মিয়ানমারে অভ্যুত্থান পরবর্তী ইন্টারনেট বন্ধে জীবন বিপন্ন ও মানবিক কর্ম ব্যহত

পিক্সাবে লাইসেন্সের অধীনে পিক্সাবেস্তেফানের একটি ছবি ব্যবহার করে অমেয়া নাগরাজন ছবিটি তৈরি করেছেন।

সামরিক সর্বাধিনায়ক জ্যেষ্ঠ্য জেনারেল মিন অং হ্লাইঞ্জের নেতৃত্বে অভ্যুত্থানের প্রায় দুই বছর পর মিয়ানমারের বেশিরভাগ অংশে ইন্টারনেট বন্ধ, নিয়ন্ত্রিত ও বিঘ্ন চলছে। জান্তা সামরিক বাহিনীর সশস্ত্র প্রতিরোধ গোষ্ঠীর কঠোর প্রতিরোধের পাশাপাশি গুরুতর অফলাইন দমনাভিযানের মুখে পড়া অঞ্চলগুলিকে লক্ষ্যবস্তু করে ইন্টারনেট বন্ধ আরোপের করেছে। ২০২২ সালের ৭ জুন তারিখে জাতিসংঘ প্রকাশিত একটি প্রেস বিবৃতিতে বলা হয়েছে ২০২১ সালের আগস্ট থেকে মিয়ানমারের সাতটি রাজ্য ও অঞ্চলের ৩১টি শহরতলী সম্পূর্ণ ইন্টারনেট বন্ধ এবং আরো ২৩টি শহরতলী ইন্টারনেট সীমাবদ্ধের অভিজ্ঞতা পেয়েছে। ফ্রিডম হাউসের মতে ইয়াঙ্গুন অঞ্চল, মান্দালয় অঞ্চল, চিন রাজ্য, ম্যাগওয়ে অঞ্চল এবং তানিনথারি অঞ্চলে লক্ষ লক্ষ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীকে প্রভাবিত করা ইন্টারনেট বিচ্ছিন্নতার খবর পাওয়া গেছে। মিয়ানমারের জান্তা সৈন্য ও প্রতিরোধ বাহিনীর মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষের বিশেষভাবে সাগাইং অঞ্চলে ইন্টারনেট বিচ্ছিন্নতা মারাত্মক ছিল।

ইন্টারনেট বন্ধ ও নিয়ন্ত্রণের এই দমনমূলক কৌশলটি সামরিক খেলায় নতুন নয় – অভ্যুত্থানের আগে তারা এটি ২০১৯ সালের জুন মাসে ব্যবহার করেছিল রাখাইন ও চিন রাজ্যের সংঘাতময় এলাকায় রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সামরিক নিরাপত্তা বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘন ও সংঘটিত নৃশংসতা ধামাচাপা দেওয়ার জন্যে। দুই বছর স্থায়ী এবং সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে বসবাসকারী ১৪ লক্ষ মানুষকে প্রভাবিত করা এই ইন্টারনেট বন্ধটিকে বিশ্বের দীর্ঘতম ইন্টারনেট বন্ধ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। সেই সময় সামরিক বাহিনী সংঘাতপূর্ণ এলাকায় “নিরাপত্তা পরিস্থিতি”র উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত “স্থিতিশীলতা ও আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্যে” সংযোগ বিঘ্নিত করার দাবি করেছিল। কর্তৃপক্ষ বন্ধগুলিকে “শান্তি বিঘ্ন মোকাবেলা এবং অবৈধ কার্যকলাপের সমন্বয়ের জন্যে ইন্টারনেট পরিষেবার ব্যবহার” হিসেবে ন্যায্যতা দিয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট ও যোগাযোগ বন্ধের জায়গাগুলিতে নিরস্ত্র বেসামরিকদের হত্যা ও আহত, নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত মৃত্যুদণ্ড, জোরপূর্বক গুম, বলপূর্বক শ্রম এবং আরো অনেক কিছুর জন্যে বেআইনি ও নির্বিচারে হামলাসহ মিয়ানমারের সামরিক নিরাপত্তা বাহিনী সংঘটিত আন্তর্জাতিক মানবিক আইন ও মানবাধিকার আইনের গুরুতর লঙ্ঘন নথিভুক্ত করেছে। অভ্যুত্থান-পরবর্তী প্রেক্ষাপটে প্রতিরোধের শক্ত ঘাঁটি অঞ্চলগুলিতে “জননিরাপত্তার” নামে ইন্টারনেট ও টেলিযোগাযোগ বন্ধ” করে শুদ্ধি অভিযান” চালু করার সামরিক কৌশল ব্যবহারের চর্চা ও নকশা অব্যাহত রয়েছে।

