতো বিশ্বাসীকে আটক করা হয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে বেশিরভাগের বিরুদ্ধে মাদক রাখার অভিযোগ আনা হয়েছে

ইরান আজারবাইজানকে ইসরায়েলের প্রতিনিধিত্বকারী বিবেচনা করে। উভয় দেশ একটি সামরিক জোটের অংশীদার এবং আজারবাইজান ইসরায়েলি সামরিকনজরদারি সরঞ্জাম পেয়েছে।

আপনার সাধারণ প্রতিবেশী নয়

ইরান ও আজারবাইজান ৭০০ কিলোমিটার সীমান্ত দিয়ে বিভক্ত। ১৯৯৪ সালের যুদ্ধবিরতিতে শেষ হওয়া প্রথম কারাবাখ যুদ্ধের পর এই ভূখণ্ডের কিছু অংশ ও প্রবেশের রাস্তাগুলি আর্মেনিয়ার নিয়ন্ত্রণে ছিল। ২০২০ সালে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে ৪৪ দিনের দ্বিতীয় নাগর্নো-কারাবাখ যুদ্ধের পরে আজারবাইজান ইরানের সীমান্তে প্রবেশের রাস্তা ও ভূমিসহ এই ভূখণ্ডের বিশাল অংশের উপর নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করে। আজারবাইজান ২০২০ সালের যুদ্ধে আর্মেনিয়াকে তেহরানের সমর্থনের ধারণার প্রতিও বিরক্তি প্রকাশ করেছে।

এসব সত্ত্বেও আজারবাইজান ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে আজারবাইজানের নিয়ন্ত্রণে থাকা রাস্তাগুলি ব্যবহারকারী ইরানী ট্রাকগুলির উপর সড়ক কর আরোপের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সম্পর্ক কিছুটা স্বাভাবিক ছিল। আর্মেনিয়া সেই রাস্তাগুলি নিয়ন্ত্রণের সময় কোন কর প্রদান না করেই যানবাহনগুলি অবাধে যেতে পারতো। উত্তর ইরানে ইরানের বৃহত্তম অপারসিক সংখ্যালঘু জাতিগত আজারবাইজানিদের সমস্যাও রয়েছে।

২০২০ সালে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে যুদ্ধের সময় জাতিগত আজারবাইজানিরা ইরানের বেশ কয়েকটি শহরে যুদ্ধের সমর্থনে বিক্ষোভের আয়োজন করে। দীর্ঘদিন ধরে আজারবাইজানের তার প্রতিবেশী “ইরানের তুর্কি-ভাষী আজেরি জনগোষ্ঠীর মধ্যে অসন্তোষ জাগিয়ে তোলার দায়ে অভিযুক্ত। ২০২২ সালের গ্রীষ্ম থেকে আজারবাইজানের সরকারপন্থী সংবাদপত্রগুলি উত্তরাধিকারের আহ্বান সম্পর্কে আরো সোচ্চার হয়েছে এবং আজারবাইজান দক্ষিণ আজারবাইজানে (বা উত্তর ইরানে) একটি “জাতীয়-মুক্তি আন্দোলনের”  পক্ষে সমর্থন বাড়িয়েছে।”

তবে ফাজিল মোস্তফাকে সত্যিই ইরানপন্থী গুপ্তচররা গুলি করেছে বা এমনকি তাকে আদৌ গুলি করা হয়েছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কিছু কিছু রাজনৈতিক কর্মী বিশ্বাসীদের গণগ্রেপ্তার ও আটকের সাথে রাষ্ট্র বর্ণিত “আজারবাইজানে একটি শরিয়া রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিরোধ দল” এর সাথে কোন সংশ্রব নেই, বরং এটি আসলে ইরানকে হুমকি দেওয়ার এবং একটি বার্তা পাঠানোর প্রচেষ্টা বলে ইঙ্গিত দিয়েছে। গ্রেপ্তারকৃত মুমিনের পরিবারের এক সদস্য বলেছেন গ্রেপ্তারকৃতদের অধিকাংশের কাছে মাদক প্রাপ্তির অভিযোগও হাস্যকর “প্রথমত, তাদের কথামতো একটি রাষ্ট্রের এতোগুলি নাগরিক অন্য রাষ্ট্রের গুপ্তচর হওয়াটা রাষ্ট্রটির জন্যে লজ্জাজনক। দ্বিতীয়ত, এতোজন ধর্মীয় নেশাখোরের মাদক ব্যবসায়ী হয়ে ওঠা কীভাবে সম্ভব? এর চেয়ে হাস্যকর আর কিছুই হতে পারে না?!”

তেহরান টাইমসের এই গল্প অনুসারে বার্তাটি ভালভাবে গ্রহণ করা হয়নি। ইউক্রেনের যুদ্ধে পশ্চিমা সমর্থন হারানো তার মিত্রদের থেকে বাকুর শিক্ষা নেওয়া উচিত। সাদেগ ফেরেদৌনাবাদীর ৯ এপ্রিল তারিখের নিবন্ধটি পড়ুন।

আরেকটি আঞ্চলিক যুদ্ধের সম্ভাবনা

কিন্তু তেহরান-ভিত্তিক ককেশিয়া ও মধ্য এশিয়া বিশ্লেষক ভালি কালেজির মতে এই উত্তেজনাকর পরিস্থিতি প্রকৃত যুদ্ধাবস্থার দিকে নিয়ে যাওয়াটা অসম্ভব্। আলজাজিরার সাথে একটি সাক্ষাৎকারে কালেজি বলেছেন “সাম্প্রতিক উত্তেজনাগুলি খুব গুরুতর হলেও সামরিক সংঘর্ষ না হওয়ার অনেক কারণের মধ্যে পারস্পরিক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য নির্ভরতা, ইরান, আজারবাইজান ও রাশিয়ার মধ্যে ট্রানজিট রুট এবং আজারবাইজানের নাখচিভানে পৌঁছাতে ইরানের যোগাযোগ রুটের উপর নির্ভরতা রয়েছে।” নাখচিভান আর্মেনিয়া, তুরস্ক ও ইরানের মধ্যবর্তী আজারবাইজানের একটি প্রত্যন্ত ছিটমহল।

মোহাম্মদ আয়াতুল্লাহি তাবারের মতে ইরান সাম্প্রতিক মাসগুলিতে ইরাকের কুর্দি-অধ্যুষিত অঞ্চগুলিতে  ইসরায়েলি “কৌশলগত কেন্দ্রগুলির” (ইরাকি কুর্দি কর্মকর্তারা এধরনের ঘাঁটির অস্তিত্বের দাবি অস্বীকার করেছে) বিরুদ্ধে চালানো অভিযানের মতো “আজারবাইজানে ইসরায়েলি ঘাঁটি রয়েছে দাবি করে তার উপর ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার পথ বেছে নিতে পারে। তারপর আজারবাইজান ও ইসরাইল – সম্ভবত তুরস্কের সহযোগিতায় -ইরানে জাতিগত আজেরিদের মধ্যে বিদ্রোহ উস্কে দিতে পারে যা পালাক্রমে আজারবাইজানে ইরানি সামরিক বাহিনী প্রবেশে প্ররোচিত করতে পারে।”

আজারবাইজান ও ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ৮ এপ্রিল সাম্প্রতিক উত্তেজনা নিয়ে ফোনে কথা বলেছে। মন্ত্রণালয়ের কথোপকথনের পৃথক বর্ণনায় দু'জন ভুল বোঝাবুঝি নিয়ে কথা বলে আলোচনা অব্যাহত রাখার গুরুত্ব উল্লেখ করেছে। তুরান নিউজ এজেন্সির সাথে কথা বলার সময় আজারবাইজানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী তোফিগ জুলফুগারভ ৮ এপ্রিল ফোনালাপকে একটি ইতিবাচক লক্ষণ বলেছেন। প্রাক্তন মন্ত্রী উত্তেজনা ছড়ানোর জন্যে আইআরজিসি (ইসলামি বিপ্লবী রক্ষী কোর) এবং ইরানের সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক নেতাকে দোষারোপ করলেও ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও রাজনৈতিক অভিজাতরা এসব উত্তেজনায় আগ্রহী নয়। জুলফুগারভ বলেছেন, “উত্তেজনার আরো বৃদ্ধি ইরান বা আজারবাইজানের জন্যে যে ভালো নয় তা নিয়ে একটি বোঝাপড়া রয়েছে।” এদিকে তুরান নিউজ এজেন্সির প্রতিবেদন অনুসারে, ১০ এপ্রিল আরেকজন ধর্মীয় কর্মীকে আটক করা হয়েছে।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .