- Global Voices বাংলা ভার্সন - https://bn.globalvoices.org -

সার্বিয়া কি ইউক্রেনের যুদ্ধের ‘সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী’?

বিষয়বস্তু: পূর্ব ও মধ্য ইউরোপ, ইউক্রেইন, রাশিয়া, সার্বিয়া, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, নাগরিক মাধ্যম, প্রচার মাধ্যম ও সাংবাদিকতা, যুদ্ধ এবং সংঘর্ষ, রাজনীতি, দ্যা ব্রিজ (সেতুবন্ধন), Russia invades Ukraine
[1]

কোলাজ ছবির কৃতজ্ঞতা: ইস্তিনোমার/ ফোনেট/ উইকিমিডিয়া। অনুমতিসহ ব্যবহৃত।

তিয়ানা জর্জেভিচের এই নিবন্ধটি মূলত গবেষণা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা (সিআরটিএ [2]) কেন্দ্রের একটি সত্য-যাচাই উদ্যোগ ইস্তিনোমারে [3] (সত্যমান যন্ত্র) প্রকাশিত হয়। গ্লোবাল ভয়েসেসের সাথে একটি বিষয়বস্তু ভাগাভাগি চুক্তির অংশ হিসেবে এর একটি সম্পাদিত সংস্করণ নীচে প্রকাশিত হলো৷

গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার আগ্রাসনের শুরু থেকে একটি দেশ “পরাশক্তিগুলির শিকারে” পরিণত হয়েছে। সেই দেশটিকে “চাপ,” “গোপন হুমকি,” “অতি ব্যবহার” এবং “পরিকল্পিত আক্রমণে”র লক্ষ্যবস্তু্তে পরিণত করা হয়েছে। সেই দেশে একটা বিশেষ যুদ্ধ চালানো হচ্ছে। আর সেই দেশটি হলো – সার্বিয়া।

ইউক্রেনের যুদ্ধের প্রথম ঘন্টা থেকে আজ অবধি সার্বিয়ার গণমাধ্যম “ইউক্রেন রাশিয়া আক্রমণ করেছে [4]” সত্য দাবি করা থেকে শুরু করে বাস্তবতা মেনে নিয়ে যুদ্ধের পরিবর্তে এটিকে একটি “বিশেষ অভিযান” দাবি করে যুদ্ধে ভ্লাদিমির পুতিনের ভূমিকা ও তার শাসন নিয়ে উল্লাস প্রকাশে [5]র মতো আরো বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করেছ।

এই সংঘাতটি দ্রুত শেষ হবে না এবং এর পরিণতি বিশ্বের বাকি অংশে অনুভূত হবে স্পষ্ট হওয়ার আগ পর্যন্ত এর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির সূক্ষ্মতাগুলি কিছুটা পরিবর্তিত হচ্ছিল। সেই মুহূর্তে জাতীয় গণমাধ্যমের কাছে সার্বিয়া এই যুদ্ধের সবচেয়ে বড় শিকারে পরিণত হলো।

(এখন আবার) কারা আমাদের উপর পতিত সমস্ত সমস্যার উৎস সেই প্রশ্নের উত্তরটি বেশ সহজ। সার্বীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে “সার্বিয়াকে তাড়া” করার ভূমিকায় নতুন একটি মৌসুমে অভিনয় করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন।

‘আমাদের সবচেয়ে কঠিন সময় চলছে’

ইতোমধ্যে যুদ্ধের প্রথম সপ্তাহে গণমাধ্যম রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্যে “সার্বিয়ার উপর ভয়ঙ্কর চাপ [6]” এর ইঙ্গিত দেয়। “কুখ্যাত বিদ্বেষী,” এবং “আমেরিকা ও তথাকথিত ইউরোপীয় ইউনিয়নের গভীরে থাকা প্রভাবশালী রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের” নামের তালিকাও করা হয়েছিল। বেশ কয়েকটি নিবন্ধে “সার্বিয়ার উপর পশ্চিমের নৃশংসতা”র বিশদ বিবরণ প্রকাশিত হয়, যার কয়েকটিতে বিশেষভাবে জোর দিয়ে বলা হয় দেশটির রাষ্ট্রপতি আলেকসান্ডার ভুসিচ “তার চারপাশের সবদিকে [7]র চ্যালেঞ্জ সফলভাবে মোকাবেলা করছেন।”

