- Global Voices বাংলা ভার্সন - https://bn.globalvoices.org -

কোন অভ্যুত্থান যখন আপনাকে কোণঠাসা করে: থাইল্যান্ডে বর্মী শরণার্থীদের জীবন

বিষয়বস্তু: পূর্ব এশিয়া, থাইল্যান্ড, মায়ানমার (বার্মা), আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, নাগরিক মাধ্যম, মানবাধিকার, যুদ্ধ এবং সংঘর্ষ, রাজনীতি, শরণার্থী
[1]

নিরাপদ আশ্রয়ের ভেতরের দেওয়ালে চিহ্নটির অর্থ হলো ‘পিডিএফ (জনসুরক্ষা বাহিনী) এর কারণে বসন্ত বিপ্লব এগিয়ে যেতে পারে।’ প্রচাতাই থেকে নেওয়া ছবি [1], অনুমতি নিয়ে ব্যবহৃত।

ওয়ান্না টেমথংয়ের এই নিবন্ধ [1]টি মূলত থাইল্যান্ডের একটি স্বাধীন সংবাদ সাইট প্রাচাতাইয়ে প্রকাশিত হয়। গ্লোবাল ভয়েসেস এর একটি সম্পাদিত সংস্করণ পুনঃপ্রকাশ করেছে একটি বিষয়বস্তু ভাগাভাগি চুক্তির অধীনে।

২০২১ সালের অভ্যুত্থানের [2] পর মিয়ানমার সরকারের তার নাগরিকদের দমনে সহিংসতা ব্যবহার করার ফলে বিপুল সংখ্যক বর্মি নাগরিক তাদের জীবন বাঁচাতে থাইল্যান্ডে পালিয়েছে। কেউ বৈধ ভিসা নিয়ে এসেছে, কেউ কেউ আবার নথিভুক্ত নয়।

শরণার্থী ও রাষ্ট্রহীন ব্যক্তিদের অধিকারের জোট [3] থেকে পাওয়া তথ্য ২০২২ সালে থাইল্যান্ডে প্রায় ৫,১৫৫ জন শহুরে শরণার্থী অবস্থানের ইঙ্গিত দিয়েছে। এর মধ্যে অন্যান্য জাতীয়তার শরণার্থী থাকলেও মিয়ানমারের শহুরে শরণার্থীদের সংখ্যা অনুমানের চেয়েও বেশি হতে পারে।

একজন ৬৪ বছর বয়সী শরণার্থী আহ কো (বর্মী ভাষায় একজন বয়স্ক ব্যক্তিকে বোঝায়) অভ্যুত্থানবিরোধী ২৭ জন শরণার্থী বসবাসকারী একটি ভবনের দেখাশোনা করেন। আহ কো আমাদের বলেছেন এই নিরাপদ আশ্রয়টি অনেক এলাকা থেকে আগত বর্মীদের সাহায্য করেছে।

মিয়ানমারে আর থাকতে না পারা থাকার জায়গা না থাকা সাধারণ মানুষ এবং জ্যেষ্ঠ্য জেনারেল মিন অং হ্লাইং-এর অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে লড়াইরত নেতারা আছে। কেউ জনসুরক্ষা বাহিনী [4] (পিডিএফ) এর [সদস্য], কেউ আবার রাজনীতিবিদ। বেশিরভাগই সবসময় এখানে থাকে না। মানুষ সব সময় আসছে আর যাচ্ছে। সমস্ত খরচ আমেরিকার একটি বর্মী নেটওয়ার্ক বহন করে। তারা টাকা সংগ্রহ করে আমাদের কাছে পাঠায়।

আসলে ২০০৭ সালে “জাফরান বিপ্লব [5]” এর সময় সপরিবারে মিয়ানমার ত্যাগ করে যুক্তরাষ্ট্রে বসতি স্থাপন করায় আহ কো সহজেই তৃতীয় কোনো দেশে চলে যেতে পারতেন। অং সান সু কি [6]’র গণতন্ত্রের জাতীয় লীগ দল ২০১৫ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করে সংসদ ও সিনেটের অর্ধেকেরও বেশি আসন দখল করার পরে তিনি মিয়ানমারে ফিরে আসতে চান। পরিবারের বাকি সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রে থেকে গেলেও ফিরে এসে তিনি মিয়ানমারে একটি পর্যটন ব্যবসা খোলেন। এরপর ২০২১ সালে আরেকটি অভ্যুত্থান ঘটে।

আমি ইতোমধ্যে একটি তৃতীয় দেশে রয়েছি, আমাকে আবার যেতে হবে কেন? সেখানে থাকা অবস্থাতেই আমি বেঁচেই গেছি। আমি খেতে ও বাঁচতে পারলেও আমাদের ভাই-বোন, আমাদের জনগণ এখনো এইভাবে কষ্ট করে বেঁচে আছে। আমি কি চোখ বন্ধ করে চলে যাবো? তাই তৃতীয় কোনো দেশে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি থাকবো এবং একজন মানুষের পক্ষে যতোটা সম্ভব সাহায্য করবো।

এজন্যেই আমি এখানে (থাইল্যান্ড) থাকার আমাদের ভাই ও বোনদের জন্যে অর্থ সংগ্রহে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

তিনি ২০২১ সালের অভ্যুত্থানকে জেনারেল নে উইনের (৮/৮/১৯৮৮ তারিখের ৮৮৮৮ বিদ্রোহ [7] নামেও পরিচিত) বিরুদ্ধে ইন্টারনেট না থাকা বিক্ষোভ সম্পর্কে কারো জানা না থাকা ১৯৮৮ সালের বিক্ষোভ থেকে আলাদা করে দেখেন। কিন্তু ২০২১ সালে প্রত্যেকে ইন্টারনেট ব্যবহার করে পরস্পরের সাথে যোগাযোগ করে আইন অমান্য আন্দোলন করেই পিডিএফ গঠন করে।

সামরিক বাহিনী ১৯৮৮ সালে ১০ জনকে গুলি করে মারলে আরো ১০০ জন শান্ত হয়ে যেতো। কেউ লড়াই করতে সাহসী হতো না। কিন্তু ২০২১ সালে, সামরিক বাহিনী ১০০ জনকে গুলি করে হত্যা করলেও সেখানে আরো ১০০ জন, ১,০০০ জন, ১০,০০০ জন আসবে। ২০২১ সালে সমস্ত বাচ্চাদের চোখ-কান খোলা। যা ঘটছে তারা তা খুঁজে বের করে সারা বিশ্বকে দেখিয়ে দেবে।

থাই কর্তৃপক্ষের কাছে তার একটি আবেদন আছে:

পারলে আমি থাই সরকারকে আমাদের গ্রহণ ও যুদ্ধ শরণার্থীদের জন্যে একটি কেন্দ্র স্থাপন করতে বলবো। এখানে যারা আসে তারা খারাপ মানুষ নয়। অভ্যুত্থানকারী সেনারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে জনগণকে গুলি করে, হত্যা করে, জনগণের জিনিসপত্র ধ্বংস করে। যাদের থাকার জায়গা নেই তাদের এখান থেকে পালাতে হবে। এখানে আসা একটা গোপন ব্যবসা। ধরা পড়লে মূল্য দিতে হবে। তাদের আবার মিয়ানমারে ফেরৎ পাঠানোর মানে হলো তাদের মৃত্যু ঝুঁকিতে ঠেলে দেওয়া। সম্ভব হলে আমি চাই থাই সরকার সরাসরি এই সমস্যার সমাধান করুক। আমাদেরকে প্রকাশ্যে গ্রহণ করুক। দেশের পরিস্থিতির উন্নতি হলে তো তাদের ফিরেই যেতে হবে।

Safe house for Burmese refugees [1]

বর্মী শরণার্থীদের একটি নিরাপদ ঘরের অভ্যন্তরে। প্রচাতাই থেকে পাওয়া ছবি [1], অনুমতি নিয়ে ব্যবহৃত।

সাংবাদিক থেকে শরণার্থী

আহ কোর নিরাপদ ঘরে বসবাসকারীদের মধ্যে থু (ছদ্মনাম) একজন। মিয়ানমারে তিনি সাংবাদিক হিসেবে কাজ করতেন। তিনি মূলত একজন ক্যামেরাম্যান ও ভিডিও সম্পাদক। তিনি একটি ছোট সংবাদ সংস্থায় কাজ করতেন। সংস্থানের অভাব হলে তিনি ক্যামেরার সামনে চলে এসে সাংবাদিকদের একটি দলের অংশ হিসেবে অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভে [8]র প্রতিবেদন করতে শুরু করেন।

সৈন্যরা আমাদের থামিয়ে দিয়ে সেখানে আর ভিডিও করতে দেয়নি। কিছু লোক নির্দেশ অমান্য করে ছবি ও ভিডিও তুলতে থাকলে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।

কোভিড-১৯ পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রতিবেদনের কারণে থু’র সংবাদ সংস্থা বন্ধ করে দেওয়া হয়। হাসপাতালগুলিতে পর্যাপ্ত অক্সিজেন ট্যাঙ্ক না থাকলেও প্রথমদিকে যারা সেনাবাহিনীকে সমর্থন করেছিল সেনাবাহিনী তাদের অক্সিজেন ট্যাঙ্ক দিলেও অভ্যুত্থান বিরোদীদের দেয়নি। সেই খবর প্রকাশিত হওয়ার পর “সৈন্যরা আমাদের হন্যে হয়ে খুঁজেছে; সেখানে থাকতে না পেরে আমাদের এখানে পালিয়ে আসতে হয়েছে,” তিনি বলেছেন:

বেশিরভাগ সাংবাদিক কারাগারে বলে এই মুহূর্তে মিয়ানমারে সাংবাদিকদের ঝুঁকি অনেক বেশি। সামরিক বাহিনী সব খবর নিয়ন্ত্রণ করছে।

থাইল্যান্ডে প্রবেশের আগে থু’কে বন্ধু বা পরিচিতদের সাথে থাকতে ও প্রতি তিন-চার দিন পরপর বাড়ি বদলাতে হতো। তারপরে তিনি আহ কো’র সাথে যোগাযোগ করে তার বান্ধবীকে নিয়ে সাথে সীমান্ত পেরুনোর অর্থের জন্যে তার ব্যক্তিগত ক্যামেরা বিক্রি করে দেন। কাগজপত্র ছাড়াই দেশে প্রবেশ করার কারণে নিরাপদ আশ্রয়টিতে ঢোকার পর থু’কে গ্রেপ্তার এড়াতে নীরব থাকতে হয়েছে। তিনি ইতোমধ্যে সফলভাবে তৃতীয় দেশে যাওয়ার অনুরোধ জমা দিয়েছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে মিয়ানমারে ফিরতে পারবেন না বলে এটাই তার ও তার বান্ধবীর একমাত্র ভরসা।

অন্যদেশে যাওয়ার জন্যে অপেক্ষা করার সময় থাইল্যান্ডে বসবাসের জন্যেও অর্থের প্রয়োজন। উপরন্তু তার কাছে কোন কাগজপত্র না থাকায় সেখানে চলাফেরা করাটাও তার পক্ষে কঠিন। উদাহরণস্বরূপ মুদি কেনার জন্যে নিরাপদ আশ্রয় থেকে বের হয়ে মোটরসাইকেলে কোন পুলিশ সদস্যকে পাশ দিয়ে যেতে দেখলেও তিনি ভয় পান। থু চার মাস ধরে থাইল্যান্ডে থাকায় তার চেহারা স্পষ্টভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। মিয়ানমারে থাকাকালীন কোন ছবির তুলনায় তিনি অনেক বেশি চর্মসার হয়েছেন।

আমরা থু’কে কোন একটি ইচ্ছা প্রকাশের কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি উত্তর দেন, “আমার কেবল একটিই ইচ্ছে, আমাদের কাছে গণতন্ত্র ফিরে আসুক।”

Burmese refugee in Thailand [1]

থু একজন বর্মী শিল্পীর জন্যে একটি ভিডিও সম্পাদনা করেছেন।প্রচাতাই থেকে পাওয়া ছবি [1], অনুমতি নিয়ে ব্যবহৃত।

শহুরে শরণার্থীদের জীবন কীভাবে ব্যবস্থাপনা করা উচিৎ?

মিয়ানমারের অভ্যুত্থানের পর থেকে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে দুই বছর ধরে থাই সরকার বর্মী শরণার্থীদের কোনো যাচাই-বাছাইয়ের ব্যবস্থা করেনি। মিয়ানমার বিশেষজ্ঞ চিয়াং মাই বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও জনপ্রশাসন অনুষদের সিরাদা খেমানিত্তাথাই এই অভ্যুত্থানটির সাথে থাইল্যান্ডের সম্পর্ক বিবেচনায় নিয়েছেন। বর্তমানে থাইল্যান্ডে বসবাসকারী বর্মী লোকেরা শুধুই শ্রমিক নয়। অভ্যুত্থানের পরে বিভিন্ন গোষ্ঠী, শ্রেণী ও দক্ষতার লোকেরা সেদেশে প্রবেশ করেছে। সিরাদা আরো বলেন এমন অনেক মধ্যবিত্ত বর্মী থাইল্যান্ডে এসেছে যাদের কেউ কেউ কনডোমিনিয়াম কিনতে এবং তাদের সন্তানদের আন্তর্জাতিক মানের স্কুলে পাঠাতে সক্ষম।

সিরাদা পরামর্শ দিয়েছেন বর্মী শহুরে শরণার্থীদের যত্ন নিতে থাই রাষ্ট্রের একটি ভাল পন্থা হলো রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে (বলপূর্বক অভিবাসন) পালিয়ে আসা বর্মীদের শরণার্থী বান্ধব একটি নীতিমালা জারি করা। উদাহরণস্বরূপ এই গোষ্ঠীকে আইনিভাবে নিবন্ধন ও থাই আইনের অধীনে সুরক্ষা লাভের অনুমতি দেওয়া যেতে পারে, যাতে শরণার্থীরা রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের যেকোন দুর্নীতির মোকাবেলা করতে পারে।