- Global Voices বাংলা ভার্সন - https://bn.globalvoices.org -

ব্রিটেন কি ক্যারিবীয় দাসত্বের ক্ষতিপূরণ নিয়ে গুরুত্বসহ আলোচনা করতে প্রস্তুত?

বিষয়বস্তু: ক্যারিবিয়ান, গ্রেনাডা, ইতিহাস, জাতি-বর্ণ, ডিজিটাল অ্যাক্টিভিজম, নাগরিক মাধ্যম, প্রচার মাধ্যম ও সাংবাদিকতা, প্রতিবাদ, মানবাধিকার, রাজনীতি
[1]

ফিচারের ছবি ক্যানভা প্রো [1] দিয়ে তৈরি।

যুক্তরাজ্যের গার্ডিয়ান পত্রিকা ৪ ফেব্রুয়ারি তারিখে ব্রিটিশ অভিজাত শ্রেণীর সদস্য ট্রেভেলিয়ান পরিবার সম্পর্কে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে [2]। কেউ হয়তো গল্পটি পরিবারটির রাজকীয় বাড়ি, রাজনৈতিক সংযোগ, বা জনহিতকর কাজের কথা তুলে ধরার আশা করলেও; পরিবর্তে, এটি গ্রেনাডায় একটি পারিবারিক ভ্রমণের দিকে মনোনিবেশ করে – তবে এটি কোন ক্যারিবীয় ভ্রমণ ছিল না। তাদের যাত্রার অনেক বড় উদ্দেশ্যটি ছিল: আটলান্টিকের এপার-ওপার ক্রীতদাস বাণিজ্যে তাদের পূর্বপুরুষদের ভূমিকার জন্যে সর্বজনীন ক্ষমা প্রার্থনা।

পরিবারের সদস্য জন ডাওয়ার ২০১৬ সালে ট্রেভেলিয়ান ইতিহাস সম্পর্কে কিছু গবেষণা করার সময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ লন্ডনের দাসত্বের ডেটাবেজ [3] ব্যবহার করে দ্বীপটির ছয়টি চিনির বাগানে ছড়িয়ে থাকা ১,০০০ জনেরও বেশি আফ্রিকীয় ক্রীতদাসের সম্মিলিত মালিকানার কয়েকটি অন্তর্ভুক্তি [4] আবিষ্কার করেন। হতবাক হয়ে তিনি বলেন, “এটি পারিবারিক ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা হয়েছে।”

ডাওয়ার বিবিসি প্রতিবেদক তার চাচাতো বোন লরা ট্রেভেলিয়ান [5]সহ বৃহত্তর পারিবারিক বৃত্তকে তিনি যা খুঁজে পেয়েছেন তা জানান। জানুয়ারির শেষ দিকে তারা ক্ষমা চাওয়ার চিঠিতে স্বাক্ষর করতে রাজি হয়। গার্ডিয়ান পত্রিকা গল্পটি প্রকাশ পর্যন্ত পরিবারটির ৪২ জন সদস্য ইতোমধ্যে স্বাক্ষর করে; এখন পর্যন্ত সম্ভবত তাদের আরো অনেকে গ্রেনাডার জনগণকে সম্মিলিতভাবে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিকে আরো এক ধাপ এগিয়ে গেছে।

এমন একটি পদক্ষেপ নেওয়ার সাহস বা মানসিক জোর খুব কম লোকেরই আছে। ২০১৯ সালের আগস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্ববিদ্যালয় ও গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটি ক্ষতিপূরণ চুক্তি স্বাক্ষরে [6]র মাধ্যমে একটি ইতিহাস তৈরি হয়, ১৮৩৮ সালে ব্রিটিশ দাসত্বে থাকা লোকেদের সম্পূর্ণরূপে মুক্তি পাওয়ার পর এটাই এধরনের প্রথম চুক্তি।

ব্রিটিশ সরকার ১৮৩৫ সালে ট্রেভেলিয়ান পরিবারকে দাসপ্রথা বিলোপের এক বছর আগে [7] ক্ষতিপূরণ হিসেবে সেই সময়ের বেশ বড় পরিমাণ ২৬,৮৯৮ পাউন্ড (প্রায় সাড়ে ৩৫ লক্ষ টাকা) প্রদান করে। বিপরীতে কিছুই না পাওয়া “মুক্ত” ক্রীতদাসদের এমনকি মুক্তির ঘোষণার পরে “শিক্ষাদান” কর্মসূচির নামে বছরের পর বছর ধরে বিনা বেতনে শ্রম চালিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়।

২০২৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ট্রেভেলিয়ানরা গ্রেনাডায় ১ লক্ষ পাউন্ডের (প্রায় ১ কোটি ৩২ লক্ষ টাকা) তহবিল চালু করে [8]। গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষতিপূরণ চুক্তি অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী এবং ক্যারিকম ক্ষতিপূরণ কমিশনে [9]সভাপতি [10] স্যার হিলারি বেকেলস, চুক্তি স্বাক্ষরের জন্যে উপস্থিত ছিলেন। গ্রেনাডা জাতীয় ক্ষতিপূরণ কমিশনে [11]র সহ-সভাপতি নিকোল ফিলিপ-ডো ট্রেভেলিয়ানদের প্রশংসা করে বলেন, ‘'আমার পূর্বপুরুষরা ভয়ঙ্কর কিছু ভুল করেছিলেন এবং আমি মনে করি এর জন্যে আমাদের কিছু দায়িত্ব নেওয়া উচিত” […] আমি আশা করি অন্যরা এটি অনুসরণ করবে বলার জন্যে একটি পরিবারের বিশ্বাসের একটি উল্লম্ফন দরকার।‘

আরো অনেকেই এখন বনভূমি থেকে বেরিয়ে আসছে। ২৮ মার্চ তারিখে গার্ডিয়ান পত্রিকার মালিক স্কট ট্রাস্ট প্রকাশ করেছেন [12] দাস ব্যবসার সাথে সংবাদপত্রটির প্রতিষ্ঠাতাদের সম্পর্ক [13] রয়েছে। তিনি ক্ষমাপ্রার্থী এবং এক দশক-দীর্ঘ ক্ষতিপূরণমূলক ন্যায়বিচারের কর্মসূচি গ্রহণের জন্যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যাতে গার্ডিয়ানের প্রতিষ্ঠাতা জন এডওয়ার্ড টেলর ও তার ব্যবসায়িক অংশীদারদের বংশধরেরা (ক্ষতিগ্রস্ত) সম্প্রদায়ের জন্যে ১ কোটি পাউন্ড (প্রায় ১৩২ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা) বিনিয়োগ করবে।

এই সর্বশেষ অগ্রগতির প্রেক্ষিতে এবং ট্রেভেলিয়ানদের কর্মকাণ্ড ও বিষয়টির প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ আকর্ষনের [14] জন্যে উচ্ছ্বসিত লরা ট্রেভেলিয়ানের তার সাংবাদিকতা দক্ষতার ব্যবহারের পাশাপাশি, শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার ও রাজপরিবারকে পুনরুদ্ধারমূলক ন্যায়বিচারের দিকে এগিয়ে যাওয়ার এই আহ্বানে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরাও এখন তাদের কণ্ঠস্বর যোগ করছে [15]

ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ ও রাজপরিবার উভয়েই দাসত্বের ক্ষতিপূরণের বিষয়টিকে মোকাবেলা করতে অনিচ্ছুক। জ্যামাইকা সফরের সময় ২০১৫ সালের অক্টোবরে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন কুখ্যাতভাবে এই বিষয়ে আলোচনা করতে অস্বীকার করে উল্টো তার হোস্টদের “দাসত্ব থেকে বেরিয়ে আসতে” বলেন [16]। বোঝার উপর শাকের আঁটি হিসেবে তিনি দ্বীপটিতে দৃশ্যত সমস্ত আইন ভঙ্গকারী জ্যামাইকার নির্বাসিতদের জন্যে একটি নতুন কারাগার নির্মাণ করতে ২.৫ কোটি পাউন্ড (প্রায় ৩৩১ কোটি টাকা) ব্যয় করার প্রস্তাব করেন [17]

আরো সাম্প্রতিককালে ২০২২ সালের মার্চ মাসে রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের প্ল্যাটিনাম জয়ন্তীর সম্মানে একটি ক্যারিবীয় সফর শুরু করার সময় কেমব্রিজের ডিউক ও ডাচেস জ্যামাইকা থেকে বেলিজ পর্যন্ত প্রতিবাদের মুখোমুখি হলে রাজপুত্র উইলিয়াম “দাসপ্রথা ঘৃণ্য এবং কখনোই হওয়া উচিত ছিল না” বলে স্বীকার করলেও তিনি কোন ক্ষমাপ্রার্থনা করেন নি [18]

তবে গ্রেনাডায় কিছু সময় কাটানোর পর ট্রেভেলিয়ান বুঝতে পারেন দাসপ্রথা ও ঔপনিবেশিকতার প্রভাব এখনো রয়ে গেছে এবং এটি অর্থনীতি, পদ্ধতিগত দুর্নীতি, সহিংসতা, জনস্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পরিচয় সমস্যার মাধ্যমে এই অঞ্চলের জনগণকে নানাভাবে প্রভাবিত করছে।

পরিবারটি দাস ব্যবসায় জড়িত থেকে মুনাফা অর্জনের জন্যে ব্রিটিশ সরকার ও রাজপরিবারকে চাপ দিচ্ছে [2] ক্ষমা চেয়ে সংশোধনের জন্যে। অন্যান্য উপনিবেশকারীরা, অতি সম্প্রতি ডাচরা এই বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে [19]

মার্চের মাঝামাঝি সময়ে ক্যারিবীয় অঞ্চলে ক্ষতিপূরণমূলক ন্যায়বিচারের প্রচারণায় পূর্ণ মনোযোগ দেওয়ার জন্যে লরা ট্রেভেলিয়ান বিবিসিতে তার পদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন [20]। তিনি ক্যারিবীয় নেতাদের সাথে দাসত্বের ক্ষতিপূরণ নিয়ে আলোচনার জন্যে যুক্তরাজ্যকে আহ্বান জানানো [21] শ্রমিক দলের সাংসদ ক্লাইভ লুইসের মতো সহানুভূতিশীল রাজনীতিবিদদের সাথে কাজ করার পরিকল্পনা করেছেন।

ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর লেখিকা ইরা মাথুর সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক সিদ্ধান্তটি টুইট করেছেন:

‘নভেম্বর মাসে রাজা চার্লস বলেছেন তিনি দাস ব্যবসায় ব্রিটেনের জড়িত থাকার বিষয়ে “সক্রিয় কথোপকথন” করতে প্রস্তুত।‘

গার্ডিয়ান পত্রিকার মতে লন্ডন-ভিত্তিক শিল্পী ও প্রাক্তন সান্তা লুসীয় প্রধানমন্ত্রী জন কম্পটনে [23]র কন্যা রাজা চার্লসের ধর্মকন্যা ফিওনা কম্পটন [24] তার সাথে সমস্যাটিকে “আরো ভালোভাবে তুলে ধরে স্বীকৃতি”র নানা উপায় নিয়ে কথা বলার কথা বলেছেন। অঞ্চলটি সম্পর্কে মানুষকে শিক্ষিত করার চেষ্টারত আপনার ক্যারিবীয়দের জানুন [25] এর পেছনের শক্তিঘর [26] হলেন কম্পটন। এটি প্রায়শই ভুলভাবে উপস্থাপিত ইতিহাসের ধারণাগুলি সংশোধন করে বিভিন্ন বিষয়ে নতুন ও আরো অন্তর্ভুক্ত আলোচনার সুযোগ দেয় [27]

ক্ষতিপূরণমূলক ন্যায়বিচারের জন্যে বর্ধিত প্রচারণা [28], বার্বাডোসের প্রজাতন্ত্র হওয়ার সিদ্ধান্তের এবং ক্ষতিপূরণ বিবেচনার নতুন উপায়গুলির প্রতি সহানুভূতিশীল [29] ব্রিটিশ সিংহাসনে একজন নতুন সার্বভৌম প্রধান, ক্যারিকম ক্ষতিপূরণ কমিশনের ধারাবাহিক [30] নিরলস [31] প্রচেষ্টা এবং বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সম্মানিত গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান এবং জাতিসংঘের চাপের মতো বিভিন্ন নিয়ামকের এই ধরনের সংমিশ্রণ অবশেষে প্রাক্তন উপনিবেশ রাষ্ট্রগুলির জন্যে কি একটি নতুন যুগের সূচনা করতে পারে? লক্ষ লক্ষ ক্যারিবীয় নাগরিকদের মতো ট্রেভেলিয়ান পরিবার শুধু তাদের কর্তব্যটি করার পর অপেক্ষা করে দেখতে পারে।