- Global Voices বাংলা ভার্সন - https://bn.globalvoices.org -

জিহাদি হামলার বিরুদ্ধে রণকৌশল পরিবর্তন করেছে বুরকিনা ফাসো

বিষয়বস্তু: সাব সাহারান আফ্রিকা, ফ্রান্স, বুর্কিনা ফাসো, রাশিয়া, নাগরিক মাধ্যম, প্রচার মাধ্যম ও সাংবাদিকতা, প্রতিবাদ, যুদ্ধ এবং সংঘর্ষ, রাজনীতি, সরকার

বুর্কিনা ফাসোর মানচিত্র, ফ্রান্স [1] ২৪ এর ইউটিউব চ্যানেল থেকে নেওয়া পর্দাছবি

২০১৫ সাল থেকে সশস্ত্র সংঘাত ও একটি জিহাদি বিদ্রোহ [2] বুর্কিনা ফাসোতে ভীষণ রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করেছে। বুরকিনা ফাসো সরকার আঞ্চলিক শান্তিরক্ষী হিসেবে ফ্রান্সের স্থানে রাশিয়াকে আমন্ত্রণ এবং দেশকে সুরক্ষার জন্যে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের আহ্বান জানানোর একটি নতুন কৌশল নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে।

একের পর এক অভ্যুত্থান

বুর্কিনা ফাসোতে (ভূতপূর্ব আপার ভোল্টা) ১৯৮০ এর দশক থেকে প্রায়ই সহিংস রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটেছে। ১৯৮৭ সালে বুরকিনাবে বিপ্লবের জনক টমাস শংকরা [3]র বিরুদ্ধে একটি অভ্যুত্থানে [4]র মাধ্যমে ব্লেইজ কম্পাওরে [5] ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। ২০১৪ সালে তার পতনের পর দেশটি ক্রান্তিকালীন জাতীয় পর্ষদের (সিএনটি) নেতৃত্বাধীন রয়েছে, যা ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে আরেকটি অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা দমন করে।

কয়েক মাস পরে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে রচ মার্ক ক্রিশ্চিয়ান কাবোরে [6] রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু এই সময় থেকেই আজ অবধি একটি নিরাপত্তা সংকটের সূচনা হয় [7]। কাবোরে ২০২০ সালে দ্বিতীয় মেয়াদের জন্যে পুনরায় নির্বাচিত হলেও ২০২২ সালে সেনাবাহিনীর চাপে পদত্যাগে বাধ্য হন। দেশটি ২০২২ সালের জানুয়ারিতে একটি নতুন অভ্যুত্থানে [8]র মুখোমুখি পল-হেনরি সান্দাওগো দামিবা [9] দেশের হাল ধরলেও ক্রান্তিকালীন রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি মাত্র আট মাস এই পদে থাকতে পারেন৷ ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর তারিখে ক্যাপ্টেন ইব্রাহিম ত্রাওরে [10]র নেতৃত্বাধীন আরেকটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়।

নতুন রাষ্ট্রপতি সেনাবাহিনীর মধ্যে [11] একটি এবং আরেকটি রাজনৈতিক দলে [12]র সংখ্যা হ্রাস করার মতো বেশ কয়েকটি সংস্কার ঘোষণা করেছেন। সামনের দিকে এগিয়ে যেতে ক্রান্তিকালীন সরকার নিরাপত্তা সংকটের অবসান ঘটাতে তার নাগরিকদের উপর নির্ভর করতে চায় এবং শুধু ফ্রান্সের মতো কৌশলগত অংশীদারের উপর নির্ভর করতে চায় না। এসব পদক্ষেপ সত্ত্বেও এখন দুই দশক ধরে দেশটি আল-কায়েদা [13]ইসলামি স্টেটে [14]র বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি দেশের চালানো সাহেল যুদ্ধে [15]র সাথে যুক্ত মারাত্মক জিহাদি হামলা [16]র শিকার।

