- Global Voices বাংলা ভার্সন - https://bn.globalvoices.org -

ফেসবুকের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের জান্তার যুদ্ধ

বিষয়বস্তু: মায়ানমার (বার্মা), নাগরিক মাধ্যম, প্রচার মাধ্যম ও সাংবাদিকতা, প্রতিবাদ, বাক স্বাধীনতা, রাজনীতি, জিভি এডভোকেসী, Unfreedom Monitor

ছবি সৌজন্যে অমেয়া নাগরাজন

স্থানীয় সামরিক কর্তৃপক্ষ ২০২২ সালের ৯ এপ্রিল তারিখে জাও জাও নামের মিয়ানমারের একজন ফটো সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করে [1] এক মাসেরও বেশি সময় কুখ্যাত মান্দালয় প্রাসাদ জিজ্ঞাসাবাদ কেন্দ্রে [2] আটক রাখার পরে মে মাসে মান্দালয়ের ওবো কারাগারে পাঠায়। দুই মাস পর তার বিরুদ্ধে মিয়ানমারের সামরিক শাসনের সমালোচনামূলক একটি ফেসবুক পোস্টের উস্কানি দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়। ইরাবতী সংবাদ জানিয়েছে [3] তাকে ফেসবুক ব্যবহার করে এবং শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের উপর স্বৈরাচারী সামরিক শাসন ও সামরিক নিরাপত্তা বাহিনীর সহিংস দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ছবি তোলার মাধ্যমে দেশের অস্থিতিশীলতা উস্কে দেওয়ার জন্যে অভিযুক্ত করা হয়। আদালত ২৪ আগস্ট তাকে উস্কানির অভিযোগে তিন বছরের কারাদণ্ড দেয়। জাও মিয়ানমারের সুপরিচিত সংবাদ সংস্থা ইরাবতীতে কাজ করলেও সামরিক অভ্যুত্থানের কয়েক মাস পর পদত্যাগ করেন।

এটি ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে জান্তাকে নিন্দা বা সমালোচনাকারী ফেসবুক পোস্টের জন্যে মিয়ানমারের বেসামরিক নাগরিক ও সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার ও কারারুদ্ধ করা অনেক মামলার একটি। ঘটনার প্রকৃত সংখ্যা ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত অনেক বেশি বলে মনে করা হলেও সামাজিক গণমাধ্যমে বিষয়বস্তু পোস্ট ও ভাগাভাগি করায় মিয়ানমারে জান্তা উস্কানি ও সন্ত্রাসবাদের দায়ে প্যিদাউংসু হ্লুত্তাও প্রতিনিধিত্বকারী কমিটি (সিআরপিএইচ), জাতীয় ঐক্য সরকার (এনইউজি) এবং সামরিক বাহিনী কর্তৃক সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষিত জনসুরক্ষা বাহিনী (পিডিএফ) এর মতো ছায়া সরকার ও প্রতিরোধ বাহিনী [4]কে সমর্থনকারী অন্তত ২০০ জন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীকে গ্রেপ্তার করেছে [5] বলে রেডিও মুক্ত এশিয়া জানিয়েছে। ক্রমবর্ধমান গ্রেপ্তার সত্ত্বেও মিয়ানমারের জনগণ ফেসবুক, টুইটার ও অন্যান্য সামাজিক গণমাধ্যম মঞ্চে জান্তা বিরোধী বিষয়বস্তু ও বার্তা পোস্ট ও ভাগাভাগি করে আসছে।

মিয়ানমারে ফেসবুক ইন্টারনেটের সমান

মিয়ানমারের ৫ কোটি ৩০ লক্ষ জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকের ব্যবহৃত ফেসবুক হলো প্রভাবশালী গণমাধ্যম মঞ্চ এবং মিয়ানমারে ইন্টারনেটের সমতুল্য বলে বিবেচিত। মিয়ানমারের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এর ভূমিকা বিতর্কিত [6] হলেও মিয়ানমারের জনগণের ওপর ও দেশের রাজনৈতিক গতিপথ গঠনে ফেসবুকের ব্যাপক প্রভাব অনস্বীকার্য।

রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুতি [7]র সময় রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিম জনগণের বিরুদ্ধে ফেসবুকের বিভ্রান্তি, গুজব ও ঘৃণামূলক বক্তব্য ছড়ানোর সুযোগ দেওয়ার জন্যে সমালোচনা করা হয় [8]। ২০২০ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগের মাসগুলিতে মিয়ানমারের তৎকালীন রাষ্ট্রীয় কাউন্সেলর (প্রধানমন্ত্রীর সমতুল্য) অং সান সু চি এবং তার গণতন্ত্রের জন্যে জাতীয় লিগ [9] (এনএলডি) পার্টির সুনামহানি, নির্বাচনের ফলাফলকে অবৈধ  করা এবং নির্বাচনে মুসলমান প্রার্থীদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ছড়ানোর জন্যে সামরিক সমর্থক লবিস্ট ও বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীরা ফেসবুক মঞ্চে ব্যাপকভাবে ভুল তথ্য প্রচার করেছিল।

ডিজিটাল অধিকার কর্মীরা দাবি করেছে [10] ফেসবুক অ্যালগরিদম রোহিঙ্গা জনগণের গণহত্যাকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। ফেসবুক অ্যালগরিদম ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির সামরিক অভ্যুত্থানে অবদান রেখেছে [11] বলে মনে করা হয়। ফেসবুকের অ্যালগরিদম নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কিত সামরিক প্রচারণার সংবাদ ও বিভ্রান্তি বিস্তৃত করার ফলে হাজার হাজার বেসামরিক লোক নিহত এবং অভ্যুত্থানবিরোধী আন্দোলনে যোগদানের জন্যে কারারুদ্ধ হয়। ২০১৮ সালে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের বাস্তুচ্যুত করার বিষয়ে ব্যাপক জনসমালোচনার এবং এসব ব্যক্তি ও সংস্থা দেশে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে বা করিয়েছে জাতিসংঘের তদন্তে এমন প্রতিবেদনের পর ফেসবুক অন্যান্য মিয়ানমারের সামরিক কর্মকর্তাদের অ্যাকাউন্ট ও পৃষ্ঠাসহ বর্তমান অভ্যুত্থানের নেতা জেনারেল মিন অং হ্লাইং-এর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট [12] এবং সামরিক টিভি সংবাদ চ্যানেল (বিশেষ করে মায়াবতী নিউজ) নামিয়ে দিয়েছে।

অভ্যুত্থান-পরবর্তী প্রেক্ষাপটে সামরিক জান্তা এবং এর সমর্থকরা মিয়ানমারে গণতন্ত্র ও অভ্যুত্থান বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলন দমন করতে সামরিক সমর্থিত বর্ণনা প্রচারের জন্যে গুজব ও বিভ্রান্তি ছড়াতে বিভিন্ন মঞ্চ ব্যবহার করছে। ফলে মিয়ানমার সামরিক ও বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলির সাথে সম্পর্কিত ক্ষতিকারক অ্যাকাউন্ট, বিষয়বস্তু ও গোষ্ঠীগুলির সম্প্রদায়গত মান লঙ্ঘন এবং আরো বিভ্রান্তি, ঘৃণাত্মক বক্তব্য ও  উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণার সংবাদের বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করতে ফেসবুক আরো বেশিকরে  প্রচেষ্টা চালাচ্ছে৷

ফেসবুকের প্রতি সেনাবাহিনীর প্রতিক্রিয়া

অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন সমর্থনকারী কয়েক হাজার ভিন্নমতাবলম্বী, সক্রিয় কর্মী, শিক্ষার্থী ও বিক্ষোভকারীকে আটক করেছে। বিক্ষোভকারী ও সশস্ত্র প্রতিরোধ বাহিনীর উপর নৃশংস দমন-পীড়নের পাশাপাশি মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী বাক স্বাধীনতা, তথ্যের স্বাধীনতা ও টেলিযোগাযোগ পরিষেবাগুলিতে প্রবেশাধিকার কঠোরভাবে সীমিত করে। সাইবার পরিমণ্ডলে ভিন্নমত দমন করতে সামরিক বাহিনী সামাজিক গণমাধ্যম অ্যাকাউন্ট পর্যবেক্ষণকারী সামরিক সমর্থক লবিস্টদের সাহায্য নিয়ে বেশি বেশি করে বিশেষ করে জানুয়ারি ২০২২ এর পরে সামাজিক গণমাধ্যমে বিরোধী ও প্রতিরোধ গোষ্ঠীর প্রতি সমর্থন প্রদর্শনকারীদের গ্রেপ্তার করেছে। ২০২২ সালের মে মাসের প্রথম দিকে মিয়ানমার জান্তা একটি বিবৃতিতে জানিয়েছে ২২৯ জনকে গ্রেপ্তার [5] করে অনলাইনে সামরিক বিরোধী প্রচারণা বিস্তার নিষিদ্ধের সন্ত্রাসবিরোধী আইন ও ইলেকট্রনিক যোগাযোগ আইন লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

সামরিক অভ্যুত্থানের বিরোধিতার একটি মূল মঞ্চ হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার পর থেকে মিয়ানমারের সামরিক শাসন অস্থিরতা ও সহিংসতা সৃষ্টিকারী বিভ্রান্তির উৎস এবং অন্যায়ভাবে জাতীয়তাবাদী বিষয়বস্তু সরিয়ে দিচ্ছে বলে দাবি করে ফেসবুককে নিষিদ্ধ [13] করার চেষ্টা করছে। অভ্যুত্থানের অব্যবহিত পরেই সেনাবাহিনী স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে ইন্টারনেট সরবরাহকারীদের ফেসবুক অবরোধ করার নির্দেশ দেয়। সেনাবাহিনীর ফেসবুক ব্যবহারে জনগণকে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা সত্ত্বেও তারা অবরোধ এড়াতে ভিপিএন [14] ডাউনলোড করে। নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে না পেরে জান্তা ফেসবুক প্রতিস্থাপনের জন্যে একটি নতুন সামাজিক গণমাধ্যম মঞ্চ তৈরির দিকে নজর দিতে শুরু করে। গত বছর ১৭ আগস্ট সামরিক-চালিত সংবাদ সম্মেলন চলাকালে সেনবাহিনীর রাষ্ট্রীয় প্রশাসন পর্ষদের (এসএসি) মুখপাত্র এবং সত্য সামরিক সংবাদ তথ্য দলের প্রধান মেজর-জেনারেল জাও মিন তুন [15] ফেসবুক নিষিদ্ধ করে একটি স্বদেশী সামাজিক গণমাধ্যম মঞ্চ [16] দিয়ে এটিকে প্রতিস্থাপনের সরকারি পরিকল্পনা প্রকাশ করেন। এছাড়াও তিনি ফেসবুককে বিজ্ঞাপন থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া থেকে বিরত রাখতে ফেসবুকে পণ্যের বিজ্ঞাপন দেওয়া মিয়ানমারের কোম্পানিগুলির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান। শাসকগোষ্ঠী মিয়ানমারে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ভিপিএন ব্যবহারের শাস্তি তিন বছর কারাদণ্ড প্রদানের একটি ধারা অন্তর্ভুক্ত করার জন্যে সাইবার নিরাপত্তা আইন সংশোধন করেছে।

কুরিয়াম গণমাধ্যম ফাউন্ডেশনে [17]র বিশ্লেষণ অনুসারে প্রতিস্থাপিত এই অ্যাপ সম্ভবত ওকেপার তাৎক্ষণিক বার্তাসহ বেশ কয়েকটি পরিষেবা সরবরাহ করে। ওকেপার নিরাপদ নয় এবং প্রান্ত-থেকে-প্রান্ত সংকেতায়নের দাবি সত্ত্বেও সংবেদনশীল তথ্য ফাঁস করে দেয় বলে ফাউন্ডেশনটি সতর্ক করে দিয়েছে। অভ্যুত্থান বিরোধী কর্মীরা অ্যাপটির বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানোর [18] জন্যে জনগণকে এবং অ্যাপল অ্যাপ স্টোর ও গুগল প্লে স্টোর থেকে এটি অপসারণের আহ্বান জানিয়েছে।

একটি প্রাসঙ্গিক উল্লেখে রেডিও মুক্ত এশিয়া জানিয়েছে ইউটিউবকে প্রতিস্থাপন করতে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী এমটিউব [19] সরাসরি স্ট্রিমিং মঞ্চ তৈরি করছে। ইউনাইটেড ইনফো-সেক কোম্পানির সাথে একটি বৈঠকের সময় ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২ তারিখে তথ্যমন্ত্রী উ মং মং ওহন বলেন ইউটিউব অন্যায়ভাবে সামরিক বাহিনীকে সমর্থনকারী বিষয়বস্তু সীমাবদ্ধ করছে ও সরিয়ে নিচ্ছে বলে ইউটিউবকে প্রতিস্থাপন করার জন্যে একটি নতুন মঞ্চ দরকার।

মিয়ানমারের জনগণকে সমর্থন করতে ফেসবুককে অবশ্যই এগিয়ে আসতে হবে

গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্বের কারণে সামাজিক গণমাধ্যম মঞ্চগুলি নির্বাচনের মতো রাজনৈতিক  অনুষ্ঠানের উপর বড় রকমের প্রভাব ফেলে। এর মধ্যে বিশৃঙ্খল তথ্যের বিস্তার রোধে বিষয়বস্তু সঞ্চালন এবং গণতান্ত্রিক নিয়ম লঙ্ঘনের সম্ভাব্য বিষয়বস্তুকে সম্ভাব্য রাজস্ব হারিয়ে হলেও অনুমতি না দেওয়া রয়েছে। মিয়ানমারের প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্রপন্থী কর্মীরা বিশ্বাস করে ফেসবুকের কাছে মিয়ানমারের গণতন্ত্রীকরণ আন্দোলনে হস্তক্ষেপ ও প্রভাবিত করার ক্ষমতা রয়েছে যা কর্তৃত্ববাদী সামরিক শাসনের অবসান ঘটাতে পারে।

অ্যাক্সেস নাউ (এখনি প্রবেশাধিকার) [20] ফেসবুক (মেটা) ও গুগলকে মিয়ানমারের জনগণের নিরাপদে ফেসবুক ও ইউটিউবে প্রবেশাধিকারের জন্যে প্রযুক্তিগত সমাধানে বিনিয়োগ করার আহ্বান জানিয়েছে। উপরন্তু এটি গুগল ও অ্যাপলকে তাদের স্টোর থেকে ওকেপার অ্যাপটি নামিয়ে ফেলার এবং চালু হয়ে গেলেও এমটিউব হোস্ট না করার প্রতিশ্রুতি দানের অনুরোধ করেছে। এই সংস্থাগুলির মানবাধিকার সমুন্নত রাখার দায়িত্ব রয়েছে এবং উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণার জন্যে সেনাবাহিনীকে তাদের পণ্য ও পরিষেবা ব্যবহার করতে দেওয়া উচিত নয়। এছাড়াও অ্যাক্সেস নাউ মিয়ানমারের লক্ষ লক্ষ লোকের গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্যে সম্ভাব্য সব উপায় অন্বেষণ করার জন্যে এই সামাজিক গণমাধ্যম মঞ্চগুলি ব্যবহারকারী বড় বড় প্রযুক্তিগুলিকে অনুরোধ করেছে [18]

পরাধীনতা পর্যবেক্ষক [21] থেকে আরো কিছুর জন্যে অনুগ্রহ করে প্রকল্প পৃষ্ঠা দেখুন।