সামরিক জান্তা-নিয়ন্ত্রিত পরিবহন ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ২০২২ সালের ৩ মার্চ চারটি শহুরে এলাকা ছাড়া সাগাইং অঞ্চলের বেশিরভাগ অংশে অনির্দিষ্টকালের জন্যে ইন্টারনেটে প্রবেশাধিকার বন্ধ রাখার আদেশ জারি করে। এই ইন্টারনেট বন্ধ ও নিয়ন্ত্রণের ফলে গ্রামগুলিতে সামরিক আক্রমণ ও অভিযান বেড়ে গিয়ে প্রায়শই বেসামরিক লোক হত্যা, বাড়িঘর ও খামার পোড়ানো এবং অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে। সাগাইংয়ের ৩৪টি শহরতলীর মধ্যে আটটি নিয়মিত ইন্টারনেট বন্ধের মুখোমুখি হয়, অন্য শহরতলীগুলিতে শুধু ২জি সংযোগ ছিল। ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ২৬ মে, 2022 তারিখের মধ্যে সারাদেশে ধ্বংসপ্রাপ্ত মোট ২২,২৯৯টি বাড়ি বা ভবনের মধ্যে শুধু সাগাইং অঞ্চলের ২৮টি শহরতলীর (অঞ্চলের মতো মিয়ানমারের একটি প্রশাসনিক বিভাগ) ১৫,৫৩০টি বাড়ি অগ্নিসংযোগ বা ধ্বংস করা হয়েছে বলে নথিভুক্ত করা হয়েছে

একইভাবে কাচিন রাজ্যের হপাকান্ত শহরতলীতে কাচিন স্বাধীনতা বাহিনী (কেআইএ) এবং স্থানীয় জনসুরক্ষা বাহিনীর (পিডিএফ) আক্রমণ মোকাবেলায় এই এলাকায় একটি সামরিক অভিযান শুরু করার জন্যে জান্তা ২০২১ সালের আগস্টে ইন্টারনেটে প্রবেশাধিকার বন্ধ করে দেয়। এর কিছুদিন পরে উত্তর-পশ্চিম মিয়ানমারের আরো ১১টি শহরতলীতে মোবাইল ইন্টারনেট ও ওয়াইফাই পরিষেবা বিচ্ছিন্নসহ ইন্টারনেট বন্ধ – – অব্যাহত রয়েছে। এখনি মিয়ানমারের প্রতিবেদন অনু্সারে ক্ষতিগ্রস্ত জনপদগুলির মধ্যে রয়েছে ম্যাগওয়ে অঞ্চলের গাংগাও, হিটিলিন এবং মিয়াইং এবং চিন রাজ্যের ফালাম, কানপেটলেট, মাতুপি, মিন্দাত, পালেতওয়া, তেদিম, থান্টলাং এবং টোনজাং। মিয়ানমারের সামরিক যুদ্ধবিমান হামলা করে ২০২২ সালের ২৩ অক্টোবর রাত ৮:৩০ টায় কাচিন রাজ্যের হপাকান্ত শহরের কানসি গ্রামে কাচিন স্বাধীনতা সংস্থার (কেআইও) বার্ষিকী উদযাপনে যোগদানকারী গায়ক ও সংগীতশিল্পীসহ কমপক্ষে ৮০জনকে হত্যা করে। বিমান হামলায় প্রকাশ্য কনসার্টে যোগদানকারী প্রায় ১০০জন আহত হয়। জীবন রক্ষাকারী সহায়তা প্রদানের জন্যে মানবিক সাহায্য ও ত্রাণ গোষ্ঠীগুলিকে আক্রান্ত স্থানে পৌঁছাতে বাধা দেওয়ার জন্যে সামরিক জান্তা রাস্তার যোগাযোগ অবরোধ করেছিল বলে জানা গেছে। ইচ্ছাকৃত যোগাযোগ বন্ধের কারণে স্থানীয় গণমাধ্যমগুলি এই গণহত্যা সম্পর্কে অনেক পরে তথ্য পাওয়ায় ২৪ অক্টোবর তারিখে এটি সম্পর্কে প্রতিবেদন করে।