জাতিগত ও ধর্মীয় মিশ্রণের কারণে বুরকিনা ফাসো এই যুদ্ধের মাধ্যমে গভীরভাবে প্রভাবিত। দেশটির ২ কোটি বাসিন্দা [17] ৬০টি জাতিগত গোষ্ঠী [18]তে বিভক্ত। সংখ্যাগরিষ্ঠ মসি [19]রা প্রধানত দেশের কেন্দ্রে বাস করে। ফুলা [20] এবং তুয়ারেগ [21]রা প্রধানত দেশের উত্তরে বাস করে। ধর্মের দিক থেকে [22] বুরকিনা ফাসোতে সংখ্যাগরিষ্ঠ (৬০ শতাংশ) মুসলমানের সাথে ক্যাথলিক (২৩ শতাংশ) এবং প্রকৃতি পূজারী (১৫ শতাংশ) সম্প্রদায় রয়েছে।

দেশ রক্ষার জন্যে স্বেচ্ছাসেবকদের আহ্বান

বুরকিনা ফাসো ২০২২ সালের অক্টোবরে দেশটির উত্তরাঞ্চলে সক্রিয় বৃহত্তর সাহারার ইসলামি স্টেট [23], ইসলাম ও মুসলমান সমর্থনকারী দল [24] এবং আনসার উল-ইসলামে [25]র বিরোধিতা করার জন্যে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে তৈরি একটি আধা-সামরিক গোষ্ঠী স্বদেশ প্রতিরক্ষা স্বেচ্ছাসেবী [26]র (ভিডিপি) জন্যে ৫০,০০০ জন নাগরিক নিয়োগের একটি প্রচারাভিযান [27] শুরু করে।

কর্তৃপক্ষ ২০২২ সালের নভেম্বরের শেষে ৯০,০০০ জন নিয়োগের ঘোষণা করে [28]। কিছু বুরকিনাবে পদক্ষেপটিকে টুইটারে [29] সাধুবাদ জানায়:

ইব্রাহিম ত্রাওরে তার বাজিতে জিতেছেন। হাজার হাজার বুরকিনাবে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে স্বদেশ প্রতিরক্ষায় (ভিডিপি) যোগদান করেছে।
“ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়।”
বুরকিনার বীর জনগণকে শুভেচ্ছা। কে সাব্রে, বারখানে, তাকুবা বা আক্রা উদ্যোগকে কে পাত্তা দেয়?

সাব্রে, বারখানে এবং তাকুবা [32] হলো ২০০৯ সাল থেকে বুরকিনা ফাসোতে ফরাসি সৈন্যদের পরিচালিত বিভিন্ন সামরিক অভিযান। পশ্চিম আফ্রিকার ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তাহীনতা মোকাবেলায় ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে বেনিন, বুরকিনা ফাসো, আইভরি কোস্ট, ঘানা এবং টোগোর চালু করা একটি প্রক্রিয়া হলো আক্রা উদ্যোগ [33]

কিন্তু ভিডিপি মোতায়েনের জন্যে বড় সংস্থানের দরকার। এই ভিডিপি আধা-সামরিক সদস্যদের কর্মে পাঠাতে বুরকিনা ফাসোর প্রয়োজনীয় ১০,০০০ কোটি সিএফএ ফ্রাঙ্ক (প্রায় ১,৭৪৪ কোটি টাকা) আজ পর্যন্ত অর্জিত হয়নি। পশ্চিম আফ্রিকা গণতন্ত্র রেডিও [34] (ডাব্লিউএডিআর) প্রশ্ন করলে বুরকিনার সামাজিক দক্ষতা ব্যবস্থাপনা এবং অন্তর্ভূক্তিমূলক অর্থায়ন বিশেষজ্ঞ ওমারু ইয়ারো এপর্যন্ত মাত্র ৪৩.২ কোটি সিএফএ ফ্রাঙ্ক (প্রায় ৭ কোটি ৫৫ লক্ষ টাকা) সংগ্রহের কথা বলেন।

ডাব্লিউএডিআরে [35]র সাথে এই সাক্ষাৎকারে [36] ইয়ারো তহবিল সংগ্রহে অভিযানে অবদান রাখতে বুরকিনাবেদের অলসতার কারণ দেখিয়েছেন:

“(…) la crise a suscité beaucoup de déplacement et certains déplacés ont été accueillis par des familles. Ce qui a réduit leurs pouvoirs d’achat. Les revendications des salariés n’ont pas obtenu satisfaction et le coup de l’inflation, l'un des plus élevés actuellement. Certaines entreprises ont préféré contribuer en nature que de donner de l’argent. Certains Burkinabè ne sont pas sûrs que ce fonds allait être bien géré. Ce qui a incité le gouvernement à faire des points réguliers à la population”.

“(…) সংকটটি প্রচুর পরিমাণে বাস্তুচ্যুতির সূত্রপাত করেছে এবং পরিবারগুলিতে এই বাস্তুচ্যুতি ঘটায় তাদের ব্যয় ক্ষমতা কমে গেছে। কর্মচারীদের মজুরি চাহিদা পূরণ করা হয়নি এবং তার উপর বর্তমানে সর্বোচ্চ স্তরে থাকা মুদ্রাস্ফীতির আঘাত রয়েছে। কিছু সংস্থা অনুদানের পরিবর্তে  কিছু কিছু করে অর্থ দিচ্ছে। অনেক বুরকিনাবে এই তহবিলটি ভালভাবে পরিচালিনার বিষয়ে সন্দিহান বলে তারা সরকারকে জনগণের কাছে নিয়মিত জানাতে বলেছে।

ফরাসি সশস্ত্র বাহিনীর সাম্প্রতিক প্রস্থানের সাথে যুক্ত একটি জটিল প্রেক্ষাপটে এটি ঘটছে।

ফরাসি সৈন্যদের প্রস্থান ও রাশিয়ার সাথে পুনর্মিলন

বুর্কিনা ফাসো সরকার ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ২০১৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর থেকে দেশে “ফরাসি সশস্ত্র বাহিনীর হস্তক্ষেপ পরিস্থিতি সংক্রান্ত” চুক্তি প্রত্যাহার করে অবশেষে এর অবসান ঘটায় [37]। এছাড়া কর্তৃপক্ষ ২০০৯ সাল থেকে উপস্থিত থাকা ৪০০ ফরাসি সৈন্য প্রস্থানের [38] জন্যেও অনুরোধ করছে। রাজধানী ওয়াগাডুগু ভাড়াটে ওয়াগনার গোষ্ঠীর [39] সাথে সম্ভাব্য সম্পর্কসহ রাশিয়াকে বেছে নিয়ে তার কৌশলগত অংশীদারিত্বকে বৈচিত্র্যময় করার ইচ্ছা প্রকাশ করছে।

আফ্রিকানিউজে [40] উদ্ধৃত বুরকিনাবের শিক্ষার্থী অ্যানিসেট ওয়েড্রাওগোর মন্তব্যের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে কিছু লোক এই সিদ্ধান্তে উচ্ছ্বসিত এবং রাশিয়ার সাথে পুনরায় একটি সম্পর্ক স্থাপনের প্রকাশ্য আহ্বান [41]  জানিয়েছে।

C’est une très belle initiative. Je dirais même qu’ils ont tardé. Il fallait le faire très tôt parce qu'actuellement on a besoin de partenaires francs qui peuvent réellement travailler avec le Burkina Faso.

এটা একটা দারুণ উদ্যোগ। আমি এমনকি বলব তারা তাদের পা হেঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। এটি এখনই করা উচিত কারণ এই মুহূর্তে আমাদের বুর্কিনা ফাসোর সাথে সত্যিকারভাবে কাজ করার মতো সৎ অংশীদার দরকার।

বুর্কিনা ফাসোতে রুশ রাষ্ট্রদূত আলেক্সি সালটিকভের সাথে একই সাক্ষাৎকার [42] শেষে এই ধারণাটিই প্রতিধ্বনিত করেছেন বুর্কিনা ফাসোর প্রধানমন্ত্রী অ্যাপোলিনায়ার কাইলেম ডি টেম্বেলা:

La Russie est un choix de raison dans cette dynamique [et] nous pensons que notre partenariat doit se renforcer.

এই গতিশীলতায় রাশিয়া একটি যৌক্তিক পছন্দ [এবং] আমরা মনে করি আমাদের অংশীদারিত্ব আরো জোরদার হওয়া উচিত।

রাশিয়া তার প্রস্তুতির ইঙ্গিত দিয়েছে: মধ্য আফ্রিকায় রুশ সামরিক প্রশিক্ষকদের একজন প্রতিনিধি আলেকজান্ডার ইভানভ বুর্কিনা ফাসোর সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণের জন্যে তার মধ্য আফ্রিকার “অভিজ্ঞতা ভাগাভাগির” সমর্থনকে টুইট করেছেন [43]। ২০২৩ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি তারিখে মালি সফরে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ জিহাদিদের মোকাবেলায় সাহেল ও গিনি উপসাগরীয় দেশগুলিতে রাশিয়ার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন [44]

২০১৫ সাল থেকে ১০,০০০ জনের বেশি হতাহত

বিভিন্ন সংস্থা ২০১৫ সালে সন্ত্রাসী হামলা শুরু থেকে বুর্কিনা ফাসোতে মানুষের জীবনের ক্ষতির ঘটনা নিবিড়ভাবে অনুসরণ করছে। ২০১৮ সালের অক্টোবরে বুরকিনা ফাসো সরকার এপ্রিল ২০১৫ থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ এর মধ্যে ১১৮ জন মারা যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে [45] যাদের ৭০ জন বেসামরিক নাগরিক এবং ৪৮ জন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য। এদিকে ফ্রান্স সংবাদমাধ্যম এজেন্সি (এএফপি) [46] দাবি করেছে ২০১৫ সাল থেকে ২০১৯ সালের মাসের মধ্যে ৪০০ জন নিহত হয়েছে। মানবাধিকার পর্যবেক্ষকে [47]র মতে ২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে ২০২০ সালের জানুয়ারির মধ্যে জিহাদিরা দেশটিতে অন্তত ২৫৬ জন বেসামরিক লোককে হত্যা করেছে।

বুরকিনা ফাসো ভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা গণতন্ত্র ও মানবাধিকার মানমন্দির [48] (ওডিডিএইচ) ৪ এপ্রিল, ২০১৫ এবং ৩১ মে, ২০২০ এর মধ্যে জিহাদিদের হাতে বুরকিনাবে সামরিক কর্মীদের ৪৩৬ নিহত ও ৩১০ জন আহত, ১,২১৯ জন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত ও ৩৪৯ জন আহত এবং দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর হাতে ৫৮৮ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হওয়ার হিসেব করেছে।

২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে বেসরকারি সংস্থা সশস্ত্র সংঘর্ষের অবস্থান এবং সংঘটনের ডেটা প্রকল্প [49] (এসিএলইডি) ২০১৫ সাল থেকে সংঘাতে ১২,০০০ জনেরও বেশি লোক মারা গেছে বলে অনুমান করেছে।

জাতিসংঘের শরণার্থী হাইকমিশন [50] ২০১৯ সালের ১১ অক্টোবর তারিখে জানিয়েছে উত্তরের হিংসাত্মক আক্রমণগুলি ৪ লক্ষ ৮৬ হাজার বাস্তুচ্যুত ব্যক্তি তৈরি করেছে যাদের ২,৬৭,০০০ জন ২০১৯ সালের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে তৈরি হয়েছে, এবং বেশিরভাগ শরণার্থী দেশের মধ্যভাগের বড় বড় শহরগুলিতে ও ১৬,০০০ এর মতো বিদেশে পালিয়ে গেছে।

নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতি সুদূর পরাহত: ২০২৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তারিখে দেশের উত্তরে মালি ও নাইজারের সীমান্তে সন্দেহভাজন জিহাদিদের একটি অতর্কিত হামলা [51]য় কমপক্ষে ৫১ জন সৈন্য নিহত হয়। এই আক্রমণের জবাবে জাতীয় সেনাবাহিনী নতুন অভিযান [52] পরিচালনা করে যাতে অন্তত একশত সন্ত্রাসী নিষ্ক্রিয় হয়।