বিশ্বের তুলনায় পিছিয়ে পড়ার ঝুঁকি এড়াতে সার্বিয়ায় খুব দ্রুত একটি বিশেষ যুদ্ধ শুরু হয়। অন্তত এটিকেই গণমাধ্যম প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়, সংবাদকক্ষ এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে পাঠানো মিথ্যে বোমার হুমকি [8] বলে অভিহিত করেছে। সেই বিশেষ যুদ্ধের লক্ষ্য হলো “সার্বিয়াকে পঙ্গু করে [9]” “রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপে বাধ্য করা।”

বিশেষ হোক বা না হোক, সার্বিয়ার গণমাধ্যমের কাছে খুবই স্পষ্ট যে “পরাশক্তিগুলির যুদ্ধ আমাদের খরচেই পরিচালিত হয় [10]।”

আর তাই “পুতিনের ‘বাস্তব যুদ্ধে’ প্রবেশের সিদ্ধান্ত সার্বিয়ার অবস্থানকে আরো কঠিন করে তোলায় “ইউক্রেনে যুদ্ধ চলার সময় গণমাধ্যমের ভাষায় আমরা “নরকের [11]” মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম। “১৯৯৯ সালে ন্যাটোর বোমা হামলার পর সবচেয়ে বেশি” চাপের কারণে সেই দিনগুলিতে সার্বিয়ার উপর “একটি সম্পূর্ণ আক্রমণের গোলন্দাজ প্রস্তুতি [12]” শুরু হয়।

ইউক্রেনে প্রায় আট মাস যুদ্ধের পর যে “সার্বিয়ার উপর চাপ প্রবল হতে শুরু করে [13]” সেটাও টেলিভিশন অনুষ্ঠানের উপসংহার। পশ্চিম তখন “আমাদের দেশের চারপাশে আঁটুনি শক্ত [14]” করতে “সামরিক পদ্ধতি”র আশ্রয় নেয়, গণমাধ্যম যেমন মেরদার ও রাস্কা এলাকার উপর সনাক্ত “মনুষ্যবিহীন আকাশযানের ঘটনাবলী”কে ব্যাখ্যা করেছে।

সবচেয়ে প্রভাবশালী জাতীয় গণমাধ্যমের কাছে সমস্ত “সার্বিয়ার উপর হামলার” লক্ষ্য ছিল দুটি – রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা প্রবর্তন [15] এবং একইসাথে কসোভোর স্বাধীনতা [16]স্বীকৃতি [17]। ব্রাসেলস ও ওয়াশিংটনের প্রায় সমস্ত কর্মকে শত্রুতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয় যেমনটা সার্বিয়ার পররাষ্ট্র নীতির গতিপথ ও বেলগ্রেড সফরের সময় উভয় বিশ্লেষণের মাধ্যমে কর্মকর্তারা তাদের প্রত্যাশা ব্যাখ্যা করে।

মিথ্যে চাপ

এমনকি কখনো কখনো সার্বীয় গণমাধ্যমের কথিত “চাপ” প্রাচ্য থেকেও আসছে [18] বলে মনে হলেও ভ্লাদিমির পুতিনের শাসনের সাথে সম্পর্ক একই থেকে যায়। রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি কসোভো এবং দোনেস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চলে স্বঘোষিত প্রজাতন্ত্রগুলির মধ্যে সমান্তরাল আঁকলে বন্ধুত্বপূর্ণ আখ্যানটি অল্প সময়ের জন্যে নীরব হয়ে পড়ে।

“আমাদের একজন মহান বন্ধুসুলভ পুতিন তার বিবৃতিতে কসোভো সম্পর্কিত সার্বিয়ার স্বার্থের ক্ষতি করে তার আসল চেহারা দেখিয়েছেন” যা গণমাধ্যমের ভাষায় [19] রুশ রাষ্ট্রপতির “সার্বিয়ার পিঠে ছুরিকাঘাত।”

বেলগ্রেডে রুশ রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার বোতসান-খারচেঙ্কোর বিবৃতিকে কখনোই হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি এমনকি যখন তিনি বলেন  নিষেধাজ্ঞার প্রবর্তন “সার্বিয়ার অর্থনীতি ও সামাজিক পরমণ্ডলের ক্ষতি করতে পারে।”

“ইতিবাচক অর্থেই সার্বিয়ার অর্থনীতি রাশিয়ার সাথে খুব সংযুক্ত। প্রত্যেকেই বোঝে রাশিয়া-বিরোধী নিষেধাজ্ঞার ফলে অর্থনীতি ও সমাজের যথেষ্ট ক্ষতি হবে,” সার্বীয় জাতীয় পোর্টালগুলিতে প্রচারিত [20] দৈনিক ইজভেস্তিয়ার সাথে একটি সাক্ষাৎকারে [21] বোতসান-খারচেঙ্কো বলেন।

কর্তৃপক্ষের ঘনিষ্ট “সার্বিয়ার প্রতি হুমকি” সনাক্তকারী গণমাধ্যম এই বিবৃতিটিকে প্রাসঙ্গিক বলে মনেই করেনি।

বিপরীতক্রমে নীরবতার মধ্যেও রুশপন্থী মনোভাব লক্ষণীয়। প্রকৃতপক্ষে পশ্চিমারা কিছু আশা করলে তখন তা সার্বিয়ার “পিঠ ভেঙে দেয়।” কিন্তু রাশিয়া কিছু আশা করলে সার্বিয়ার নেতৃত্ব প্রত্যাশা মাফিক কাজ করে এবং বেশিরভাগ গণমাধ্যম পরিস্থিতিটিকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে।

আন্তর্জাতিক ক্রিমিয়া মঞ্চের প্রথম সংসদীয় শীর্ষ সম্মেলনে সার্বিয়ার অংশগ্রহণে [22]র ক্ষেত্রেও একই ঘটনা। সার্বীয় পার্লামেন্টের স্পিকার ভ্লাদিমির অরলিকের সাথে সাক্ষাতের সময় বোতসান-খারচেঙ্কো “সার্বিয়া প্রজাতন্ত্রের জাতীয় সংসদের প্রতিনিধিদল শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করবে না বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।”

অন্যান্য প্রত্যাশার বিপরীতে রুশদেরগুলি সম্পূর্ণরূপে পূরণ করা হয়। সরকারি আমন্ত্রণ সত্ত্বেও সার্বীয় প্রতিনিধিদল ইউক্রেনের প্রতি আরো সমর্থনের বার্তা পাঠানো শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নেয়নি।

অরলিক ও বোতসান-খারচেঙ্কোর মধ্যে কথোপকথনের বিশদ বিবরণ পরে একটি সংসদীয় নোটে এবং তারপর এন১ পোর্টালে [23] প্রকাশিত হয়। “সার্বিয়ার স্বাধীন বৈদেশিক নীতি” এবং “সার্বীয় স্বার্থে”র সবচেয়ে বড় গণমাধ্যম রক্ষকদের সেই সময়ে আরো ভাল কিছু করার ছিল।

এভাবে ইউক্রেনের যুদ্ধ শুধু সার্বীয় মূলধারার গণমাধ্যমের অদ্ভুত প্রতিবেদনের উপায়কে উন্মোচিত করেছে। সিআরটিএ’র গণমাধ্যম পর্যবেক্ষণ ডেটা [24] অনুসারে প্রকৃতপক্ষে ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে বিগত পাঁচ বছরে আধিপত্য বিস্তারকারী পশ্চিমা-বিরোধী আখ্যান আরো তীব্রতর হয়েছে। ২০২২ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে ইতিবাচক ও নেতিবাচক গণমাধ্যম প্রতিবেদনের অনুপাত ১:১৫, কিন্তু রাশিয়ার ক্ষেত্রে এই অনুপাতটি বিপরীত যেখানে ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রতিবেদনের অনুপাত ২:১।

সবকিছু বিবেচনা করে দেখলে সার্বিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় গণমাধ্যমের কাছে ইউক্রেনের যুদ্ধ সার্বিয়াকে শিকারের ভূমিকায় রাখার আরেকটি অজুহাত মাত্র। আর এই বিষয়টি ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত পশ্চিম, বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিরোধিতা চর্চাসহ আরো আতঙ্ক ও ভয়-ভীতি প্রদর্শনের জন্যে ব্যবহৃত হয়েছে।