ইন্টারনেট বন্ধ স্থানীয়দের পক্ষে এই অঞ্চলের অবস্থার তথ্য পাঠানো এবং গ্রহণ, সামরিক শাসকগোষ্ঠী সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিবেদন, মানবিক ব্যবসার জন্যে তহবিল সংগ্রহ, সামরিক বাহিনীর গতিবিধি সম্পর্কে তথ্য পাঠানো এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবিকা, এবং অন্যান্য মৌলিক চাহিদায় প্রবেশাধিকারকে কঠিন করে তুলেছে। সংঘাতপূর্ণ এলাকায়, তথ্যের অনলাইন প্রবেশাধিকার জীবন ও মৃত্যুর মধ্যে পার্থক্য তৈরি করতে পারে। মিয়ানমারের জনগণ প্রায়শই মোবাইল ফোনে কথা বলার চেয়ে বেশি নিরাপদ বলে মনে করা ফেসবুক মেসেঞ্জার বা হোয়াটসঅ্যাপের মতো টেলিযোগাযোগ চ্যানেলের মাধ্যমে আসন্ন অভিযানের সতর্কতা ভাগাভাগি করতে না পারায় ইন্টারনেট বন্ধ জনগণকে সেনাবাহিনীর অভিযান থেকে পালাতে বাধা দিয়েছে। রেডিও মুক্ত এশিয়ার সাথে একটি সাক্ষাৎকারে ম্যাগওয়ে ডিভিশনের গঙ্গাও শহরতলীর হানান খার গ্রামের বাসিন্দারা এই এলাকায় ইন্টারনেট বন্ধের বিষয়ে বলেছে “তথ্যের প্রবাহ না থাকায় জনগণকে [অভিযানের আগে] সতর্ক করা যায়নি বলে তারা পাহারা, গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয়েছে। আমরা জান্তা সৈন্যদের মানুষ হত্যা ও গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়ার মতো যা খুশি তাই করতে দেখেছি।”

তারা আরো বলেছে সংঘর্ষ চলা বেশিরভাগ জায়গায় ইন্টারনেট না থাকায় সামরিক বাহিনী সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘন ও যুদ্ধাপরাধের আলোকচিত্র ও ভিডিওর মতো প্রমাণ পাঠানোর কোনো উপায় নেই। মোবাইল পরিশোধের পরিষেবাগুলি সীমাবদ্ধ বা বন্ধ থাকায় অনুদান সংগ্রহ বা অর্থ স্থানান্তর বা তহবিল গ্রহণ অসম্ভব হয়ে পড়ছে। সংঘাতময় এলাকার খুব কম তথ্য পাওয়া যাওয়ায় সরেজমিন পরিস্থিতি সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। জান্তা পরিচালিত যোগাযোগ বন্ধের কারণে মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ সংগ্রহ, মানবিক সংকট পর্যবেক্ষণ ও সাহায্য প্রদান এবং সময়মতো সাংবাদিকদের সেই এলাকাগুলির ঘটনা ও রাজনৈতিক উন্নয়ন সম্পর্কে জানানো মানবিক কর্মীদের জন্যে আরো কঠিন হয়ে উঠেছে।

জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক সমন্বয়ের কার্যালয় (ইউএনওসিএইচএ) জানিয়েছে ২০২২ সালের শেষ পর্যন্ত নিরাপত্তাহীনতা ও সহিংসতার কারণে মিয়ানমারে বাস্তুচ্যুত ১৪ লক্ষেরও বেশি মানুষের মধ্যে ১১ লক্ষেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে সামরিক অভ্যুত্থান্টির পর। এটি আরো জানিয়েছে মানবিক ও সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তা বাড়লেও এখন পর্যন্ত অপর্যাপ্ত মানবিক সাড়া মাত্র ২৮ শতাংশ। খাদ্য, বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষায় প্রবেশাধিকারের মতো তথ্য ও যোগাযোগে প্রবেশাধিকার একটি মৌলিক চাহিদা ও একটি মৌলিক মানবাধিকার। দেশের সংঘাত-প্রবণ এলাকায় ইন্টারনেট বন্ধ একটি জটিল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতনতা বজায় রাখার জন্যে নাগরিক সমাজের গোষ্ঠীস্বাধীন গণমাধ্যমের কাজ সত্ত্বেও মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত মানুষ ও সংঘাত-আক্রান্ত এলাকায় বসবাসকারীদের জন্যে ইন্টারনেট প্রবেশাধিকার পুনরুদ্ধারে জাতিসংঘ, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বা সম্প্রদায়গুলি খুব কমই করতে পেরেছে।

পরাধীনতা পর্যবেক্ষক থেকে আরো কিছুর জন্যে অনুগ্রহ করে প্রকল্প পৃষ্ঠা দেখুন।

 

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .